ও পাহাড়ি বন্ধুগো, বাজালিরে বাঁশিটি যাদুকরা বাঁশিটি, সুরেতে ভরিয়ে দিলি পাহাড়তলির রাতিটি,
আগুনরঙা জামাটি বিজলী রঙের চাদরটি আজিকে পড়িলি...
মেঘের বরণ ওড়নাটি এলোমেলো হাওয়ায় মেলে ঢেউ যে তুলিলি....
তবু কেনো দীর্ঘশ্বাস! চূড়ায় চূড়ায় নিঠুর বাতাস!
বুকের ব্যথা গোপন করে আর কতকাল থাকবি পড়ে!
চোখ মেলে দ্যাখ পাহাড় চূড়ায়
রাশি রাশি মুক্তো ছড়ায় সূর্য হাসিটি
আর প্রতিধ্বনি অমর করে মধুর মধুর ভোরের বাঁশিটি....।
ভুপেন হাজারিকার এই গানটি শুনলে মানসপটে এখন আর সবুজে ঘেরা পাহাড় ভেসে ওঠে না, দু’চোখে ফুটে ওঠে না পাহাড়ের কপালে সূর্যখচিত রক্তিম টিপ কিংবা কর্ণকুহরে ঝংকার তোলে না পাহাড়িয়া বন্ধুর বাঁশির সুমধুর সুর। কারণ-
পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় এখন শুধু নিঠুর বাতাস আঘাত হানে। ভোরের ঘাসে রাশি রাশি মুক্তোর পরিবর্তে সেখানে ছড়িয়ে থাকে কার্তুজের ধাতব খোসা, বাঁশির সুরের পরিবর্তে সেখানে শোনা যায় লোমশ হাতে মুখ চেপে ধরা পাহাড়ি নারীর গোঙানি। পাহাড়ে আজ আর সূর্যের হাসি নেই- শুধুই অন্ধকার কুষ্ঠ রোগীর পচন, লোভের উদ্যানে দেশপ্রেমের প্রতিদান সেখানে ভ্রুকুটির বিদ্যুতে ঝলসানো আতরের গন্ধমাখা গলিত লাশ, রক্তচক্ষুর সিপাহীর আত্মঘাতী শাসন- শোষণ, সেই শান্তিও নেই শান্তিতে সেখানে, শান্তি এখন ফেরারি বাতাস।
স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণের অবসান হবে এই আশায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে উপমহাদেশের সর্বস্তরের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীরাও অংশ নিয়েছিলো। ঔপনিবেশিক শক্তি বিতাড়িত হলেও ভাগ্যের শিঁকে ছিঁড়ে নি আদিবাসীদের। সব শ্রেণির জনগণের পাশাপাশি নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে তাদেরও মুক্তি আসে নি। বরং ব্রিটিশ আমলে পার্বত্যবাসীদেরকে যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিলো নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান তা কেড়ে ভূমিগ্রাস ও নিজভূমিতে ভূমিপুত্রদেরকেই পরবাসী করার প্রক্রিয়া শুরু করে।
১৯৫৩ সালে পার্বত্য চট্রগ্রামের বিশেষ মর্যাদা হরণ করার পর পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক অত্যাচার শুরু হয়ে যায় এবং বহিরাগতদের পরিকল্পিতভাবে পুনর্বাসন করিয়ে সংঘাত ও দাঙ্গার সৃষ্টি করা হয়। ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে ওই অঞ্চলের আদীবাসীদের ৪০ ভাগ আবাদী জমি ও বসতবাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে ওই অঞ্চল হতে উৎখাত করা হয় কোনরূপ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই। ১৯৬৩ সালের পর গণহারে বহিরাগত প্রবেশের ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। পুনর্বাসিত সেটলারদের নির্যাতনের শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক জুম্ম জনগণ ভারত ও তৎকালীন বার্মায় আশ্রয় নেয়ার ঘটনা এ জাতির জন্য বড় বিষাদময় স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বহিরাগতদের হামলা ও নির্যাতনের মুখে ১৯৬৪ সালে বাঘাইছড়ি, লংগদু ও বরকল অঞ্চল হতে ৪০ হাজার চাকমা মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। সেই সময় ২০ হাজার মারমাও বার্মায় আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৯৬৫ সালে নির্যাতন ও নিপীড়নের মুখে পার্বত্য অঞ্চলের আরো ২৫ হাজার আদিবাসী ভারতে পালিয়ে যায়।
১৯৭১ সালে দেশ ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে চাকমা রাজার আহ্বানকে উপেক্ষা করে পাহাড়ি জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর বাহাত্তরের সংবিধানে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার নিশ্চিত হলেও পাহাড়ি জনগণের সুরক্ষায় কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি, অবসান হয় নি তাদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন ও বঞ্চনার। এ প্রেক্ষাপটে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ জুন মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্রগ্রাম জনসংহতি সমিতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তৎকালীন সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির কয়েক দফা আলোচনা হয়। কিন্তু আলোচনা সুনির্দিষ্ট রূপ নেওয়ার আগেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আমূল পরিবর্তন ঘটে পাকিস্তানি ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং পার্বত্য অঞ্চল সম্পর্কে সরকারী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে ব্যাপকভাবে। আদিবাসীদের জায়গাজমি দখল ও নির্যাতনের মাধ্যমে তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন ও বহিরাগতদের পার্বত্য অঞ্চলে এনে পুনর্বাসিত করা হয়। এর পরেও যারা মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকেন তারাও নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় শুরু হয় তিন পার্বত্য জেলায় সশস্ত্র সংঘাত। ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে সেটলার ও সেনাবাহিনীর হামলা, নিপীড়ন-নির্যাতনে ৫ হাজার আদিবাসী ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করে। ভারত সরকার তাদেরকে পুশব্যাক করলেও পরবর্তীতে ফিরিয়ে দেয়া হয় নি তাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া জমি। এমনকি তাদেরকে পুনর্বাসনেরও কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি।
