খান আসাদ

সমাজকর্মী

পার্বত্য অঞ্চলে নারীর প্রতি সহিংসতা কি এথনিক ক্লিনজিং?

(১) 
একটি ধারনা আছে, পার্বত্য অঞ্চলে নারীর প্রতি সহিংসতা "এথনিক ক্লিনজিং" কৌশলের অংশ। ধারনাটি কি সঠিক?

ইংরেজি "এথনিক ক্লিনজিং" মানে কোনো জাতীগোষ্ঠীকে তাঁদের মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত করা, স্থানান্তর করা বা নিজআবাস থেকে উৎখাত করা, কিংবা গণহত্যার মধ্যদিয়ে আক্ষরিক অর্থেই নির্মূল করা।

এথনিক ক্লিনজিং, গণহত্যার পদ্ধতিতে করেছে, তুর্কিরা আর্মেনিয়ানদের, নাৎসিরা ইহুদীদের, সার্বরা বসনিয়ানদের বা রুয়ান্ডায়, নিকট অতীতে। আমেরিকাতে, সিয়স্ক, কোমাঞ্চি, আপ্যাচেহ আদিবাসীদের, যারা ছিলো আদি অধিবাসীও, এদের নির্মূল করেছে, আমাদের ইউরোপ থেকে যাওয়া "শাদা লোকেরা", এক শতাব্দী আগে। মধ্যযুগেও জাতিগত নির্মূলকরনের ঘটনা আমরা ইতিহাসে পাই।

হ্যাঁ, প্রায় সব ক্ষেত্রেই, জাতিগত নির্মূলকরণের সময়, নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এবং সব ক্ষেত্রেই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলো রাষ্ট্রযন্ত্র।

আক্ষরিক অর্থে, শারীরিকভাবে কোনো জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা, কেবল সামরিক ভাবে যুদ্ধের মধ্য দিয়েই সম্ভব। তবে, কোনো জনগোষ্ঠীকে সাংস্কৃতিক ভাবেও নির্মূল করা যেতে পারে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে। মানুষেরা বেঁচে থাকবে, কিন্তু তাঁদের সংস্কৃতি (মূল্যবোধ, ভাষা, পোশাক, শিল্প-সাহিত্য, প্রথা-প্রতিষ্ঠান) বেঁচে থাকবে না, নির্মূল হবে।

বাঙ্গালীদের "পাকিস্তানী" বানানোর রাজনীতি, প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক অভিযান, গণহত্যা, প্রায় আড়াই লক্ষ বাঙ্গালী নারী ধর্ষণের ইতিহাস এই রাজনীতিরই অনুষঙ্গ ছিলো। বাঙ্গালীদের "আরবীয় মুসলমান" বানানোর জন্য সাংস্কৃতিক নির্মূলকরনের হেফাজতি-জামায়াতি রাজনীতিও আমরা দেখছি।

(২) 
পার্বত্য অঞ্চলে, আদিবাসীদের উৎখাতের প্রথম ঘটনা "কাপ্তাইবাধ উন্নয়ন প্রকল্পের" মাধ্যমে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ও সাম্রাজ্যবাদের "উন্নয়ন" আয়োজনে। চাকমা রাজবাড়ীও চলে যায় জলের তলায়, উর্বর ধানিজমিসহ। অনেক আদিবাসী ভূমী থেকে উৎখাত হন, যাদের অনেকে আর ফিরে আসতে পারেন নি।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র শুরু থেকেই এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক পন্থা নেয় এবং গণহত্যার মধ্যদিয়ে জাতিগত নির্মূলকরণের কাজ না করে, একটি অভিনব সামরিক কৌশল নেয়, যেটাকে বলে, "ডেমোগ্রাফিক স্ট্রাটেজি" (জিয়াউর রহমান সাহেব নিয়েছিলেন)। ভূমিহীন "বাঙ্গালী মুসলমান"দের দিয়ে আদিবাসীদের সংখ্যালঘু করে দেয়া। যেখানে আদিবাসীরা ছিলো ৯০% এই রণকৌশলের কারণে, তাঁরা এখন সংখ্যালঘু।

ফলে, চিরায়ত আদিবাসী নিধন যা ইউরোপীয়রা আমেরিকায় কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে করেছিলো, পার্বত্য অঞ্চলে তেমনটা ঘটে নি। আদিবাসীরা আছে, কিন্তু সংখ্যালঘু করে দেয়া হয়েছে।

(৩) 
পার্বত্য অঞ্চলে এই নির্মূলকরণের বদলে কেনো সংখ্যালঘুকরণ?

এখানেই, আমার ধারনা "পুঁজিবাদ"। প্রথমে বৃটিশ মারকেন্টাইল পুঁজির প্রবেশ, পরে পাকিস্তানী আমলে, মার্কিন শিল্পপুঁজির (কাপ্তাই বাঁধ ইত্যাদি) ও পরে, একচেটিয়া পুঁজির প্রভাব। অর্থাৎ, এই অঞ্চলকে "ব্যাবসার" লক্ষ্য হিসেবে বিনিয়োগ ও বাজার বিবেচনা করে, ক্রেতাদের না মেরে, সংখ্যালঘু বানিয়ে, ক্ষমতাহীন করে রাখার কৌশল। মানুষ না থাকলে, বাজারও থাকবে না। ফলে আদিবাসীরা থাকুক "ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী" ও "ক্রেতা" হিশেবে, কাঁচামালের যোগানদার হিশেবে।

