দুপুর থেকে অবিরাম ঝগড়া। থামাথামির কারবার নেই। মন খারাপ করে উঠোনের এক কোনে দাঁড়িয়ে ছয় বছরের পাখি। তার মা রাবেয়া মামীদের সাথে অনবরত তোয়াতুয়ি করছে।
বছরখানিক আগে পাখির বাবা লিভার সিরোসিসে মারা যায়। রাবেয়া তার রোগা স্বামীকে ভালো করার অনেক চেষ্টা করে। উপজেলা হাসপাতালে স্বামীর চিকিৎসার জন্য দিনের পর দিন পড়ে থেকেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি। স্বামী মারা যাওয়ার পর মা-মেয়ের সেই বাড়িতে ঠাঁই না মেলার কারণে চলে আসতে হয় বাপের বাড়ি।
রাবেয়ার বাবামা কেউ বেঁচে নেই। তারা চার ভাই, তিন বোন। সবার অভাব অনটনের সংসার। সুতরাং বাড়তি দুই পেট চালানো তো দূরের কথা আশ্রয় পর্যন্ত দিতে রাজী নয়। রাবেয়া চেয়েছিলো স্বামীর ভিটেতে মুখ কামড়ে পড়ে থাকতে। তা সম্ভব হয়নি। স্বামী ছাড়া এই সমাজে শ্বশুর বাড়িতে নিজের অধিকার নিয়ে টিকে থাকার মতো বাহুবল
রাবেয়ার নেই।
নির্যাতন আর অত্যাচারের মুখে সে হাপ্পা খেয়ে মেয়েকে নিয়ে ভাইদের সংসারে আসে। তাছাড়া রাবেয়ার ভরা যৌবন। তার গায়ের রং কিছুটা ময়লা হলেও বিধবা যৌবনবতী নারীর যৌবনই যে মহাশত্রু। দিশেহারা রাবেয়া আগ-পিছ চিন্তা না করেই ভাইদের সংসারে মেয়েকে
নিয়ে উঠে। মনে মনে ভাবে না খেয়ে থাকলেও অন্ততঃ ইজ্জত নিয়ে বাঁচতে পারবে।
আসলে বাস্তবতা বড়ই নির্মম। অভাবের কাছে পারিবারিক বন্ধন হার মানে। দিনকে দিন রাবেয়া ও তার মেয়ের জন্য এ বাড়ি অসহ্য হয়ে উঠে। অগত্যা পাড়ার এক চাচীর পরামর্শে মেয়েকে নিয়ে সে শহরে চলে আসে। শহর বলতে জেলা শহর। বস্তিতে থাকে। দুই বাসায় কাজ নেয়। বাসায় কাজ করা কালীন পাখিকেও সাথে নিয়ে যায়। পাখি বেশ শান্ত স্বভাবের। মা যা বলে তাই শোনে।
এভাবে রাবেয়ার দিন কাটলেও বস্তির অনেক পুরুষের তার শরীরের দিকে নজর পড়ে। রাবেয়াও বুঝে একজন পুরুষ ছাড়া সে নিরাপদ নয়। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে কেউ তাকে বিয়ে করতে রাজী হয় না। শেষে কিনা গাইবান্ধা থেকে আসা হোসেন রিক্সাওয়ালার সাথে ঠিক ঠিক একদিন রাবেয়ার বিয়ে হয়ে যায়। হোসেন বস্তিতে বাদাইম্যা হিসেবে পরিচিত। সে বলে তার বউ মারা গেছে; সন্তানাদি নেই। হোসেন যা বলেছে তার উপর বিশ্বাস করেই রাবেয়া বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়।
তারা বস্তিতে একরুম ভাড়া নেয়। মাঝখানে কোনোরকম একটা বেড়া। একপাশে পাখি আর অন্য পাশে রাবেয়ার সদ্য বিয়ে করা নাগর। পাখি আজ নীড়হারা। সে বুঝে গিয়েছে আর কখনো মায়ের কোল ঘেঁষে তার ঘুমানো হবে না। পাখির সৎবাবা তাকে সহ্যই করতে পারে না। নতুন বিয়ে করা বউ-এর সাথে যে একটু ইচ্ছেমতো ফূর্তি করবে তার উপায় নেই। কারন তাদের আবেশ আর আনন্দের উন্মত্ততায় পাখি একটা বিষমাখা কাঁটা।
বিকেল থেকে পাখির গা গরম। রাতে প্রচন্ড জ্বর আসে; একদমই ঘুম আসছিলো না। সৎবাবার ভয়ে মাকেও ডাকার সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু তাদের ফিসফিস কণ্ঠস্বর পাখির কানে আসছে।
কি ব্যাপার? তারা এতো নড়াচড়া করছে কেনো?? একসময় মায়ের জোরে জোরে নিঃশ্বাসের আওয়াজ তার কানে আসতে লাগলো। তার মা এমন করছে কেনো? মায়ের কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
সৎবাবা বিড়বিড় করে তার মাকে কি বলে?
