ছবির এই মেয়ে সম্পর্কে বলার আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে, আপনারা না চিনতে পারলেও সারা বিশ্বব্যাপী আমার মতন হাজার হাজার ক্রাশ আছে তার। আজকের এই লেখা তাদের জন্য যারা আমাকে নিয়ে হাসা হাসি করেন যে, নিজের পেটে ভাত নেই সামাজিক কাজ করি, হ্যাঁ আমি সামাজিক কাজ করি, নিজের অর্জিত টাকা দিয়ে, কারো দান নিয়ে আমি সামাজিক কাজ করি না। ভিক্ষাবৃত্তি দিয়ে আর যাই হোক সামাজিক কাজ হতে পারে না। আমার এই কথার জন্য অনেকেই বলেন আমি পাগল, হ্যাঁ ভাই(বোন) আমি পাগল। তো চলুন বিশ্বব্যাপী কিছু পাগল-পাগলীর মধ্যে থেকে আজ আমরা এক পাগলীর জীবন সম্পর্কে জানবো, যিনি আপনার জীবনে দেখা সব থেকে বড় পাগলী...
১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ ভারতের ইন্দোরের মহেশ্বরীর এক মাড়ওয়ারী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ছবির এই মেয়েটি। তার পিতা রাজকুমার মুচাল একটি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করতেন এবং মাতা অমিতা মুচাল একজন গৃহিনী । যখন বয়স মাত্র ৪ বছর তখন পারিবারিক একটি অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের গান গাইতে দেখে প্রথম মাকে বলেন আমিও গান গাইবো। চার বছরের ছোট্ট মেয়ে স্টেজে উঠে মাকে হতাশ করেন নি। তাই পরবর্তীতে তার মা তাকে সঙ্গীত স্কুলে ভর্তি করে দেন।
পরিবারের বড় সন্তান, মায়ের কাছে রাজকন্যার মতন বড় হতে থাকেন, তবে মেয়ে বলে কথা, ভারতের মতন একটি দেশে একজন মেয়ে বড় হওয়া চারটা খানি কথা নয়, তাই তাকেও সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা বাধার। কিন্তু যোগ্য মায়ের, যোগ্য কন্যা সকল বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন। মায়ের কাছে শুনেছেন, কি ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়, কি ভাবে মানুষের সেবা করতে হয়। মানুষকে ভালোবাসতে হয়।
আমি জানি আজকে আমার এই লেখা পোষ্ট হবার পরে এই লেখা অনেক শেয়ার হবে, অনেক সাংবাদিক নিউজ করবেন, কিন্তু আমি মনজুরুল ইসলাম মেঘ এই লেখা যে কত পরিশ্রম করে লেখেছি সেটার জন্য অনেকেই আমাকে পাগল বলে চালিয়ে দিবে। বাংলাদেশে এই মেয়েকে নিয়ে কোনো মিডিয়াই তেমন লেখেন নি, ছোট বিনোদন নিউজ হয়েছে কখনো কখনো, আর আমি সেই মেয়েকে নিয়ে বিষদ লিখছি, তার মানে আমি অবশ্যই পাগল। চলুন কিছু পড়ি...
