জাকারিয়া হোসাইন

অনলাইন একটিভিস্ট ও হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডার।

প্রসঙ্গ : নারীদের জন্য পাবলিক টয়লেট জরুরি কেনো?

আমাদের বাড়ী গ্রামে। গাইবান্ধা জেলার প্রত্যন্ত এলাকায়। যে গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। শিক্ষা নেই। অধিকাংশ গ্রামবাসীই অশিক্ষিত। কদাচিৎ যারা শিক্ষার আলো পেয়েছেন তারা শহরের কোথাও যায়গা নিয়ে বসতি গড়েছেন। ঈদ কিংবা ভোটের সময় তারা গ্রামে আসেন। বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ কিনে ব্যাগে না নিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে আসেন। শহরে ভ্যানগাড়ি থেকে আধাপোয়া মরিচ কিনলেও গ্রামে এসে ব্যাগ ভর্তি মরিচ ছাড়া তাদের চলেই না।


কিন্তু এই গ্রামে একটি জিনিশ খুব লক্ষণীয়। হিংসা। খুব অভাব কিংবা অন্য কী কারণে এই হিংসা তা আজও বুঝি নি। পরিবারের কোনো সদস্য শহরে থাকেন, গ্রামের বাড়ীকে সেমিপাকা করেছেন। বাড়ীর টয়লেট আধুনিক করেছেন। কিন্তু অধিকাংশ গ্রামবাসী আজও খোলা মাঠে, ঝোপঝাড় কিংবা নদীতীরেই টয়লেটের কাজটি সেরে নেয়।

আমাদের বাড়ীতে যে টয়লেট ছিলো সেটার অবস্থা ছিল এমন; চারকোণে চারটি বাঁশের পিলারে চটের বস্তা আটকানো, সম্মুখে খোলা। সেখানে বসলে সামনের দিকের চটটি হাত দিয়ে ধরে রাখতে হয়। বাতাসে উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব। তাই।

এই টয়লেটে ছেলেরা নির্বিঘ্নে যেতে পারতাম। আমি এবং বাবা। মা এবং বোনরা টয়লেটে গেলে আমি অথবা বাবাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। লোকজন রাস্তায় এলে কাশি দিয়ে এলার্ট করে দিতাম। তারপরও যে বিড়ম্বনা হয় নি, এমন নয়। মা বলতেন, বড় হয়ে যেন রাস্তাঘাটে মানুষের জন্য পাবলিক টয়লেট বানিয়ে দেই।

রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে আমাদের হাগু তো লাগেই, পিশু লাগে সবচেয়ে বেশি। পিশু চাপলে রাস্তায়/গলিতে কিংবা ড্রেনে দাঁড়িয়ে যাই। চেইন খোলো, কাজ উদ্ধার করো। হাগু লাগলে টয়লেটেই যেতে হয়, তাই আমি যেখানেই যাই না কেনো; স্থানীয় পাবলিক টয়লেট কোথায় আছে সেটা আগে জেনে নিই। কিন্তু একজন মেয়ে আপনার আমার মতো যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যেতে পারে না। যে সমাজে ধর্ষণ হলে বিশ্বাস করা হয়; "নারীর বেপর্দাই ধর্ষণের কারণ" সেখানে রাস্তায় একটি মেয়ে কাপড় সরিয়ে হাগুপিশু করছে দেখলে কী অবস্থা হবে জ্ঞানীজন বুঝতেই পারছেন।

মনে পড়ে গেলো, সাঈদি রাজাকারের রায় ঘোষণার পর বরিশাল থেকে আসছিলাম। বাগেরহাটের অনেক আগে থেকেই গাড়ী ঢিমেতালে এগুচ্ছে। এক মিনিট চলে তো দুমিনিট দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে হরতালযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো সে কারণেই এই সমস্যা। এমন সময় ফুফু জানালেন তার টয়লেট লেগেছে। সুপারভাইজারের অনুমতি নিয়ে দৌড়ে গেলাম রাস্তা থেকে কিছুদূর দূরের একটি বাড়ীতে। বাড়ীতে কেউ আছেন? বললেও সাড়া পেলাম না। কিন্তু টয়লেট ঠিকই আবিষ্কার করলাম। বাসে ফিরে এসে ফুফুকে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে টয়লেট দেখিয়ে দিলাম। বাড়ীওয়ালা মহিলাকে আসতে দেখেই ক্ষমাপ্রার্থনা করে সমস্যা জানালাম। এ যাত্রায় বেঁচে গেছি।

কিছুদিন পূর্বে ভাগনীকে নিয়ে যাচ্ছিলাম নার্সারি ক্লাসে ভর্তির জন্য। লেগুনায় উঠেই মা জননী জানালো, মামা পিশু করবো। লেগুনা থেকে নেমে এদিক সেদিক খোঁজ করে টয়লেট পেলাম না। অগত্য রাস্তার পাশে ঢালু যায়গায় নেমে পিশু করে নিতে বললাম। পথিকদের দৃষ্টি আমি বুঝেছি। আমিও পথিক।

গত তিনদিনে পত্রিকা/ফেসবুকে দেখছি নারীদের জন্য নির্মিতব্য টয়লেট ভেঙে ফেলছে মাদ্রাসার ছাত্ররা। মেয়েদের জন্য মানেই মায়েদের জন্য। এই বোধটুকু মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে নেই। ওদের মানবিক বোধ শেখানো হয় না। হুজুরের কথামত চলো, দুনিয়াতে জেহাদি হও, আখেরাতে হুরপরি পাও। একেকজন বাহাত্তর পিস!

বাঙলাদেশের রাস্তাঘাটে হুজুর/তালেবইলমরা যত টাকা দান সদকা পায়; তার ৯০% মেয়ে/মায়েরা দেন। মাদ্রাসাভবন নির্মাণ হবে, ছাত্রদের জন্য ইস্তিঞ্জা খানা তৈরি হবে। মা-বোনেরা দান করুন। পরকালে এর প্রতিদান পাবেন। পরকালের আশায় দান করলেন, ইহকালে কিছুই পাবেন না। কিন্তু বজ্জাত হুজুররা আপনাকে আমাকে শান্তিতে থাকতে দিবে? দিবে না। নারীরা থাকবে ঘরের কোণে। আতুরঘরে। তাদের রাস্তায় বাহির হতে হবে কেনো? তাইজন্যে রাস্তাঘাটে তাদের টয়লেট নিস্প্রয়োজন! নিমকহারাম এই তালেবানরা কখনো ভেবেও দেখে না; ওদের আবাসন, মসজিদ, ওজুখানা কিংবা পেশাবখানাটা যে টাকায় তৈরি হয়েছে, তার অধিকাংশ টাকাই এসেছে রাস্তায় চলাচলকারী নারীদের কাছ থেকে।

3400 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।