ফরিদ আহমেদ

লেখক, অনুবাদক, দেশে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। দীর্ঘ সময় মুক্তমনা ব্লগের মডারেশনের সাথে জড়িত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ের অনুবাদ করেছেন। বর্তমানে ক্যানাডা রেভেন্যু এজেন্সিতে কর্মরত অবস্থায় আছেন। টরন্টোতে বসবাস করেন।

পিতামহীর প্রতি পত্র - (পর্ব- ১) মূলঃ আয়ান হারসি আলি

প্রিয় দাদিমা,

তোমার মৃত্যুতে আমি কাঁদি নাই, বিলাপও করি নাই। তুমি চিরবিদায় নেবার জন্য প্রস্তুত ছিলে। মা বলেছেন, তুমি প্রতিদিন তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে অনুনয় জানাচ্ছিলে তোমাকে এই পৃথিবী থেকে তুলে নেবার জন্য। তোমার পদযুগল তোমাকে আর বহন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলো। সোজা পা’-কে ভাঁজ করতে গেলে তারা তোমাকে যন্ত্রণা দিতো। কিছুক্ষণ ভাঁজ করে রাখলে বা কুণ্ডলী পাকিয়ে রাখলে তারা সোজা হতে চাইতো না। সোজা করার চেষ্টা চালালে তারা মড়মড় শব্দ করে তীব্র প্রতিবাদ জানাতো। কিছুক্ষণ বসে থাকলে তোমার কোমরের পাশ ব্যথা করতো, শুয়ে থাকলেও।

তোমার চামড়া এতোই কুঁচকে গিয়েছিলো, এতোই ভাঁজ পড়েছিলো যে সেগুলোকে পরিষ্কার করাটাই কষ্টকর কাজ ছিলো। ভাঁজের মাঝে ঘাম জমে থাকতো। যার কারণে তোমার চামড়ায় চুলকানি হচ্ছিলো। তোমার দীর্ঘ, সরু এবং সুদৃশ্য আঙ্গুলগুলো অনমনীয় এবং আঁকাবাঁকা গাছের শাখার মতো বাঁকা হয়ে ভিতরের দিকে চলে গিয়েছিলো। তুমি সেগুলো দিয়েই তোমার শরীরের পাশের চুলকানির জায়গা চুলকাতে। সেটা করতে গিয়ে চুলকানি সারার বদলে নখের আঁচড়ে তুমি রক্তাক্ত হতে। তোমার কানও তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা শুরু করেছিলো। কিছুই শুনতে চাইতো না। তোমার চোখ দুটোও আর কিছু দেখেনি শেষ সময়ে। তোমার কন্যারা এবং নাতনিরা তোমাকে যতোখানি সম্ভব আরাম দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো তাদের সর্বোচ্চ সাধ্য দিয়ে, কিন্তু তোমার বৃদ্ধ বয়সের ব্যথাকে তারা উপশম করতে পারে নাই।

তোমার মৃত্যুতে আমি কাঁদি নাই ঠিকই, কিন্তু গভীর অপরাধবোধে ভুগেছি। শুধু ভেবেছি, তোমার মৃত্যুর সময়টাতে আমি যদি তোমার পাশে থাকতে পারতাম। ছোট বেলায় আমি যখন ব্যথা পেতাম, তুমি আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে পরম মমতায়। আমার যখন একবার জ্বর হয়েছিলো ছেলেবেলায়, আমি জানতাম না এর বিরুদ্ধে কীভাবে লড়তে হয়, কীভাবে নিরাময় হতে হয়। তুমি আমার কানে ফিসফিস করে সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েছিলে। তুমি আমার হয়ে তোমার পূর্বপুরুষদের কাছে সাহায্য চেয়েছিলে। আমাকে বকাবকি করেছিলে যেন আমি হাল না ছাড়ি। তুমি আমাকে ভুডুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলে। ভুডু তোমার টাকা নিয়েছিলো, ভেড়া নিয়েছিলো। কিন্তু কাজের কাজ কিছু করতে পারে নি। করার মধ্যে যেটা করেছিলো, সেটা হচ্ছে আমার বুক পুড়িয়ে দিয়েছিলো গরম শলাকা দিয়ে। জিভের ডগায় কামারের লম্বা গরম পেরেক নিয়ে সে আমার বুকে গর্ত করে দিয়েছিলো শয়তান তাড়াবার অছিলায়। এটা আমাকে আমার জ্বরের চেয়েও বেশি আঘাত এবং যন্ত্রণা দিয়েছিলো। আজো আমার বুকে সেই ক্ষতচিহ্ন রয়েছে দাদিমা। এই ক্ষতচিহ্ন আমার কাছে আমার প্রতি তোমার ভালোবাসারই প্রতীক। ভুডু নয়, তুমিই আসলে আমাকে উদ্দীপ্ত করেছিলে আমার রক্তের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং নিরাময় হতে।

