অপ্রিয় কথা

লেখক একজন নারীবাদী, ব্লগার এবং অনলাইন একটিভিস্ট।

লিঙ্গ কর্তন করলেই কি অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে? আমাদের ঘাটতি টা কোথায়?

চুরির জন্য হাত কর্তন, ধর্ষণের জন্য লিঙ্গ কর্তন করলেই কি অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে? এসব ভয়ভীতি দেখালেই কি অপরাধীর সংখ্যা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হবে? আমার উত্তর না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এতোটা অপরিপক্ক ও ভঙ্গুর যে, যেখান থেকে প্রতি বছর বের হয় হাজার হাজার অসুস্থ প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষার্থী। উচ্চ নম্বর পাওয়ার জন্য, একটি সার্টিফিকেট অর্জন করার জন্য রাত-দিন জেগে পড়াশুনা করা ছাড়া আর কিই বা ঢুকানো হয় আমাদের শিক্ষার্থীদের মননে? যে ছেলেটি ভালবাসে একজন ফটোগ্রাফার হতে, তাকে তার পরিবার থেকে বলা হয়, বাপ তোকে যে করে হোক, ডাক্তার নয়তো ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। যে মেয়েটির মনে স্বপ্ন ছিল একজন জার্নালিস্ট হবার, তাকে পরিবার থেকে বলা হয়, মামনি তোমাকে যে করেই হোক একজন ব্যংকার হতেই হবে।

 

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থীর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মেজিস্ট্রেট, ব্যারিস্টার, প্রফেসর, প্রভাষক, ব্যংকার, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ.... হবার সুযোগ থাকলেও কিন্তু সেই শিক্ষার্থীর মানুষ হবার সুযোগ খুবই কম। আমরা শিক্ষার্থীদের মানুষ করার জন্য কতখানি শিক্ষা বিন্যাস্ত করেছি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়? কতোখানি মানবিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছি আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে? শিক্ষার্থীদের মননে কতোখানি মানুষ, মনুষ্যত্ব ও মানবিক বীজ বুনতে সক্ষম হয়েছি আমরা? বা আদৌ পেরেছি কি?

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় তো দুরের কথা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক-পাঠ্য-পুস্তকে এখনো যৌন শিক্ষাটা দারুনভাবে অনুপস্থিত! আর যৌন শিক্ষাকে আমাদের শিশুর কাছে একেবারে করে ট্যাবু করে রাখা হয়। এই যেন নিষিদ্ধ কোনো শিক্ষা। এই যেন ঔষদের মতো ভয় দেখিয়ে বলার মতো, -শিশুদের নাগালের বাইরে রাখুন! যৌনশিক্ষা কেন ট্যাবু হবে? এই শিক্ষা কেন ছোটকাল থেকে প্রতিটি শিশুকে দেয়া হয় না? সঙ্গম, সেক্স, মিলন, সহবাস, মৈথুন..... এই শব্দগুলো মানুষের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। এটা কেন আমাদের ছোটকাল থেকে বলা হয় না? এটা কি নিষিদ্ধ কোনো গন্ধম? এটা মানব জীবনের বাইরের কোনো অংশ? অবশ্যই না। এই তো কয়েকদিন আগে এক নিউজে পেয়ে ছিলাম, এক মেয়ে ধর্ষিতা হবার আশংকা থেকে ব্লেড দিয়ে ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে দিয়েছে। এতে আমরাও খুব আনন্দিত হয়ে মেয়েটির প্রতিবাদের সাথে সামিল হই। এক ধরণের পৈচাশিক আনন্দ লাভ করি। আমিও পৈচাশিকভাবে উল্লসিত হয়ে ঐ নিউজ টি আমার টাইম লাইনে শেয়ার করেছিলাম এই বলে যে, "এটাই তো হওয়াচায় নারী!" আচ্ছা নারীরা ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে দিলে অপরাধী সংখ্যা কখনো কমবে?

