অপরাহ্ণ সুসমিতো

জন্মের শহর : সিলেট। বেড়ে ওঠা : সিলেট, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম। স্কুল জীবন থেকে লেখালেখির শুরু, কবিতা আর রবীন্দ্রনাথকে ভালবেসে । ক্লাস নাইনে পড়ার সময় মনে হয়েছিল বিপ্লব করবেন তাই নামের আগে যুক্ত করেছিলেন ‘আসাবিক’ অর্থাৎ ‘আমি সারকারখানা স্কুলে বিপ্লব করবো’। কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্য পত্রিকায় লেখালেখি চলছিল । গদ্য পদ্য দুটোতেই দৌঁড়-ঝাপ । আবৃত্তি খুব প্রিয় বলে কাব্যের সুষমা, শব্দ-উপমা, চিত্রকল্পের বেসুমার লাগামহীন টানের কারনেই হয়তো আলাদা করে রাখে অপরাহ্ণ সুসমিতোকে, স্নিগ্ধতায়। যদিও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি ও কানাডায় প্রোগ্রামিং নিয়ে পড়াশোনা কবিতার রম্য প্রেম থেকে তাকে আলাদা করে রাখতে পারেনি । লালমনিরহাটে বছর পাঁচেক ম্যাজিস্ট্রেসি করেছেন, ত্রাণ মন্ত্রণালয়েও কিছুদিন। এখন কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে একটা সেল ফোন কোম্পানীতে কাজ করছেন। লেখালেখির বাইরে আবৃত্তি, অভিনয়, টেলি-জার্ণাল, বড়দের-ছোটদের নিয়ে নানা রকম সাংস্কুতিক কর্মকান্ডে সমান আগ্রহ । এক সময় গ্রুপ-থিয়েটার করতেন । একটা শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছেন । কাব্যগ্রন্থ : তুমি পারো, ঐশ্বর্য (২০১০), রাষ্ট্রপতির মতো একা (২০১৪) গল্পগ্রন্থ : চিড়িয়াখানা বা ফেসবুক ও অন্যান্য গল্প (২০১৬) প্রবচনগুচ্ছ : মিরর (২০১৬)

ভয় করিনি তিরস্কারে

রোদ আমার প্রিয়। এই একটা জিনিস আমার সাথে থাকে, ছায়া দেয়। দৌড়ালে আমার সাথে দৌড়ায়। কুকুরের মতো জিভ বের করে জিরোলে ছায়াও চুপ করে বসে থাকে। রোদ যখন বাঁধতে আসে আমি তখন হাসতে থাকি।

 

 

মা বলেন আমার জন্ম অভ্র রোদেলা দিনে। তখন সারা দেশে খরার অগ্নি বর্শা। নলকূপেও পানির আকাল,নদীর স্রোত মৃদুবায়। আমি তখন মায়ের পেটে। মা ভরাট তলপেট নিয়ে ২ মাইল দূর থেকে কলসি কাঁখে করে পানি আনে। তীব্র তেষ্টায়, শ্রান্তে মা আমার বাড়ির দাওয়ায় বসে প্রাণ হায় হায়।

তখনি আমার সুদর্শন বাবা আমাদের রেখে পালালেন। বাবা যাত্রা দলের অধিকারী। সারাবছর সর্দি ঠান্ডার ধাত, গলায় মাফলার পেঁচিয়ে থাকতেন। ফ্যাসফ্যাসে গলা। সকাতরে ধূর্ত টাইপ মানুষ। গৌরনদীতে এক শীতে যাত্রা শো করতে গিয়ে আর ফিরলেন না। আগে যাত্রা দলের নাম ছিল নিউ মালতী অপেরা। বাবা নাকি যাত্রা দলের প্রধান নায়িকাকে বিয়ে করে দলের নাম পাল্টে রাখলেন নিউ নিউ মাধবী অপেরা।

 

মা খরার সমুদ্রে আরো ভুবনহারা হলেন। আমাদের ঐ ছোট্ট ঘরটি হয়ে যায় আরো মরিচীকা মরুপ্রান্তর। মা আমাকে নিয়ে ভরাট পেটে মাতম করেন। বিচারের আশায় একবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে যান, একবার থানার ওসির কাছে। কাজের কাজ কিছু হয় না।

 