আমি খুবই দুঃখিত দাদিমা। আমার ছোটবেলায় তুমি আমার পাশে যেভাবে ছিলে, তোমার শেষ বয়সে আমি সেভাবে তোমার পাশে থাকতে পারি নি। থাকতে পারলে আমি আমার নতুন পৃথিবীর সব পাওয়াকে তোমার কাজে লাগাতে পারতাম। কুচকে যাওয়া চামড়ার ভাঁজের মাঝের ময়লাকে পরিষ্কার করার এবং চুলকানিকে দুর করার জন্য এদের মলম আছে। কানে শোনার জন্য আছে হিয়ারিং এইড। চাকা লাগানো ওয়াকিং স্টিক আছে এদের, বুড়োবুড়িদের রাস্তায় সহজ চলাচলের জন্য। শুধু এইসব যন্ত্রপাতিই নয়, এদের যন্ত্রণা নিবারক ওষুধপত্রও আছে। তোমাকে ছেড়ে চলে এসেছি আমি, সেজন্য খুবই দুঃখিত দাদিমা। তোমার বৃদ্ধ বয়সে যখন আমি হতে পারতাম তোমার আরামের এক উৎস, তখনই আমি তোমার পাশে ছিলাম না।

আমি দুই দশক ধরে কাফেরদের সাথে বসবাস করছি। আমি তাদের জীবনপ্রণালী উপলব্ধি করতে পেরেছি, শিখেছি এবং সেটাকে আমার জীবনে আত্মস্থ করতে পেরেছি। আমি জানিই, এটা জানার পরে তুমি খুবই দুঃখ পাবে। বাবা মারা যাবার আগে আমাকে আমার মন পরিবর্তন করতে বলেছিলেন। আমি যখনই মায়ের সাথে ফোনে কথা বলি, তিনিও আমাকে সবসময় একই কথা বলেন। আ্মার ধারণা, তুমিও আমার বাবা-মায়ের মতোই একই আচরণ করতে। আমাকে বলতে আমার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে। কিন্তু, এই সাথে আমার মধ্যে অদ্ভুত একটা অনুভূতিও কাজ করে দাদিমা। কেনো যেন আমার মনে হয় তুমি আমার এখনকার দৃষ্টিভঙ্গিটাও বুঝতে পারতে।

আমি এখনো তোমার মৃত্যুতে কাঁদছি না দাদিমা।

তোমার সাথে সাথে আচার-পদ্ধতির কড়া নিয়ম কানুনও চলে গেলো দাদিমা। “আমার সাথে সাথে বলো, আমি আয়ান, হারসির কন্যা, যে কিনা গুলেইড এর সন্তান ম্যাগানের পুত্র …….” তোমার সাথে সাথে রক্তের সেই উত্তরাধিকারও চলে গেলো। ভালো কী মন্দ জানি না। একই সাথে চলে গেলো সেই নির্বোধ প্রথা এবং ঐতিহ্য, যা তোমাকে তোমার কন্যা বা নাতনিদের মানুষ করার চেয়ে ঘোটকী এবং মেয়ে উটকে যত্নে রাখতে বলতো।

পরিবারে যখনই কোনো ছেলে সন্তান জন্মাতো, তুমি আনন্দিত হতে, উচ্ছ্বসিত হতে। তোমার চোখের তারা ঝিলিক দিয়ে উঠতো। তুমি নিবিড় আনন্দে খলখল করে হেসে উঠতে। তুমি প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে অসংখ্য ঘাসের মাদুর তৈরি করতে উপহার হিসাবে বিলানোর জন্য। সেগুলো বুনতে বুনতে তুমি আমাদের তোমার যোদ্ধা ঐতিহ্যের গল্প শোনাতে। গল্প শোনাতে সাহস, প্রতিরোধ এবং বিজয়ের। আর শোনাতে শুধু সম্মান, সম্মান আর সম্মানের গল্প।

পরিবারে কোনো মেয়ের জন্ম হলে, তুমি চরম বিরক্তি নিয়ে খিটখিটে আচরণ করতে। কখনো কখনো কয়েক দিনের জন্ম মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে তুমি। তালাল গাছের নীচে একটা বিশাল মাদুরে বসে থাকতে তুমি উবু হয়ে, মাদুর বুনতে, তোমার আঙুল মেহেদির রঙে হলুদ হয়ে থাকতো। আমাদের দেখলে তুমি তাড়া করতে, অশুভ গলায় আমাদের অভিশাপ দিতে, অভিশপ্ত অঘটনের আশংকার কথা বলতে। তারপর কয়েকদিন পরে যখন তুমি একটু শান্ত হতে, একটা পরিবারে অনেক বেশি মেয়ে থাকলে তাদের উপর কী পরিমাণ অশেষ দুর্গতি এবং দুর্ভাগ্য নেমে আসে সে কাহিনি বলতে। গুজব, বিশ্বাসঘাতকতা, জারজ সন্তান জন্ম ইত্যাকার নানা বিষয় ঘটে, সেগুলো বলতে। এগুলো হচ্ছে পরিবারের জন্য লজ্জা, লজ্জা এবং লজ্জা।

চলমান….

2601 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।