পরিমল রায়

অনুষদ সদস্য বাংলাদেশ লোক -প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র

পরকীয়া: পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শের শিকার নারীর শরীর

আমরা যারা পুরুষ, নারীর কাছে শতভাগ বিশুদ্ধতা কিংবা সততা চাই তারা নিজে কতোটা শুদ্ধ অথবা পরিশুদ্ধ? কার মানদন্ডে সঠিক তা নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তুলি না। যদি কেউ এতদসংক্রান্ত প্রশ্ন তুলে তাহলে বিষয়টিকে কেবল নারীর জন্য সযত্নে আগলে রাখি। শব্দের গাঁথুনী কিংবা বাক্যবানে অথবা যুক্তির বেড়াজালে নারীকে করে তুলি অপাঙক্তেয়। নারী পবিত্র বা অপবিত্র যাই হোক না- আলোচনা বিষয়বস্তু- নারীর শরীর ও তার ব্যবহারের মনস্তাত্তিক প্রেক্ষাপটের নীতিদীর্ঘ রচনা লেখা।

কৃষির সূচনা নারীর হাতে তাহলে বলা যেতেই পারে- অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার ভিত্তি নারী। কিন্তু নারী তার দৃঢতায় পথ চলতে পারে নি। বারবার পথচ্যুত হয়েছে, হারিয়েছে তার সততা ও বিশুদ্ধতার উপাধিটি। প্রখ্যাত মার্ক্সসিস্ট ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস পরিবারের বিবর্তনের যে ধারাটি দেখিয়েছেন সেখানে নারীর যৌন স্বাধীনতা হরণের বিষয়টি স্পষ্টতঃ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তাই তো যৌনবৃত্তিতে নারীর কলঙ্ক তিলক থাকলেও পুরুষ পরিচয় দেয় এটাই পৌরুষত্ব কিংবা শৌর্ষ-বীর্যের লক্ষণ হিসেবে। রেবতী বর্মন বলুন কিংবা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসই বলুন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বিলোপই নারীকে টেনেছে পিছনে। এ বিষয়ে দ্বিমতের কোনও অবকাশ নেই।

মার্কসীয় ধারায় অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের আড়ালে উদারনৈতিকতার নামে যৌনবৃত্তির বৈধতা দিলেও সমাজ-সংস্কার একে বৈধতা না দিয়ে বরং টেনেছে আরো পিছনে। উত্তরোত্তর প্রযুক্তির বিকাশে নারীর শরীর বরাবরই লক্ষ্যবস্তু। তাই ইস্টার বশেরাফের- নারী ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নারীর শরীর থেকে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গী সরাতে তো পারে নি বরং দৃষ্টি দিয়েছে আরো সতর্কভাবে। পুরুষ নারীকে পেতে চায় বিভিন্ন উপায়ে এমনকি ফ্রয়েডিয়ান তত্ত্বে হলেও।

পরকীয়া এমনই একটি সামাজিক প্রপঞ্চ যা নারীকে বিবেচনা করে ভোগ্য পণ্য হিসেবে। এই ভোগ্য পণ্যের সরব উপস্থিতি আমরা হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদেও পাই এভাবে- “যে বঁধুটি দিনের বেলায় কাকের শব্দে ভয় পায়। সেই বঁধুটিই আবার রাতের বেলায় অভিসারে যায়।” চর্যাপদের কবি ঢেগুনপার কবিতায় পাওয়া যায়- “টলেত মোর ঘোর নাহি পড়াবেষী হাড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী।” অর্থ্যাৎ- ঘরে ভাত না থাকলেও প্রেমিক এসে ঘরে ভিড় করে। আহা! কী শান্তি পরকীয়ায়? অন্যের দখলে থাকা ভূমিতে চাষাবাদ করো ইচ্ছে মতো?

নারীর অঙ্গ বর্ণনা বাংলা গানের বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে। কবিতায় উপন্যাসে, গীতি নাট্য, প্রবন্ধ, মহাকাব্যে নারীর অঙ্গ বর্ণনায়- হাজারো শব্দের সমাহার। কিন্তু গানে পরকীয়ার সন্ধান বিশেষ অঙ্গের বিশেষ ব্যবহার পাওয়া যায় এভাবে- “ভ্রমর কইও গিয়া, শ্রীকৃষ্ণের বিচ্ছেদে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর, কইও গিয়া।” ভ্রমরের দুতিয়ালিতে রাধার ব্যাকুলতা নিরসনে কৃষ্ণের উপস্থিতি পরকীয়া প্রেমের উদাহরণে এই বিশেষ অঙ্গের কি যে জ্বলুনি তা সহসাই অনুমেয়। কিংবা ঐ শুনো কদম্ব তলায় বংশী বাজায় কেরে সখী, বংশী বাজায় কে? এখানেও পরকীয়া প্রেমের সরস উপস্থিতি পাওয়া যায়। রাধা যখন সখীর সনে জল ভরতে নদীতে যায় তখন কৃষ্ণ বাঁশী বাজায়ে চায় রাধাকে আকৃষ্ট করতে। রাধা বিবাহিত বলে কলঙ্কের ভাগ তাকেই নিতে হয়। যেমনটা বলা হয়েছে এ লেখার শুরুতে।

গানে আমরা আরো পাই যে, যখন শুনি- “চল বিয়াইন আজ মন কুড়াতে যাই” শীর্ষক বাংলার লোক সঙ্গীতে (বিয়াইন সর্ম্পকটিকে বিবেচনা করুন) যখন বিয়াইনকে মন কুড়ানোর প্রস্তাব দেয়া, তখন স্পষ্টতই পরকীয়া প্রেমের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। কিংবা আমরা পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের গানের সুরে বলতে পারি যে, ”আমায় এতো রাতে কেনে ডাক দিলা, প্রাণ কোকিলা রে; শিয়রে শ্বাশুড়ী ঘুমায়, জ্বলন্ত ডাকিনী; পইঠানে ননদী শুয়ে দুরন্ত নাগিনী।” পুরো গানটি শুনলে ধ্রুপদী বাংলার চিত্র পাওয়ার পাশাপাশি আপনি প্রেমের চিরন্তন পরকীয়ার রসায়নটি পাবেন। তখন মনে হবে কোজাগরি জ্যোৎস্নায় আপনি শরৎ চন্দ্রের দেবদাস হয়ে কেরু এন্ড কোং এর পানীয় হাতে কাজী নজরুল ইসলাম- পূজারিণী কবিতার ‘‘নারী, এরা লোভী, এরা দেবী/ এরা একা কারো নাহি হতে চায়, যত পূজা পায়, চায় তত আরো” বারবার আবৃত্তি করবেন। অর্থ্যাৎ নারীর প্রেমকে দেখা হয়েছে অবজ্ঞাভরে। অথচ একই কাজে পুরুষকে দেখা হয় সুপুরুষ হিসেবে। যার কারণে বলা যায় প্রেম শব্দটি উভয় লিঙ্গের কাছে কোন ভাবেই একই অর্থ বোঝায় না।

1683 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।