এর সাথে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে "আদিবাসিত্ব" (স্বশাসন ব্যাবস্থা, সংস্কৃতি) নির্মূলকরণও চলবে। কিন্তু সেটা "বাঙালিত্ব" দিয়ে নয়, "মুসলমানিত্ব" দিয়ে হবে। এই প্রক্রিয়ায়, আশা করা হচ্ছে, একদিন, এখানকার আদিবাসীরা, শারীরিকভাবে আদিবাসী থাকবে, চেতনায় "মুসলিম বাংলাদেশের নাগরিক" হয়ে যাবে।

রাঙ্গামাটিতে বিশাল মসজিদ নির্মাণ, মসজিদ ভিত্তিক সমাজের আহবান জানিয়ে বিলবোর্ড, আদিবাসী ছাত্রীদের হিজাব এবং "পাহাড়ে কন্দরে ইসলামের পতাকা" ওড়ানোর "সমঅধিকার" দাবির ঘটনা কিন্তু "বাঙালিত্ব" নয়।

পোশাকে খাবারে সংস্কৃতিতে "ইসলামী" ভাবধার মানে মরুসাম্রাজ্যবাদের উপস্থিতি। সাথে পুঁজিবাদের প্রভাবে, কোকাকোলা, ব্যাক্তিতাবাদ, পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা লাভের প্রযুক্তি আদিবাসী তরুণদের কাছে পৌঁছেছে। ফলে, ঢাকায় বা বিদেশে বসে যারা "উগ্রবাঙালি জাতীয়তাবাদ" নিয়ে চিন্তায় আছেন, তাঁরা আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের চিত্র নিয়ে আরেকটু ভাবুন।

(৪) 
এর সাথে পার্বত্য অঞ্চলে নারীর প্রতি সহিংসতার সম্পর্ক কোথায়?

এথনিক ক্লিনজিং, চিরায়ত (ক্লাসিকাল) ধারায় এখানে হচ্ছে না। এখানে, সংখ্যালঘুকরণ (সেটেলার দিয়ে), সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন (বনজ সম্পদ) এবং বাজার সম্প্রসারণের কাজ হচ্ছে। আদিবাসী প্রথা ঐতিহ্য মূল্যবোধ, সংস্কৃতি হারানো যদি এথনিক ক্লিনজিং হয়, তাহলে এটি সাংস্কৃতিক এথনিক ক্লিনজিং।

এর অংশ হিশেবে, আদিবাসী নারীদের "পর্দার" মধ্যে রাখতে হলে, কিছু উদ্যোগ দরকার। যেমন ছাত্রীদের পোশাক একটি।

কিন্তু আমি মনে করি না নারীদের প্রতি সহিংসতা কোনো "পরিকল্পিত" কাজ, যেটি সাংস্কৃতিক নির্মূলকরণের অংশ। আমি মনে করি না কেউ আদিবাসী নারীদের নিয়ে সহিংসতার কোনো "ষড়যন্ত্র" করছে, যেরকমটা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী করেছিলো।

কিন্তু, দুই মারমা সহোদরার উপর সহিংসতার ব্যাপারে, আগেই বলেছি, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আচরণ বিস্ময়কর। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার শীর্ষ ব্যাক্তিরা এই ধরণের অভিযোগ আমলে নিয়েছেন, ভুল স্বীকার করেছেন, অপরাধীর দায় নিয়েছেন এবং ক্ষমা চেয়েছেন। এখানে সেরকমটি ঘটে নি, ঘটলে সামরিক বাহিনীর লোকেরা প্রশংসিত হতো।

ব্যাপারটা কি এমন যে, পার্বত্য অঞ্চলে নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, কিন্তু এই মনোভাব কি আছে যে, "লেট ইট হ্যাপেন"। ভাবনাটা কি এরকম, "আমাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণ কেউ যদি এরকম কোনো কাজ করে, আমরা স্রেফ অস্বীকার করে যাবো।"

যদি তা হয়, তাহলে এর প্রভাব পড়বে, আদিবাসী নারীদের প্রকাশ্য চলাচল, পোশাক, পেশা, ইত্যাদি তথা সংস্কৃতির উপর। কেউ যদি এই মনোভাবকে "সাংস্কৃতিক নির্মূলকরণ" কৌশলের অংশ হিশেবে মনে করেন, "ষড়যন্ত্র তত্ত্ব" বলে তাঁদের ধারনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

(৫) 
বাংলাদেশে পাহাড়ে কিংবা সমতলে, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ নৃগোষ্ঠীর এবং শহরের কিংবা গ্রামের, সবক্ষেত্রেই নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ক্রমবৃদ্ধিমান।

আতঙ্কের ব্যাপার, ইদানিং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও "শিক্ষিত" কিছু ব্যাক্তিরাও, সরাসরি না হলেও পরোক্ষভাবে নারীর প্রতি সহিংসতাকে আড়াল করা, বৈধতা দেয়া, ইত্যাদি অবস্থান নিচ্ছে। এর ফলে, সহিংসতার মাত্রা আরও বেড়ে যাবে।

অনেক দিন ধরে, নানা রকম ভাবে, অনেকেই নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ কি আরও সংগঠিত উপায়ে সম্ভব, অহিংস ও নান্দনিক পন্থায়?

একই সাথে, পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যাবস্থায় কি এমন পরিবর্তন আনা সম্ভব যা ঘাতক-ধর্ষক-ব্যাটাগিরির বদলে মানবিক পুরুষ হওয়ার শিক্ষা পাবে? নারীর প্রতি সহিংস অপরাধের বিচারের দাবি অব্যাহত রেখেই, আমরা কি এই ধর্ষক ও কাপুরুষ তৈরির সামাজিক ব্যাবস্থাটি পাল্টানোর প্রক্রিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারি?

 

2674 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।