অপ্রিয় কথা

লেখক একজন নারীবাদী, ব্লগার এবং অনলাইন একটিভিস্ট।

ধর্মভক্তি থেকে পুরুষতন্ত্রকে নমো নমো, নারী স্বাধীনতার প্রধান শত্রু মুর্খ নারীরাই!

ইদানিং নারীবাদ নারীবাদ, শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে এক বিশ্রী রকম বিরক্তি এসে গেছে। আমার অনেক বন্ধু (মেয়ে) পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে চিল্লাইতে চিল্লাইতে মনে হয় অনেক কাহিল হয়ে পড়েছে। তাদের প্রতিবাদ হল পুরুষতন্ত্রের বিরূদ্ধে কয়েকটা জ্বালাময়ী শব্দ ব্যবহার করা। ব্যস ঐটুকুই প্রতিবাদ! এদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। বিরোধী দলের নেত্রী একজন নারী। বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে এই দুইজন নারী-প্রধানের অবস্থান দেখে পশ্চিমা দেশের কোনো সভ্য নাগরিক হয়তো ভেবে বসবেন, -বাংলাদেশে নারী-স্বাধীনতা বোধহয় ঝরে ঝরে পড়তেছে। বাংলাদেশের নারীরা বোধহয় পশ্চিমা নারীদের থেকেও অধিক স্বাধীন অবস্থানে রয়েছে। কারন বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নারীই দেয়। পশ্চিমা নাগরিকরা কিন্তু এটা ভেবে বসবে না যে, এই দুজন নারী বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পেরেছেন নিজের যোগ্যতায় নয়, একজন বাপের যোগ্যতায়। আরেকজন স্বামীর যোগ্যতায়। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে তাদের বাপ আর স্বামী মৃত্যুর পর এই দুজন নারী পরিবারভিত্তিক, অনেকটা জনগনের অনুকম্পা পেয়ে বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান হতে পেরেছিলেন। এরা জার্মানের প্রধানমন্ত্রী এঙ্গোলা মরকেল কিংবা অংসান সুচির মতো দুর্গম পথ পেরিয়ে আসেনি। এরা সোনিয়া গান্ধী ও বেনজীর ভুট্টোর মতো পরিবার সুত্রে পাওয়া বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রধান হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

তো যা বলতে চাচ্ছিলাম, -এই দুইজন নারী এদেশে দুই দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়। তাদের নাকের ডগায় অসংখ্য সুযোগ ছিল, দেশে নতুন নতুন আইন করে নারীর অধিকারটা আরো বাড়ানোর। কিন্তু তাঁরা সেইদিকে নজর দেননি। তারা নজর দিয়েছেন, ৯০% মুসলমানের ভোট কার ভাগে বেশি করে আনা যায়, তা নিয়ে সবসময় রাজনৈতিক মাঠ গরম করেছেন। দলীয় কর্মীদের একেক সময় কুত্তার মতো লেলিয়ে দিয়েছেন, কখনো জ্বালাও পোড়াও করতে, কখনো সহিংস হামলা করতে, কখনো চাঁদাবাজি করতে। কেউই এদেশের অধিকাংশ নিপীড়িত নির্যাতিত নারীগুলোর কথা ভাবলো না। এই দুইজন নারী ক্ষমতার লোভে পড়ে ইসলামতন্ত্রের প্রতিযোগীতার পেছনে লাগামহীন দৌঁড়ে ছিলেন।

গত বৈশাখী মেলায় ঢাকার টিএসতে মানুষের ভীড়ে এতোগুলা মেয়েকে যৌনাক্রম করা হল, তা নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে উচ্চবাচ্য করতে দেখলাম না। উল্টো কিছু নারী আন্দোলনের নেত্রীকে বলতে দেখলাম, এসবের জন্য নাকি নারীর নাভির নিচে শাড়ী পড়া, টাইট ফিট জিন্স-টপ পড়া, হালকা পোশাক পড়াই দায়ী। মেয়েদের এসব খোলামেলা পোশাকই পুরুষকে উত্তেজিত করে। মেয়েদের ধর্ষন করার জন্য পুরুষকে উদ্ধুত্ত করে। কি অসভ্য চিন্তা ধারা! কোথায় যৌনাক্রমকারী পুরুষের বিরূদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আওয়াজ তুলবে তা না, তারা দোষ দিচ্ছেন উল্টো যৌনাক্রমের শিকার হওয়া মেয়েটির পোশাককে! কতোখানি ইতর আর আত্নমর্যদাহীন হলে এসব অসভ্য কথা একজন নারী নেত্রীর মুখ থেকে বের হয়?

রাষ্ট্রের কথা দুরেই রাখলাম, আমাদের আশে পাশের সমাজ-পরিবারের দিকে তাকালেই বোঝা যায় নারীরা আসলে নারী স্বাধীনতার জন্য কতটা বাধা।

-মেয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় তার মা বলে দিচ্ছেন বখাটেরা টিটকারি দিলেও সেই কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে যেন বাড়ি চলে আসে।
-মেয়ের বুকের ঢেউ বড় হচ্ছে, তাই মা মেয়েকে শাঁসিয়ে বলছে বুকে ওড়না পড়তে।
-মেয়ে বড় হয়েছে, ডাগর হয়েছে। কোনো মানুষের নজরে পড়ার আগে মায়ের নজর কাড়ছে আগে। তাই নির্দিষ্ট শিকল বেঁধে দিচ্ছে মা। হিসেব করে মেয়েকে ঘরের চৌকাঠ ডিঙোতে দিচ্ছে।