১৯৯৯ সালে ভারতে শুরু হয় কারগিল যুদ্ধ, মেয়েটি পত্রিকা থেকে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং সৈনিকদের দুর্দশার কথা জানতে পারেন, মেয়েটির কোমল হৃদয় কেঁদে উঠলো। মেয়েটি ভাবলেন শুধু ঘরে বসে না থেকে তার কিছু করার উচিত। তখন একটি দানের বক্স নিয়ে দোকানে দোকানে গিয়ে সাত বছরের মেয়েটি বললো, “আমি আপনাদের একটি গান শোনাবো। বিনিময়ে আপনারা যা খুশি এই বক্সে দান করবেন।’’ মেয়েটি গান গেয়ে গেয়ে সেই সময়ে ২৫ হাজার ভারতীয় মুদ্রা সংগ্রহ করলেন এবং সুনির্দিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে সেটি জমা দিলেন। এই খবরটি স্থানীয় মিডিয়ায় ব্যাপক সাড়া পড়লে মেয়েটি সামনে চলার অনুপ্রেরণা পায় এবং ১৯৯৯ সালে ভারতের ওড়িশ্যায় সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্যও গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন তিনি।
মেয়েটি তার বাবা-মাকে তার ইচ্চার কথা জানালেন, তিনি গান গেয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন। তার এই ইচ্ছার কথা তার বাবা মা স্বানন্দে গ্রহণ করলেন।
২০০০ সালে ইন্দোরের একটি স্কুলের শিক্ষক তার স্কুলের "লোকেশ" নামের একজন হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসার জন্য মেয়েটির পরিবারের কাছে সাহায্যের জন্য আসলে মেয়েটি সেই “লোকেশ” এর জন্য গান গেয়ে ৫১ হাজার রুপি সংগ্রহ করেন, কিন্তু লোকেশ কে নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে কারডিওলজিস্ট “দেব প্রসাদ শেটি” লোকেশের বিনামুল্যে অপারেশন করেন।
মেয়েটির পরিবার বিপদে পেড়ে গেলেন এই অর্থ তারা কি করবেন? পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো যদি কোন হৃদরোগে আক্রান্ত শিশু চিকিৎসার জন্য আবেদন করেন তাহলে অর্থ দিয়ে সহায়তা করা হবে, আবেদন আসলো ৩৩ জন শিশুর, কিন্তু সেই টাকায় চিকিৎসা করা সম্ভব হলো মাত্র ৫ জনের। মেয়েটির বয়স তখন মাত্র ৮, আর তিনি সহায়তা করলেন গান গেয়ে ৫ জন হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুর সম্পূর্ণ চিকিৎসা ভার বহণ করে।
২০০৩ সাল, মেয়েটির বয়স তখন মাত্র ১১ আর তিনি প্রায় ১০০ জন শিশুর চিকিৎসা ভার একাই বহন করেছেন ততদিনে। মেয়েটির নাম আর না বলে চুপ করে থাকা ঠিক হচ্ছে না, মেয়েটির নাম “পলক মুচাল”। তিনি তার ছোট ভাইকে নিয়ে একটি স্টেজ শো- শুরু করলেন নাম দিলেন ‘দিল সে দিল তাক’। বাংলায় “হৃদয় থেকে হৃদয়ে”। আর ইংরেজীতে `Save Little Heart’. ভারতের পাশা পাশি তিনি এখন সারা বিশ্বে গান গেয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার ফান্ড সংগ্রহ করেন। ভাবছেন কত জনের চিকিৎসা করিয়েছেন? ৮ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখ পর্যন্ত তিনি গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করে বাঁচিয়েছেন ১৩৩৩ জন শিশুকে। আসছে ডিসেম্বরে ২০১৭ তে ধারনা করা হচ্ছে ২০০০+ এই সংখ্যা দাঁড়াবে।
একবার ভাবুন মাত্র ২৫ বছর বয়সী একজন মেয়ে সমাজের জন্য কত বড় কাজ করেছেন। এখন ভাবছেন সে শুধু ফান্ড করার জন্য গান গেয়েছেন, তাই মানুষ দান করেছেন। নইলো শুধু গান গেয়ে এত টাকা উপার্জন করা সম্ভব ছিলো না। তাহলে চলুন একবার তার সঙ্গীত ভবন ঘুরে আসি।