শোনা যায়, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, নিউজিল্যান্ড, স্লোভানিয়া এসব দেশে অপরাধের সংখ্যা তুলনামুলক ভাবে অনেক কম। যে দেশগুলোতে অপরাধীর অভাবে রাষ্টপক্ষকে প্রতি বছর বছর জেলখানা বন্ধ করে দিতে হয়। তবে কি তারা ধর্ষণের লিঙ্গ কর্তন, চোরের হাত কর্তন করে এই অপরাধের সংখ্যা কমিয়ে এনেছিল? তাদের জনগনের অপরাধ প্রবনতা কমিয়ে এনেছিল? তাই যদি হয়, তাহলে বর্বর শরীয়া আইনের দেশ সৌদি আরবও পৃথিবীর বুকে একটা অপরাধহীন দেশের মডেল হতো। সৌদি আরবের মধ্য যুগীয় নিয়ম-কানুনে ভরা শরীয়া ব্যবস্থা দিয়ে প্রকাশ্য লোকালয়ে চোরের হাত কর্তন, হত্যাকারী খুনি ঘাতকের শিরোচ্ছেদ করেও কি তাদের জনগনের অপরাধ রোধ করতে পেরেছে? না কখনো পারেনি। এতে অপরাধীর সংখ্যা কমেছে? না কমেনি, বরঞ্চ দ্বিগুন বেড়ে চলেছে। তবে কেন নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, নিউজিল্যান্ড, স্লোভানিয়া এসব দেশগুলো তে চুরি, খুন, ধর্ষণ হত্যা এসব তুলনা মুলক ভাবে কম? তার তো অবশ্যই কারণ আছে। তাই না? তার কারণ তাদের শেখানো হয়, কোনো নারীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে যৌনাক্রম করে ধর্ষণ করা, এটা অন্যায়! এটা অপরাধ! চুরি করা, ছিনতাই করা, ডাকাতি করা, অন্যের ধন-সম্পত্তি লুট করা, মানুষ হত্যা করা, কারো উপর জোরপুর্বক নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়া এটা অপরাধ, ঘোরতোর অপরাধ!

আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ভাবে নারী বিষয়ক (অধিকার বলব না, নারীর অধিকার কি এই মর্ম তারা এখনো বুঝেনা) কথা বলার জন্য যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, বা যারা নারী আন্দোলনের নেত্রী বলে গনমাধ্যমে সুপরিচিত, এমনকি শিক্ষামন্ত্রী সাহেবও ধর্ষণকে ডিফেন্স করেন মেয়েদের পোশাক দিয়ে। তারা মনে করেন ধর্ষণের জন্য মেয়েদের পোশাকই দায়ী! তাই তারা পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেন, ও' তে ওড়না, ব'তে বোরখা, হ'তে হিজাব। মানে মেয়ে তুমি ওড়না দিয়ে তোমার বুক ঢাকো, বোরখা দিয়ে বস্তা বন্দী হও! এটা কি সঠিক শিক্ষা? মেয়েদের পোশাকের মধ্যে দোষ খুঁজে উলটো একটা ধর্ষকের অপরাধকে প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করা নয় কি? একটা ধর্ষককে সরাসরি প্রশ্রয় দেয়া নয়কি? ঠিক আছে মেনে নিলাম, ধর্ষক ধর্ষণ করেছে। প্রতিদিনই এদেশে কোনো না কোনো স্থানে দুই তিনটা ধর্ষণ সংঘটিত হয়। প্রতিদিন যদি তিনটে করে হিসেব করি, তাহলে বছরে ধর্ষণের সংখ্যা হাজারটা ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু এই পর্যন্ত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বছরে কয়জন ধর্ষকের বিচার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে? কয়জনকে যাবতজীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছে? আর যে গুটি কয়েকজন ধর্ষকের বিচার হয়েছে, তা কি উল্ল্যেখ করার মতো?

