গ্রীষ্মকালীন দেশে প্রায় বছর বারো তেরো’তে কন্যা ঋতুমতী হলে তার শরীরে যৌবনের পদার্পন হয়, একজন নারীর মা হবার পেছনে কিংবা সন্তান জন্মদানের পেছনে রজঃস্বলা হবার ভূমিকা কি তা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজনীয়তা নেই হয়তো।এ উপমহাদেশ নানা অংশে পিছিয়ে আছে, পিছিয়ে পড়া উপমহাদেশের নারীকুল কিংবা তাদের শরীর সম্পর্কিত ধারণা, শারীরিক নানা পরিবর্তন নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, লুকোছাপাও খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আদিমযুগে না হলেও সে যুগ খুব একটা আগে নয় যখন নারীর মাসিক চলাকালীন সময়ে তাকে আলাদা ঘরে রাখা হতো, তার সকল কাজকে অশৌচ বলে মানা হতো, তাকে রান্না করতে বারণ করা হতো, মাথাব্যথায় তার মাথা ঝিম ধরলেও তাকে মাথায় জল ঢালতে দেয়া হতো না, খেতে দেয়া হতো ট্যালট্যালা খাবার, মসলাদার খাবারেও যদি শরীর বেশি খারাপ হয়! যদি বেশি যায় রক্ত তো! তখন নারীরা ব্যাবহার করতেন নরম কাপড়, সকলের চোখ এড়িয়ে সেই কাপড় শুকোতে দেয়া হতো কোনো না কোনো ঘরের কোণে, এটা বলার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই নেই যে সেই ত্যানা কাপড় স্যাতস্যাতে আবহাওয়াতে কতটা ব্যাকটেরিয়া মুক্ত হোত! তবে নারীরা সবক্ষেত্রেই মুখ বুজে চলেন, এক্ষেত্রেও তারা সেই কাপড়েই চলতেন মাসের পর মাস!
এখনকার দিনে এসব দিকে বেশ বদল হাওয়া এসেছে, শিক্ষিত বাবা-মা (যদিও সবাই নন) তার কিশোরী কন্যার মাসিক হলে তাকে এনে দিচ্ছেন প্যাড কিংবা ট্যাম্পুন, ব্যথা হলে পেটে দিচ্ছেন গরম পানির সেক! প্রথম শরীর খারাপে টকটকে রক্ত দেখে মেয়ে কেঁদে বুক ভাসালে মাথায় হাত বুলিয়ে সহজেই বলছেন, “ও কিছু না, তুমি বড় হয়েছো! “এতো কিছুর পরেও এখনো এই সমাজের মানুষ পিরিয়ডকে ট্যাবু হিসেবে দেখে।
গার্হস্হ্য অর্থনীতিতে পিরিয়ড নিয়ে যে অধ্যায় আছে তা নারী শিক্ষিকারাই দেখে না দেখার ভান করে বলেন বাসায় পড়ে নিও। কম্বাইন্ড স্কুল কলেজগুলোতে কোনো মেয়ে যদি বলে পেটে ব্যথা তো তাকে হাজারো কথা শুনতে হয়। পায়জামায় দাগ লাগলে তো কথাই নেই! এমনকি অফিসেও কোনো নারী যদি এখনো ব্যথায় কাতরে অফিস করেন তো পুরুষ সহকর্মীদের হাসির পাত্র হওয়া বন্ধ হয় না। ফার্মেসীতে একজন নারী যখন প্যাড কিনতে যান তাকে অপেক্ষা করতে হয় কখন ভীড় কমবে, কখন শুধুমাত্র দোকানদারের সামনে হড়বড় করে গিয়ে তিনি বলবেন, সেনোরা, হুইসপার, ওভারনাইট, এক্সট্রালার্জ! দোকানদারও তা শুনে প্যাকেটটিকে ইচ্ছামতো খবরের কাগজে মুড়ে ক্রেতার হাতে তা চালান করেন, ক্ষেত্রবিশেষে এখনো ফরমাশের লিস্টিতে স্বামী কিংবা বাবারাই স্ত্রী, কন্যার প্যাড কিনতে যান; কারণ কি এতো লুকোছাপার? কারণ আমরা সবাই জানি! পিরিয়ড এখনো লজ্জা! এখনো খোলা প্যাকেট নিয়ে রাস্তায় হাঁটলে পুরুষের টিটকারি শুনতে হবে! কিছু নারী নিজেও বলবেন, লজ্জার মাথা খাওয়া বেহায়া মেয়ে! মাসিকের প্যাড নিজে কিনে দেখাতে দেখাতে যায়! পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নারী সংখ্যায় কম নন এ দেশে।