মেয়ের শরীর বড় হচ্ছে। মা দর্জির দোকান থেকে খুব যত্ন করে সেলাই করে আনছে মেয়ের জন্য বস্তার মতো কালো বোরখা। জোর করে মেয়ের ইচ্ছের বিরূদ্ধে গিয়ে তার গায়ে চাপিয়ে দিচ্ছে কালো বোরখা, হিজাব, নেকাপ।

ছেলের বেলায় কোনো কড়া নিয়ম নেই। মেয়ের বেলায় অজস্র নিয়ম বেঁধে দেয় তার প্রিয় জননী। স্কুল থেকে, কলেজ থেকে, প্রাইভেট থেকে একটু দেরি করে ফিরলে, মেয়েকে অজস্র প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়। তা কিন্তু ছেলের বেলায় হয়না। তো পুরুষতান্ত্রিকতা কে বেশি ধারণ করছে? প্রশ্রয় দিচ্ছে কারা? মায়েরা না বাবারা? যে পুরুষতন্ত্রের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা ধর্মের নিয়মগুলো নারীদের মনে সহস্র সহস্র বছর ধরে ভক্তি ও শ্রদ্ধার জায়গা করে নিয়েছে, সেখানে নারীদের মুক্তি কোথায়? এখনো পৃথিবীর অধিকাংশ নারী পুরুষতন্ত্রকে (ধর্মকে)পরম ভক্তি সহকারে নমো নমো করছেন। এখনো অনেক অনেক নারী তার স্বামীকে ধর্মের দিক দিয়ে পতিদেবতা ও আল্লার দান এক টুকরো জান্নাত মনে করে। এখনো অনেক নারী মনে করে পুরুতন্ত্রের বিপরীত স্রোতে যাওয়া মানে রীতিমত পাপ! স্বামীর স্বেচারের বিরূদ্ধে যাওয়া মানে পাপ! মানে ঈশ্বর নারাজ হবেন! চিন্তা করি এই নারীগুলোকে নিয়ে পৃথিবীর সভ্যতা কতোখানি এগিয়ে যাবে?

মুল বক্তব্যঃ পুরুষতন্ত্রের বিরূদ্ধে কয়েক লাইন বিদ্ধেষপুর্ণ কথা বললেই পুরুষতন্ত্র তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েনা। নারী স্বাধীনতার প্রধান শত্রু নারীরাই। শাশুড়ি তার পুত্রবধূকে বলে দিচ্ছে ওখানে যাবেনা, এখানে যাবেনা, পর পুরুষের সাথে কথা বলবেনা। বাইরে গেলে ঘোমটা দাও, বোরখা পরো হিজাব পরো। সবসময় নত হয়ে চলো। তো পুরুষতান্ত্রিকতায় ভরা ধর্মের শিক্ষাগুলো মেনে নেয় বেশি কারা? পুরুষতান্ত্রিকতা টিকিয়ে রেখেছে কারা? আল্লামা শফী নারীদের কোনঠাসা করে রাখার জন্য প্রকাশ্যে এতো বক্তৃতা দিল, নারীকে ঘরে রাখার জন্য। "নারীকে শুধু ৫ম শ্রেনী থেকে বেশি পড়ানো উচিত নয়। নারীর কাজ শুধু ঘরে বসে বসে বাচ্চা পয়দা করা। তাদের বাইরে গিয়ে কাজ করা কোনোভাবেই উচিত নয়, নারী শরীর ঢেকে না চললে তেঁতুল বলা ইত্যাদি।" অথচ এই আল্লামা শফীর বক্তব্যের বিরূদ্ধে একাট্টা হয়ে দাঁড়িয়ে গার্মেন্টসের লক্ষ লক্ষ মেয়ে শ্রমিকরা কোনো প্রতিবাদই করলো না! শফীর বিরূদ্ধে মেয়েদের একটা আন্দোলনের জনসমুদ্র হতে পারতো। কিন্তু হলো না! অথচ একটু গভীরে গিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এই লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টএর মেয়েদের ঘামঝড়ানো অমানুষিক কায়িক শ্রমের অর্থ সরকারী রাজস্ববোর্ড-এ প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা জমা হচ্ছে। আর সেই অর্থ দিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষার নামে সহয়তা পাচ্ছে আল্লামা শফীরা। সোজা কথায় বললে, এখনো গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঘামঝরা অর্থগুলো আল্লামা শফীদের গায়ে রক্ত হয়ে বয়ে চলছে। তাদের আরাম আয়েশে থাকার নিশ্চয়তা দান করছে। কিন্ত মেয়েগুলো কেমন বোকা বুদ্ধু! কেউ শফীর বিরুদ্ধে দাঁড়ালোই না।

পুরুষতান্তিকতা এখনো টিকে আছে মেয়েদের অতিমাত্রায় ধর্মের প্রতি ভক্তির জন্য, কোনো পুরুষের গায়ের জোরের জন্য নয়। যেখানে অধিকাংশ পরিবারের মায়েরা নিজের কন্যা-সন্তানদের পেছন থেকে শিকল ধরে টানছে, সেখানে নারী স্বাধীনতা মুক্তি পাবে কি করে? এটা অসম্ভব! আগে পরিবর্তনটা মায়েদের কাছ থেকে আসতে হবে, তারপর পরিবার থেকে আসবে, আর একেকটি পরিবার আসলে সমাজ রাষ্টের নারী-পুরুষের বৈষম্যের কাঠামো আপনা আপনিই পাল্টে যাবে। পাল্টাতে বাধ্য!

3313 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।