১৯৭৯ সালে পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে নিরাপত্তা অভিযানের অজুহাতে ২০ হাজার জুম্মকে হত্যা করা হয়। ১৯৮৬ সালে পানছড়ি, খাগড়াছড়ি ও মাটিরাঙ্গা হত্যাকাণ্ডের পর হাজার হাজার আদিবাসী বাস্তুভিটা ছেড়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৯৮৯ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবার আদিবাসী উৎখাতের ঘটনা ঘটে। সেই সময় পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে নির্বাচিত সাংসদ ও বাংলাদেশের তৎকালিন রাষ্ট্রপতির উপজাতি (!) বিষয়ক উপদেষ্টা উপেন্দ্রলাল চাকমার ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়া থেকেই প্রমাণ হয় আদিবাসীদের ওপর চালানো হামলা কতটা ভয়াবহ ছিলো।
১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত কয়েক লক্ষ আদিবাসী সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হয়। ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী অনেককে ফেরত আনা হলেও কাউকেই পুনর্বাসন করা হয় নি। দীর্ঘদিনের অত্যাচার, বৈষম্য, বঞ্চনা, ভূমি থেকে উচ্ছেদ, সশস্ত্র সংঘাত সেখানে আদিবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানকে দূর্বল করে দিয়ে সহায় সম্বলহীন করা হয়েছে। বিভিন্ন আদিবাসী এলাকার জরীপে দেখা যায়- ১৯৪৭ সালের পর থেকে জরীপের সময়কাল পর্যন্ত তাদের ৮০ শতাংশ জমিই হাতছাড়া হয়ে গেছে। ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ আদিবাসী।
জনসংখ্যার হিসেবে ১৯৫১ সালে পার্বত্য চট্রগ্রামে আদিবাসী ও বাঙালির আনুপাতিক হার ছিলো যেখানে ৯১ঃ৯, তা উচ্ছেদ, হত্যা ও দেশান্তরীর মাধ্যমে কমতে কমতে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫১ঃ৪৯ এ।
১৯৯৭ সালে পার্বত্য জেলার দীর্ঘদিনের সমস্যা ও সশস্ত্র সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয় বহুল আলোচিত ও প্রতীক্ষিত শান্তিচুক্তি। পাহাড়ি আদিবাসীরা আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হলেও চুক্তির শর্ত বাস্তবায়নের তেমন কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় নি। সেসময় বিরোধীদলে থাকা বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া চুক্তির বিরোধিতা করে ঘোষণা দিয়েছিলেন- পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে চুক্তিটি বাতিল করবেন। ২০০১ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে চুক্তিটি বাতিল না করলেও পাহাড়িদের ওপর বহুমাত্রিক নির্যাতন আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়।
২০০৩ সালে রূপন মহাজন নামে এক স্থানীয় যুবকের অপহরণকে কেন্দ্র করে মহালছড়ির ৯টি আদিবাসী গ্রামে নেমে আসে বিভীষিকা। চংড়াছড়ি গুচ্ছগ্রামের সেটলার বাঙালিরা একত্রিত হয়ে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে একের পর এক গ্রামগুলোতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। তাদের এই তাণ্ডব চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। ওই হামলায় ৬৩টি বাড়ী ভস্মীভূত হয় ও নিহত হয় ৮ মাস বয়সী চিজিডুয়া চাকমা সহ ৯ জন আদিবাসী। হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিদসংযোগ করেই হামলাকারীরা ক্ষান্ত হয় নি, তাদের দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয় শান্তিবালা চাকমা, বনিতা চাকমা, খুকী চাকমা (১২), অমিতি চাকমা (১৫), গীতাঞ্জলী চাকমা (১৪), মায়ালক্ষী চাকমা (৩০), কালাসোনা চাকমা (৩৫), বাদীমিশা চাকমা (৩০), চিক্কাল চাকমা (২০) ও মীনা রাণী চাকমা (২০)। এছাড়াও অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যায়। আশ্চর্যজনকভাবে দিনব্যাপী এই মধ্যযুগীয় বর্বর হামলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সেনা সদস্যদের উপস্থিতিতে চললেও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।
লেখায় যেসব ঘটনার উল্লেখ্য করেছি তা মূলত পার্বত্য চট্রগ্রামে সাত দশক ধরে চলমান নিপীড়নের খন্ডচিত্র মাত্র। সেখানে দীর্ঘকালব্যাপী বঞ্চনা ও নির্যাতন-নিপীড়নের চিত্রটা আরো অনেক গুণ ভয়াবহ, যেন একাত্তরের পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদেরই আরেক রূপ যা আজও চলমান। অল্প কিছুদিন পূর্বে দুই মারমা তরুণীকে যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের ঘটনা এবং পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, রাষ্ট্রের নীরবতাও একই অর্থ বহন করে।
এদেশে বারবার রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল হলেও বদল হয় নি পাহাড়িদের ললাট লিখন, বন্ধ হয় নি ভিটেমাটি হারিয়ে ঘুমন্ত শিশু সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ভয়ার্ত মায়ের অনিশ্চিত পদযাত্রা। জানি না তাদের এই যাত্রার অবসান কোথায়! কবে পাহাড়িরাও বলতে পারবে- 'এই মাটি, এই দেশ আমার, আমাদের!
*তথ্যসূত্র- প্রদীপ মালাকার, নিমচন্দ্র ভৌমিক ও বাসুদেব ধরের লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ।