রোকেয়া তসলিমা

লেখক, এক্টিভিস্ট।

অসহিষ্ণুতার চরম সীমায় দেশ ও সমাজ

ছোট্ট একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। বছর পাঁচেক আগের কথা। বাসে শহর থেকে রওনা হয়েছি বাসার উদ্দেশে। শহরে গিয়েছিলাম বিশেষ এক জরুরি কাজে। প্রায় প্রতি মাসেই দু-তিনবার ব্যক্তিগত কাজে আমাকে শহরে যেতে হয়। যাই হোক, যথারীতি সন্ধ্যার পরপরই বাস ছেড়ে দেয় গন্তব্যের উদ্দেশে। বাস চলছে তো চলছেই। কিছুদূর চলে আসার পর একটা বিষয় গভীরভাবে লক্ষ্য করলাম। বাসের কোনো হেলপার যাত্রীদের কাছে ভাড়ার জন্য আসছে না। ভাবলাম আরো একটু পরে বোধহয় ভাড়া চাইতে আসতে পারে। কিন্তু না, যাত্রীদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে, কেউ কোনো ভাড়ার জন্য আসে নি। আমি সিট ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাঁকডাক করতে থাকি। অনুরোধ করি বাসের ভাড়া নেওয়ার জন্য। ছেলে বয়সী এক ছোকরা বলে উঠলো, আপনাদের সবার ভাড়া দেওয়া হয়ে গেছে! এ কথা শোনামাত্র বাসের সব যাত্রী তো নির্বাক! রীতিমতো অবাক হয়ে গেলো! দু’য়েকজন চোখ কপালে তুলে বললো, ওমা!

আমাদের এত মানুষের ভাড়া পরিশোধ করল কে? তখন ছেলে বয়সী ছোকরাটি আঙুল দিয়ে বাসের এক কোণে বসে থাকা এক ভদ্রলোকের দিকে নির্দেশ করলো। বাসের সবাই তাজ্জব হয়ে গেলো। মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক সিটে হেলান দিয়ে তখনো চোখ বুজে আছেন। যাত্রীদের হই-হুল্লোড় ও কথাবার্তায় তিনি চোখ মেলে খুব সাধারণভাবেই তাকান। নিরাসক্ত একটা ভাব। এমন একটা ভাব করলেন, যেন অবাক হওয়ার মতো সে রকম কিছুই ঘটে নি। বাসভর্তি যাত্রীদের ভাড়া পরিশোধ করার মতো অতি মামুলি ঘটনাও যেন পৃথিবীতে আর নেই! যেন এসব ঘটনা অহরহ হচ্ছে। লোকটি সম্পর্কে আমার কৌতূহল অনেকাংশে বেড়ে যায়। কিন্তু তার সাফ কথা, তিনি এই বিষয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলবেন না। তার মন চেয়েছে, সবার ভাড়া দিয়েছেন। ব্যস এটা নিয়ে কারো কোনো প্রকার ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। সুতরাং এই বিষয়ে তিনি একটি শব্দও কারো সঙ্গে শেয়ার করতে রাজি নন। অনেক পীড়াপীড়ি শেষে হাসিমুখে শুধু নামটি বললেন, শাহজাহান।

আমি দুষ্টুমি করে বললাম, আপনি কোন শাহজাহান? সম্রাট নন তো! যিনি ভালোবেসে স্ত্রীর জন্য ভালোবাসার তাজমহল বানিয়েছেন?

লোকটি আমার কথা শুনে শিশুর মতো হো হো করে হেসে ওঠে। হেসে ওঠে বাসের সব যাত্রীও। কিন্তু ওইটুকুই শেষ। আর একটি শব্দও তার মুখ থেকে বের করতে পারি নি। কিছুদূর যাওয়ার পর লোকটি বাস থেকে নীরবে নিভৃতে নেমে রাতের অন্ধকারে মিশে গেলেন।

এখন মূলবক্তব্যে আসা যাক-

আজকের সমাজে চরমভাবে মানবিকতার আকাল চলছে। আমাদের সমাজ আজ অস্থির ও অসহিষ্ণুতার চরম সীমায় চলে গেছে। মানুষের মধ্যে নেই কোনো মায়ামমতা, নেই কোনো নীতিনৈতিকতা ও নেই মানুষ মানুষের প্রতি মূল্যবোধ। মমত্ব ও মানবতাবোধের অন্যতম প্রতীকে অমানবিকতার গন্ধ তালাশ করাটা হবে এক ধরনের বাতুলতা। অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ ভালো ভালো শব্দগুলোর জায়গায় অমানবিতার কালোছায়া পড়ছে। মানুষ অতিমাত্রায় হিংসা, রূঢ় হয়ে উঠেছে, কারন হলো বৈষম্যতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মান্ধধতা।