কিন্তু আদৌ কি পিরিয়ড লজ্জার কিছু? আদতে কি আছে এতে রাখ ঢাক করার মতো! একজন নারীর পিরিয়ড একটি শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া, খাবার খাওয়ার মতো, প্রাত্যহিক স্নানের মতো এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে হবে। জেনে অবাক এবং খুশী হবেন হয়তো যে মাসিকের রক্ত অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন যা শিশুকে গর্ভকালীন পুষ্টিদান করে, মাসিকের রক্ত কোনোভাবেই দূষিত, খারাপ বা নোংরা নয়।মাসিকের সময় সাধারণত ১০ থেকে ৩৫ মিলিলিটারের মতো রক্তক্ষরণ হয় যা ২ থেকে ৭ টেবিল চামচ-এর সমান। এতে রক্তশূন্যতার কোনো সম্ভাবনা নেই যদি না তা সেই নির্দিষ্ট পরিসীমা অতিক্রম করে। মাসিক একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া; এটি মোটেই গোপনীয় বা লজ্জাজনক বিষয় নয়। বরং কোনো মেয়ের প্রথম মাসিক হওয়ার দিনটি তার জন্য অনেক আনন্দের ও গর্বের হওয়া উচিত; কেননা মাসিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একজন মেয়ে নারীত্বের জন্য প্রস্তুতি লাভ করে। মাসিকের সময় প্রতিদিন পরিষ্কার থাকতে হয় যাতে সবরকম রোগ-বালাই থেকে মুক্ত থাকা যায়। মাসিকজনিত রক্তস্বল্পতা পূরণ করার জন্য মেয়ে বা নারীদের এই সময় মাংস ও মাছের মতো প্রচুর আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। মাসিকের রক্তে বাজে গন্ধ হওয়ার কারণ মাছ বা মাংস নয়। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা। ফলে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণে এ দুর্গন্ধ হয়।
পেট ব্যথায় কাতরাতে থাকা, মাথাব্যথায় ঘরে শুয়ে থাকা, সমানে বমি করে ঘর ভাসিয়ে দেয়া পিরিয়ডের সময় এসব হয়েই থাকে, নড়াচড়া বা খেলার ছলে, প্যাড ছড়িয়ে রক্ত পা, জামাতে ছড়িয়ে গেলে, শাড়িতে লেগে গেলে, তাকে সতর্ক করুন, তাকে সাহায্য করুন। এটা খুব সুখের কথা নয় যে, যে শারীরিক পরিবর্তন নারীর দেহে না হলে আপনি আমি কেউ জন্মাতে পারতাম না সে পরিবর্তন নিয়ে হাসি তামাশা করা।পুরুষ নাকি নির্বিশেষে সকলকে অনুরোধ করছি, নিজের কন্যাশিশুকে পিরিয়ড হাইজিন নিয়ে শিক্ষা দিন। এ দেশে নারীরা এখন সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন জরায়ু মুখ ক্যান্সারে, প্রায় ১৩০০০ নারী নতুন করে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করেন প্রায় ৬,৬০০ নারী (প্রেক্ষিত ২০১০)। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে সারাদেশে ১৮ জন নারী মারা যাচ্ছেন জরায়ু-মুখ ক্যান্সারে। কিশোরী থেকে প্রায় যৌবনের শেষে এসে নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন মেনোরেজিয়া, ডিজনেনোরেজিয়াতে। টানা একই প্যাড পরে থাকা, অফিসে কিংবা স্কুলে প্রয়োজনীয় পরিস্কার টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় নারীরা ভূগছেন নানা ইনফেকশনে।
আচ্ছা আমরা কি এসব খবর রাখি? নিশ্চয়ই রাখি না! রাখলে অবশ্যই আর যাই হোক না কেনো, পিরিয়ডকে হাসি ঠাট্টার ছলে নিয়ে রসালো কথা ছড়াতাম না, কোনো মেয়ের চোখে ব্যথা দেখে বলতাম না, “আজকেই ফাইল রেডি করো, এক্ষনই পাঁচতলার ওঠো…. “কিংবা মাসিকের প্রথম দু’দিন ছুটির সুপারিশ করলে হেসে উঠতাম না মুখ বেকিয়ে কিংবা গলা উচিয়ে। কলেজে কোনো মেয়ে ব্যথায় কুকড়ে উঠলে বলতাম না, “কি? রেড সিগনাল? “ফিসফিস নয়, গুঞ্জন নয়, পিরিয়ডের হাইজিন নিশ্চিত করি। পিরিয়ড কোন ট্যাবু নয়, এটা বারবার খাঁচার ময়নার মতো না বলে নিজের মনকে বোঝাই। আসুন মানবিক হই, স্বাভাবিক হই, খোলা চোখে নারীর সাতটা দিন দেখি, তার কষ্ট দেখি, তার নারীত্বকে অভিবাদন জানাই।
#happyyobleed
#periodisnottabbo