কয়েকদিন আগে যে মেয়েটি ধর্ষণের আশংকা থেকে ব্লেড দিয়ে ধর্ষকের লিঙ্গ কেটে দিয়েছে, এই নিউজ পেয়ে আমরা যারপরনাই আনন্দ লাভ করেছিলাম। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে প্রায় সবার মধ্যে এক আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। এই যেন এক ধর্ষকামীকে দমন করার জন্য আরেক মর্ষকামীর উদ্ভব! একটা অপরাধকে দমনের জন্য আরেকটা অপরাধের জম্ম দেয়া। আগেও আমার অনেক লেখায় বলেছি পাঠ্য বইয়ে যৌনশিক্ষা অন্তর্ভুক্তির কথা। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্টবিজ্ঞাণ, সমাজ-বিজ্ঞাণ, কৃষি-বিজ্ঞাণ, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান থাকলেও, কিন্ত আলাদা করে যৌনবিজ্ঞানের কোন সাবজেক্ট নেই। অথচ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এটা থাকা অত্যন্ত জরুরী। যে যৌনতা মানুষের জীবনের বিরাট একটা অংশ। সেই যৌনবিজ্ঞান থেকে জানা যেতো আসলে যৌন ব্যবহার কি?

--ব্লগের শিরোনাম ছিল, "ধর্ষণের জন্য লিঙ্গ কর্তন করলেই কি অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে? আমাদের ঘাটতি টা কোথায়?" আসলে আমাদের চরম ঘাটতি টা হল শিক্ষা ব্যবস্থায়! যে শিক্ষা আমরা যুদ্ধ পরবর্তী দেশে আমাদের আগের প্রজম্ম, আমাদের তরুন প্রজম্ম, আর যারা নতুন প্রজম্ম বেড়ে উঠছে, তাদের মননে যৌনশিক্ষা, যৌনশিক্ষার ব্যবহার কি ঠিক সময়ে পৌঁছে দিতে পারিনি। ধুর! এগুলি আমি কোন দেশে বসে লিখছি? কাকে বলছি? যে শিক্ষামন্ত্রী নারীর প্রতি প্রতিটি পাতায় পাতায় অপমান, অসম্মান, গ্লানিকর, অসভ্য ও অন্ধকারে ঠাসা পবিত্র গ্রন্থের মধ্যে নৈতিকতার শিক্ষা খুজে পান, আমি কি সেই শিক্ষামন্ত্রীকে বলছি? যে প্রধানমন্ত্রী একজন নারী হয়ে ধর্মান্ধ, শিশুকন্যা লোভী মৌল্লাদের খুশি করার জন্য অনেক আগের "বাল্য বিবাহ বিরোধী আইন"কে শীতল করে পুনরায় এক ফুৎকারে "বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭" সংসদে পাশ করে ফেলেন, আমি কি তাঁকেই বলছি এইসব যৌনশিক্ষা প্রসারের কথাগুলো?

যারা চায় ধর্মান্ধতা মানুষের মধ্যে বেঁচে থাক। মানুষকে যতবেশি মুর্খ অশিক্ষিত ধর্মান্ধ রাখা যায়, ততবেশি বেশি লাভ তাদেরই। মানুষ শিক্ষা দীক্ষায় সভ্য ও সচেতন হলে তো সমস্যা। তাদের অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে, তাদের গনতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। ধর্ষন না হলে তো আর ইনিয়ে বিনিয়ে মৌল্লাদের পক্ষে সাফাই গাওয়া যাবেনা। ধর্ষণ হলেই ভালো! তবেই তো বলা যাবে, মেয়েটির পোশাক ঠিক ছিলনা। মেয়েটি ধর্মীয়ভাবে পোশাক পরিধান করেনি। বোরখা গায়ে চাপায়নি। কে যেন বলেছিলেন, "শিক্ষায় জাতির মেরুদণ্ড" আসলে কথাটা শতভাগ সত্যি। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীরা যুগে যুগে আমাদের মাঝে এমন শিক্ষার বার্তা দিয়ে এসেছেন যে, আমরা দিন দিন এক অসভ্য মুর্খ মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিনত হচ্ছি। আমরা লিঙ্গ কেটে প্রতিবাদ করেছে দেখে পৈচাশিক আনন্দ লাভ করছি! বাহ! কি দারুনভাবে মর্ষকামীকে বৈধতা দিচ্ছি!

3069 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।