ফলে মানুষের মন থেকে মায়া, মমতা, মহানুভবতা, মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্ববোধসহ মানবিকতা দিনে দিনে মুছে যাচ্ছে। উপরের ছোট্ট ঘটনাটি আজকের প্রতিক্রিয়াশীল অসহিষ্ণু ও অসুস্থ সমাজের জন্য এক বিরাট উদাহরণ হতে পারে। শিক্ষাও বলা যায়। সত্যিকারে মহৎ মানুষগুলো বরাবরই ত্যাগে আনন্দ পায়। ভোগ-বিলাসিতা, রসনাবিলাসী জীবনযাপন তাদেরকে সামান্যতম স্পর্শ করতে পারে না। কারো জন্য কিছু করার মাঝেই তারা সত্যিকারের সুখ বা আনন্দ খুঁজে পায়।

অথচ সমাজে এ ধরনের মানুষগুলোর সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। অসত্য, ধর্মান্ধতা ও অমানবিকতা দেশটিকে অনেক বেশি অসহিষ্ণু ও অস্থির করে তুলেছে। অথচ কতিপয় এ ধরনের ভালো ও সৎ সাম্যবাদী মানুষগুলোই পারে অসুস্থ ঘুণে ধরা সমাজটার খোলনলচে পাল্টে দিতে। যাবতীয় অশান্তি দুঃখ-কষ্ট দূর করে তারাই পারে শান্তির চাষাবাদ করতে।

কিন্ত পরিতাপের বিষয়, এই সাম্যবাদী, ভুলকে ভুল বলা মানুষ গুলো এই দেশে সমাজে থাকতে পারছে না। কারণ এই দেশে সমাজে ধর্ম অনুভূতি এটোম বোমার চেয়ে বেশী মারাত্মক অস্ত্র। এখানে যৌক্তিকতা নেই, নেই নিজের জ্ঞানে চাষাবাদ। আছে কেবল রূপক গাল গল্পে অন্ধ বিশ্বাস!

লক্ষ্য করলে আমাদের দেশে সমাজে এ ধরনের উদাহরণ আরো থাকতে পারে। তবে তা অতি অল্প। এ জগত বড় বিচিত্র। আরো বিচিত্র এ জগত সংসারের মানুষগুলো। একেকজন একেকরকম। চিন্তা, চেতনায় ও বুদ্ধি-বিবেচনায় সবাই ভিন্ন ভিন্ন। সামান্য কারণে আজকের দেশ ও সমাজের মানুষগুলো মারমুখো ও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। কারণ, ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা সমাজের পরতে পরতে দানা বেঁধে আছে। মানুষও হয়ে পড়েছে অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়াশীল। মানুষ সামান্য তুচ্ছ স্বাভাবিক ঘটনায়ও প্রতিক্রিয়া দেখায়। একটা দেশ ও সমাজকে ধ্বংস করার জন্য এই প্রতিক্রিয়াশীল মানুষগুলোই সবচেয়ে বিপজ্জনক।

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য' -ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠের ঐতিহাসিক লাইন দু’টি আজকের অসহিষ্ণু দেশ ও সমাজে কাগুজে খচিত কয়েকটি শব্দ বৈ আর কিছুই নয়। মাখলুকাতের আশরাফুল মাখলুকাত শ্রেষ্ঠ মানুষ ধর্মই তো বলে। মানুষ মানুষই, পশু নয়।

অথচ তারপরেও নিজের স্বীয় সত্তাকে বিসর্জন দিয়ে দিন দিন অসহিষ্ণু ও হিংস্র হয়ে উঠেছে কেনো ধর্মান্ধরা? কেনো স্লোগান তুলে - নাড়েয় তাকবীর, আল্লাহ হু আকবার!

ওহ মুক্তমনা ওরে মার!

ওহ নাস্তিক ওরে মার!

ওহ মালাউন ওরে মার!

ওহ কাফের ওরে মার!

ওহ নারীবাদী ওরে মার!

