দক্ষিন এশিয়ায় মা একটি বিশাল বিষয়। সামাজিক যত ধরনের প্রতিষ্ঠান আছে, মা হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবং একক একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি হাজারো বাগাড়ম্বর প্রতিষ্টানের মতো নয়, শত ধরণের যৌক্তিক এবং স্বীকৃত প্রতিষ্টান।
আমাদের মায়েদের যে ত্যাগ, শ্রম সন্তানের জন্য, পশ্চিমা মায়েদের কাছে তা বয়ান করলে তাদের হা মুখ দু’হাত দিয়ে চাপ না দিলে আঁটানো যাবে না।
সন্তানকে পেটে ধরার দিন থেকে বেনারসি/শেরোয়ানী পরিয়ে দেয়ার দিন মায়ের যে কান্না, সেই কান্না কেবল অতি আপনজন হারানোর বিলাপের সাথেই তুল্য। বেনারসি পরানোর কান্না বুঝলাম, শেরোয়ানী পরানোর সময় মায়েদের কান্না আমাকে অনেক ভাবিয়েছে পুত্রতো বউ নিয়ে বাড়িই ফিরবে, কন্যার মতো যমের ঘরে পাঠানো হচ্ছে না, তবে মায়েরা কেনো বিলাপ করেন এমন আনন্দের দিনে? উত্তর এখন জানি, কেবল ছেলেরা জানেন না বলে…
মা হওয়াটা বা মাতৃত্ববোধটা সন্তান হওয়ার সাথে সাথেই হয় না, এরও যে সময়ের দরকার, এটা আমার কাছেও পরীক্ষিত। শারীরিকভাবে একজন নারী যে কেনো সময়ে মা হতে পারে, মানসিকভাবে মা হতে তাকে অনেক সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। সংগ্রামটা হাজার বছরের মিথ এবং ট্যাবুর সাথে। ভাল মা হওয়ার এবং মন্দ মা না হওয়ার সংগ্রাম। এই অগ্নিপরীক্ষাটা আমাদের দক্ষিন এশিয়ার মায়েদেরই সবচেয়ে বেশি এবং কঠিনতমভাবে দিতে হয় আমৃত্যু। আমাদের দক্ষিন এশিয়ার মায়েদের কোনোভাবেই মাতৃত্ব থেকে পদচ্যুত হওয়ার সুযোগ নেই, তেমন হলে জীবনভর দিয়ে আসা অগ্নিপরীক্ষা মুহূর্তেই ধূলিসাৎ… এমনকী তুমি যে মা, তুমি যে ঢেঁকি, তোমাকে প্রতি মুহূর্তে তোমার সন্তানের কাছেও সনদপত্র সত্যায়নের জন্য করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
পশ্চিমে মা নিয়ে আলাদা ইতিহাস চোখে পড়ে না। তেমন কোনো গান নেই। সাহিত্য, নাটক, কবিতা, সিনেমায়ও আমাদের মা নিয়ে সে কনসেপ্ট, মায়েদের যে ইমেজ, তা প্রায় নেইই। বাবা মা ফিফটি ফিফটি, কখনো বাবা নাইনটি, মা টেন। কখনো মা একাই একশ, তবে খুব কম। কারন সন্তান ধারণের সময় পশ্চিমা বাবারা আমাদের বাবাদের মতো ঝাড়া হাত পা থাকতে পারে না। বিভিন্ন ধরণের বিষয় আশয়ে বাবার সরাসরি উপস্থিতি থাকতে হয়। ধরেন মা ওটিতে, নবজাতকের প্রথম ন্যাপি, পোশাক পরাতে হচ্ছে বাবাকেই, তারপর প্রথম দুধের বোতলও সন্তানের মুখে ধরে রাখতে হচ্ছে তাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাতে উঠে উঠে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে হচ্ছে, ন্যাপি বদলাতে হচ্ছে বাবাকে, কারণ মা ক্লান্ত। বেকার মা হলেও কর্মজীবি বাবা জানে সন্তান পালন কী কঠিন দায়িত্ব, বিশেষ করে যে মা সন্তানকে দিনের বেশিরভাগ সময়টাই দিয়েছে তার, রাতে চুপি চুপি উঠে তাই বাবারাই সন্তানের দেখভাল করে পশ্চিমে।
ভাল লেগেছিলো প্রিন্স উইলিয়াম তার প্রথম সন্তানের জন্মের কিছুদিন পর বাড়ির বাইরে গেছে, কান্ট্রি সাইডে থাকে সে পরিবার নিয়ে। গ্রামের মানুষ প্রিন্সকে ন্যাপি আর ওয়াইপস উপহার দিচ্ছিলো আর গর্বিত বাবা বার বার ধন্যবাদ দিচ্ছিলো গ্রামবাসীকে!
আমাদের বাবারা (ধনী বাবা আর রিক্সাচালক বাবা) বাড়ি ফেরেন কুরুক্ষেত্র সেরে। তিনি যে জবই করেন, বাড়িতে ফিরে তিনিই ঈশ্বর। হাগামুতা সাফ করা থেকে কলেজের প্রিন্সিপাল মাও মা-ই। তখন মায়ের মা কোমাতে থাকলেও চার/পাঁচ সন্তানকে বাবার হাওলা করে বেরিয়ে যাওয়ার কথা দিবা স্বপ্নেও দেখতে পারবেন না। কিন্তু পশ্চিমা মা ‘হ্যাভ ফান উইথ পাপা’ বলে চাবি হাতে বেরিয়ে পড়বে বন্ধুদের সাথে। হয়তো খেতে যাবে, সিনেমায় যেতে পারে বা সামার ক্যাম্পিংয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য।
পশ্চিমের মায়েরা তাই বেঁচে থাকে, আমাদের মায়েদের মতো বাঁচার সংগ্রাম করতে হয় না। সবকিছুতে খুব সুখী সংসার আমার -বলে মাঝরাতে বাথরুমে বসে কেঁদে আসতে হয় না মাঝে মাঝে।
এখন আমার জামাই যদি অভিযোগ করেন উনার কথা কম বলা হলো? বোকা নাকি!আমি মন্দ মা হিসেবে আপনাদের লাইক কম পাই আরকি! তাছাড়া বাংলাদেশের বাবা হলে কেমন বাবা হতেন? সে পরীক্ষাতো নেয়াই হয়নি উনার...