অবুঝ বালিকার যে এখনও মানবের শিৎকারের ধ্বনি বুঝার বয়স হয়নি। অগত্যা উপায়-আন্তর না দেখে সে মাকে ডাক দিয়ে বসে এবং কান্না জুড়ে দেয়। রাবেয়া ধড়মড় করে উঠে যায় এবং দ্রুত কাপড় ঠিকঠাক করে মেয়ের কাছে ছুটে আসে। একই সাথে রতিক্রিয়ায় অতৃপ্ত হোসেন উন্মাদের মতো তেড়ে আসে পাখির দিকে। রাবেয়া বুঝে যায় হোসেনের মাথায় এখন আগুন। হোসেন পাখিকে অনবরত থাপড়াতে থাকে। রাবেয়া একটানে পাখিকে কোলে টেনে নেয়। তার আত্মজাকে হোসেনের উন্মত্ত মার থেকে রক্ষা করার জন্য আগলে রাখে। হোসেনের রাগ যেনো থামতেই চায় না। সাফ জানিয়ে দেয়, পাখিকে আর সে এ ঘরে দেখতে চায় না।
রাবেয়া মেয়ের মাথায় পানি ঢালে। এরপর মা-মেয়ে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে। পাখিকে নিয়ে সে কি করবে ভেবে পায় না। সারারাত অস্থিরতায় কাটে। মেয়ের মাথা মুছে আর কান্না করে।
পরদিন রাবেয়া কাজে যায়। সে যে বাসায় কাজ করে তাদের পুরো ঘটনা খুলে বলে। পাখিকে নিয়ে তার দূরবস্থার কথা জানায়। শেষে তাদের এক আত্মীয়ের বাসায় পাখির কাজের ব্যবস্থা হয়। যাক শেষে কিনা পাখির একটা গতি হলো। গৃহকর্ত্রীকে খালাম্মা, তার দুই মেয়েকে বড় আপু ও ছোট আপু এবং ছেলে দুটিকেও বড় ভাইয়া ও ছোট ভাইয়া
সম্বোধন করে।
তিন বছর পার হয়ে গেলো। রাবেয়ার কোল জুড়ে এখনও সন্তান আসেনি। সন্তান নিয়ে হোসেনের কোনো উচ্চ-বাচ্যও নেই। ওদিকে পাখি যে বাসায় আছে সে বাসার দুই আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলেটি বিদেশে থাকে। তাকে বিয়ে করানো হলো। নতুন বউকে পাখি 'ভাবী' ডাকে। রাবেয়া আর পাখিকে নিয়ে টেনশন করে না। পাখি সুখেই আছে। নতুন ভাবী পাখিকে বেশ আদর করে। ভাবীর হাজবেন্ড বিদেশে চলে যাওয়ার পর ভাবীর কক্ষে পাখি ঘুমায়; তবে ফ্লোরে আলাদা বিছানা পেতে। ঐ কক্ষে ঘুমালেও ভাবীর কড়া নির্দেশ যেনো লাইট না জ্বালায়।
পাখি এখন এগার বছরের বালিকা। সে টের পেয়ে যায় প্রতি রাতে তার প্রিয় ভাবী বিছানা ছাড়ে এবং আজান দিলে আবার বিছানায় আসে। একদিন সে কৌতূহলী হয়ে দেখে ছোট ভাইয়ের রুমে ডিম লাইট জ্বালানো। কাঠের দরজা শুকিয়ে যাওয়ার কারনে একটু ফাঁক হয়ে আছে। দুরু দুরু বুকে পাখি সেই ফাঁক দিয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করে।
হায়! হায়!
একি দেখছে সে! গা কাঁপছে। ভয়ও লাগছে!
কিন্তু কি অমোঘ আকর্ষণ। কেউ যেন তার চোখকে দরজার কাঠের ফাঁকে আটকে রেখেছে।
সারা শরীর জুড়ে অজানা শিহরণ!আলো আঁধারীতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরা দু’জন বিবস্ত্র নরনারীর গোপন রঙ্গখেলা। পাখির চোখ বিশ্বাসই করতে পারছিলো না তার ছোটো ভাই এবং প্রিয় ভাবী রাতের আঁধারে এমন কদাকার সম্পর্কে জড়াতে পারে! তার ভিতরে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। বাঘ যেমন নরমাংসের স্বাদ পেলে কখনও তেমনি এই মেয়েটিও দু’জন নরনারীর গোপন শরীরী খেলা দেখার সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না।প্রতি রাতেই চলে পাখির বাস্তবে নীল ছায়া-চিত্র দেখার অভিযান।
আজকাল দিনের বেলা তার মাথা ভার হয়ে থাকে। চিন্তা-চেতনা জুড়ে থাকে কেবলি সেইসব নিষিদ্ধ দৃশ্য। সে ভাবতে থাকে তবে কি দিনের আলোয় মানুষগুলো অভিনয় করে আর রাতের আঁধারে এসব অপকর্মে লিপ্ত থাকে!!