ওহ সাম্যবাদী ওরে মার!

তারমানে কি মুক্তমনা, নাস্তিক, মালাউন, কাফের, নারীবাদী এবং সাম্যবাদী এরা মানুষ নয় ধর্মান্ধতার দৃষ্টিতে? এ কেমন ইশ্বর? যে মুসলিম মুসলিম ভাই, বাকি সব মার!

আপসোস, সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষের মানবিকতার বৈশিষ্ট্যগুলো চরমভাবে লোপ পাচ্ছে। দেশে ও সমাজে হিংসা, হানাহানি, নৈরাজ্য, দুর্বৃত্তপনা, লুণ্ঠন, আহাজারি, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা ও ধর্ষণসহ নানাবিধ অসুস্থ উপসর্গ ঘুণে ধরা পোকার মতো গোটা দেশ ও সমাজকে গিলে খাচ্ছে এই ধর্মান্ধ ইশ্বরবাদীরা!  

সীমাহীন অসুস্থতা ও রুগ্নতার বেড়াজালে আটকে আছে সমাজ। এ ব্যাপারে সমাজের সবার দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই বদলাতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের আলোকেই রূপক গল্পের ধর্ম, প্রচলিত অভিনশ্বর ইশ্বর ও জর্জরিত বাধার প্রাচীরগুলো ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। 

সুস্থ-সুন্দর ও ন্যায়নিষ্ঠ মানবিক দেশ সমাজ গড়ার জন্য এটি খুব জরুরি বিষয়। এখনই সময় নিজেদের বদলে নতুন করে কাজ শুরু করার। আমাদের দেশ ও সমাজকে বদলাতে হবে। মানবিকতার যে দৈন্যদশা চলছে, তা থেকে দেশ ও সমাজকে বাঁচাতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে মানবিকতাকে।

আমাদের এখন আর পেছনে ফিরে তাকাবার সময় নেই। এগিয়ে যেতে হবে জোর কদমে।

বদলানোর কাজটা সবার আগে শুরু করতে হবে নিজেকে দিয়ে। নিজে বদলালে সমাজ বদলাবে। বদলাবে সমাজের প্রতিটি মানুষ। সমাজ বদলালে বদলাবে রাষ্ট্র।

সমাজকে বদলে দেওয়া কারো একার পক্ষে সম্ভবপর নয়। সহজ কথায় অসম্ভব। এখানে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের ছোট ছোট সন্তানরাই এই দেশ ও সমাজের আলো-বাতাসে একদিন বেড়ে উঠবে। আমরা ওদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি? আমরা এমন কোনো অসুস্থতার বীজ এই দেশ ও সমাজে বপন করতে পারি না, যা এক সময় মস্তবড় বিষবৃক্ষে পরিণত হবে। তখন নিশ্চিতভাবে কোমলমতি সন্তানরা ক্ষমা করবে না আমাদের। বরং ঘৃণার বিষ উগরে দিয়ে বারংবার অভিসম্পাত করবে। কৃতকর্মের জন্য মুহুর্মুহু ধিক্কার দেবে।

সুতরাং জেনেশুনে এমন কোনো কাজ আমরা করতেই পারি না। 

তাই আসুন, মানুষ হিসেবে আমরা অধিক মানবিক হই। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কাল্পনিক গাল গল্পের ইশ্বর গুলোকে এবং ধর্ম গুলোকে প্রত্যাখ্যান করি। মানবিকতার যাবতীয় গুণাবলী দিয়ে সমাজটাকে দেশটাকে সুসজ্জিত ও শোভিত করে তুলি। ভালোবাসাময় একটি স্বপ্নিল সুন্দর শাশ্বত সমতার দেশ ও সমাজ গঠনে আসুন ঝাঁপিয়ে পড়ি। 

একে একে হারিয়ে যাওয়া মানবিকতার গুণগুলোকে ফিরিয়ে আনি। পাশাপাশি প্রজ্জোলিত আলোর রোশনাই দ্বারা সব পঙ্কিলতা ও অসত্যের আঁধারকে চিরতরে দূরীভূত করি।

জয় হোক মনবতার

নিপাত যাক ধর্মান্ধতা।

আমি মানুষ, আমি অতীত ভবিষ্যৎ বর্তমান 

ইশ্বরতো কাল্পনিক নাম মাত্র।

1547 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।