পলক মুচান ভারতীয় সঙ্গীত ভূবনে এক যুগন্তকারী আর্বিভাব, উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইতিমেধ্যেই তিনি বলিউডে স্থান দখল করে নিয়েছেন, প্লে-ব্যাক শিল্পী হিসাবে। তার গাওয়া “কাউন তুজহে” ইউটিউবে দেখা হয়েছে ১০,৮২,৪৩,০৭১+ (এই লেখা লেখার সময়) বার।
তিনি প্লে-ব্যাগ করেছেন - “এক থা টাইগার”, "রোস্তম" ও “বাহুবলি-দ্য বিগেনিং” সিনেমা এছাড়াও-
২০১১ সালে- “দামাদাম” “না জানি কাবসে”
২০১২ সলে “এক থা টাইগার” “ফ্রম সিডনী উইথ লাভ”
২০১৩ সালে “আশিকী ২” “পলুশগিরি” “জানজীর” “মিকি ভাইরাস” “আর রাজকুমার” ও “জয় হো”
২০১৪ সালে - “কারলে পায়ের কারলে”, “দিশকিয়ন”,“দি কপস”, “হুমসকালস”, “কিক”, “একশন জ্যাকশন”
২০১৫ সালে - “ইশকে পারিদে”, “গাব্বার ইস ব্যাক”, “ হেরো”, “কামোসিয়ান”, “মা.এক্স”,“বাহুবলী-দ্য বিগেনিং” “রুধারামদেভী”, “তোদা লুফ তোদা ইশক”, “উভা”, “লুকনউই ইশক”, “প্রেম রাতন ধান পায়ো”
২০১৬ সালে- “সনম তেরি কাসম”, “ইশক ফরেভার”, “সনম রে”, “জাব তুম খাও”, “অসাম মিউজিয়াম”, “কি এন্ড কা”, “ট্রাফিক”, “ডু লাভজোন কি কাহানী”, “লুভ ইউ আলিয়া” “রুস্তম”, “রাজ রুবট”, “এম.এস. ধনী : দ্য আনটোল্ড স্টরী”, “মমিরসা”।
২০১৭ সালে- “কাব্বী’, “ লাআলী কি সাআদী মেইন লাড্ডু দেয়ানা”, “সুয়েটি উডস এনআর আই”
২০১৮ সালে আসতেছে অ্যানিমেশন সিনেমা “আজোবা"।
এবার আসুন মেয়েটির প্রাপ্ত সম্মানা নিয়ে কথা বলি-
তার উল্লেখ্য যোগ্য সম্মাননার মধ্যে আছে, সামাজিক কাজে মহৎ কৃতিত্বের সুবাদে গিনেস বুক বিশ্ব রেকর্ড এবং লিমকা বিশ্ব রেকর্ড অর্জন।
ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি কৃষাণ কান্ত কর্তৃক রৌপ্য পদক বিজয়ী - জাতীয় শিশু পুরস্কার ব্যতিক্রমধর্মী অর্জনের জন্য (রাষ্ট্রীয় বাল পুরস্কার- ২০০০)
বিজয়ী সনি এন্টারটেইনমেন্ট টেলিভিশন (ভারত) টিভি অনুষ্ঠান ক্যাডবেরী বনভিটা কনফিডেন্স চ্যাম্পিয়নস (২০০৬)
এছাড়াও ভারতের সিবিএসসি এবং মহারাষ্ট্র শিক্ষা বোর্ড, সপ্তম শ্রেনীর নৈতিক বিজ্ঞানের পাঠ্য বইয়ে পলক মুচান এর কৃতিত্ব পাঠ্য বইয়ের অন্তভূক্ত করেছেন।
বিগ স্টার এন্টারটেইনমেন্ট অ্যাওয়ার্ডস -প্রেম রতন ধন পায়ো চলচ্চিত্রের শিরোনাম গানের জন্য বিগ স্টার মোস্ট এন্টারটেইনিং সিঙ্গার (ফেমেল) পুরস্কারও তিনি অর্জন করেছেন। এসব ছাড়াও তার আছে অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা।
ভাবতেছেন এত যার অবদান নিশ্চয় তিনি লেখা পড়া করেন নি। তার পক্ষে লেখা পড়া করা সম্ভব নয়। ভাই চুপ যান। পলক মুচান বর্তমান বিশ্বে এমন একজন ব্যক্তি, যিনি ১৭ টি ভাষায় গান গাইতে পারেন। আপনি যদি এই লেখা থেকে একটু মাত্রও অনুপ্রানিত হন তাহলে আমি মেঘ বলছি আপনিও পারবেন। শুধু চেষ্টা করুন আর নিজের কাজকেই ভালোবাসুন। সমাজে পাগল উপাধি পান, সমস্যা নাই। Everyone doing same, ingenious doing different.
পলক মুচাল তার ছোট ভাই পলাশ মুচাল কে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন "পলক মুচাল হার্ট ফাউন্ডেশন"। তার ছোট ভাই নিজেও একজন সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক। ২৫ বছর বয়সী পলক এত কিছুর মধ্যেও ইন্দোরের একটি ব্যবসায় কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বি.কম পাশ করেছেন।
যুগে যুগে জন্ম নিবে পলক মুচাল সেই কামনা করে শেষ করছি।