ছোট্ট পাখির হৃদয়টা এখনও সবুজ। তার এখনো বোঝার বয়স হয়নি যে মানুষ কখনো কখনো নিষিদ্ধ তৃষ্ণা নিবারনের জন্য কতটা ক্লান্তিহীন খেলারাম বনে যেতে পারে।
পাখি ধরা পড়ে গেলো। মাঝরাতে খালাম্মা ডাইনিং রুমে পানি খাওয়ার জন্য আসে। লাইট জ্বালালে দেখে পাখি দরজার সামনে উপুড় হয়ে আছে। তিনিতো হতভম্ব।তারপরের ঘটনা যেভাবে ঘটার সেইভাবে ঘটে গেলো। খালাম্মার কাছে সবকিছু খোলাসা হলেও ছেলের ভয়ানক রাগের কাছে তিনি অসহায়।তা ছাড়া নিজের সন্তান আর ছেলের বৌয়ের অপকর্ম কি করে ঢাকা দেবেন? বুঝতে পারছিলেন পাখি নির্দোষ।তারপরেও ছেলের প্রচন্ড নির্যাতন থেকে পাখিকে রক্ষা করতে পারলেন না।
পরদিন পাখিকে বিদায় করে দেয়া হলো।
হুমকি দিলো এসব কথা যেনো ভুলেও কাউকে না বলে। রাবেয়াকে বললো, তার মেয়েকে চুরির অপরাধে মার-ধোর করা হয়েছে এবং বাধ্য হয়ে বিদায় করতে হচ্ছে।
রাতে আবার পাখির জ্বর। রাবেয়া মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তিত। পাখি দেখতে আর আগের মতো নেই। এখনকার পাখি যথেষ্ট সতেজ। তাছাড়া রাবেয়ার চেয়ে পাখির গায়ের রঙ ফর্সা। বাসা-বাড়িতে কাজ করে সে এখন বেশ নাদুস-নুদুস। রাবেয়া সাধ্যমত মেয়ের সেবা করে। পৃথিবীতে এই মেয়েটিই এখন তার আপনজন। সে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে পাখিকে ভালো কোনো বাসায় কাজে দেয়ার জন্য।
ফিরতে আজ একটু দেরি হয়ে গেলো রাবেয়ার। ঘরে ঢুকতেই কেমন যেনো অস্বাভাবিকতা অনুভূত হলো। এককোনে জুসের খালি বোতল ও চকলেটের ছেঁড়া প্যাকেট।
একি!
তার পাখি গোঙাচ্ছে। চোখ খুলতে পারছে না। গায়ের জামা উপরে উঠানো।
পাজামা দিয়ে নিম্নাঙ্গ ঢাকা; কিন্তু পাজামাটি রক্তে ভেজা। প্রচন্ড ঘুমের ঘোরে থাকা পাখি চোখ মেলতে চেষ্টা করছে। কোনোভাবেই সে সফল হচ্ছে না। তারপরেও সে মা-কে বুঝাতে চাইছে যে তার সাথে অনেক খারাপ কিছু ঘটে গেছে।
রাবেয়া কাঁদতে কাঁদতে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হায় খোদা! কে করলো তার মেয়ের এই সর্বনাশ? পারলো না রাবেয়া এই পৃথিবীর দূভাগ্যপীড়িত বাস্তবতা থেকে পাখিকে রক্ষা করতে।
পারলো না রাবেয়া যৌনাকাঙ্ক্ষায় ছুটে বেড়ানো বহুগামী, বিকৃত, কামুক পুরুষের লালসা থেকে পাখিকে দূরে রাখতে!
কতক্ষন মাথায় হাত দিয়ে জিম মেরে বসে রইলো। শেষে সেই চাচীকে খবর দিয়ে আনলো। তিনি সব শুনে বললেন
-কি লো মাইয়া লইয়া বইসা থাকলে চলবো? তাইরে কইলাম ডাক্তার দেখান লাগবো, উঠ, আর কাউরে এইসব কতা কইতে পারবি না। তাড়াতাড়ি কর, আমিও যামু তর লগে।
মুহূর্তে রাবেয়া সব বঞ্চনা, দূর্বহতা, নিঃসঙ্গতা, দ্বন্দ্ব, ক্ষরণ ঝেড়ে ফেলে। সত্যিইতো মেয়েকে ডাক্তার দেখাতে হবে। মেয়েকে সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবে।
জগতে তার কেউ নেই, কিছু নেই না মন, না মাটি, না মানুষ কিন্ত তার সন্তান আছে। মা মেয়ে মিলে নতুনভাবে বাঁচবে তারা। তাদের যে বাঁচতেই হবে!
তবে সেদিনের পর থেকে হোসেন রিক্সাওয়ালাকে কেউ আর এই শহরে দেখেনি।