জানি নাই গো সাধন তোমার কারে বলে ভাবতে ভাবতে আমি জন্ম নিলাম লাট সাহেবের মতো। না আসলেও চলতো, তবু মায়ের পেটে লাথি মেরে মেরে টুপ করে এসে পড়লাম। আমি ধূলোয় বসে খেলে নিজেকে মেখে মেখে মাটিতে গড়াগড়ি করে অপুষ্টি বড় হতে থাকলাম। সম্পত্তি কিছু নেই মায়ের। আছে অসীম কর্মী শরীর। কিছুদিন অবোধ মা বাড়ি বাড়ি কাজে নেমে পড়লেন। তেমন কিছু লাভ হয়নি। কাজ যা হয়েছে সাময়িক খিদে মিটেছে।

 

মা আবার স্মুদলি গর্ভবতী হলেন। মা তখন এক বাম নেতার বাড়িতে কাজ করতেন। নেতা মাকে শ্রেনীহীন সমাজের কথা বলে বলে আপন করে নিলেন। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী নিয়ে কথা বলতে বলতে মাকে গর্ভবতী করলেন। লাভের লাভ তো হলোই না উলটো মাকে লাথি মেরে বের করে দিলেন। আমি একটু একটু বড় হতে থাকলাম সাধন করে করে। ভয় করি নাই অন্ধকারে।

 

ব্র্যাক স্কুলের এক আপা আমাকে আদর করতেন কেন যেন। আমাকে খাবারের বিনিময়ে ভর্তি করিয়ে দিলেন ওনার সকালবেলাকার স্কুলে। আপাটা সুতা দিয়ে একটা ডিম অর্ধেক করে দিতেন। দুপুরে অর্ধেক আর রাতে বাকী অর্ধেক ডিমটা খেতাম।

 

আমি বড় মাথা নিয়ে গোঁত গোঁত বড় হতে থাকলাম। পড়াশুনায় মোটামুটি ভালো বলে সবখানে পাত্তা পেতে থাকি। নিরীহ গাধা টাইপ। কেউ কেউ ধরে মারলে চুপ করে থাকি, মাথা নিচু করে থাকি। বাড়িতে এসে মাথা নিচু করে পাটিগণিত করি। ম্যাডাম আপা মাঝে মাঝে পুকুর ধারে বসে গান করেন। আমি সামন্ত রাজাদের ইতিহাস পড়তে পড়তে একলা কাঁদি। কান্নার বিষণ্ণ মন্দিরা টুপটাপ বইয়ের পাতায় পড়তে থাকে।

 

কোনো কোনো দিন আকাশ ক্ষীণ করে বৃষ্টি বন্দী নামে আমাদের বাড়ির নড়বড়ে চালে। ভিজে যায় এই মঞ্জিল। লাউয়ের ডগার মতো বাড়তে থাকি। টুলটুল করে বেড়ে যেতে থাকে আমার মাথা, শরীর ঝংকার। ভালো ছাত্রত্বের ছন্দে আমি পাশের টরকী হাই স্কুলে ভর্তি হই। হেডস্যার আমাকে স্নেহ করতেন। বেতন মওকুফ করে দিলেন। তখন আমার ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর দশা।

হেডস্যারের মেয়ে নীল অঞ্জনা সারাক্ষণ রিগার্ডের ত্রিফলা তেল মাথায় দেয়, সবুজ ফিতা দিয়ে কলাবেণী করে চুলে। সাধারণ মেয়েদের তুলনায় নীল অঞ্জনার হাতের লোম ঘন, বড়। কি যেনে মেখে রাখে হাতে। আমাকে দেখলে খিলখিল করে হেসে দেয়। একদম বেদেনী চুড়ির মতো শঙ্খিনী। আমি মাথা নিচু করে ওকে দেখি। লাজ লাগে, দোল লাগে, পুলক লাগে।

 

রাত বাড়লে মশারির নিচে বাড়ি বেড়ার ফাঁক গলে আলোতে দেখি মায়া মায়া হেডস্যারের মেয়ে, হয়তো কৈশোর লাবণ্য স্বপ্ন। অস্তিত্বটা সত্যি নয়। মেয়েটা মায়াবী পর্দায় শরীর দোলায়। বালিশ চেপে ভাবতে থাকি যে ধ্রুপদ তুমি আমাকে বাঁধছ, আমি তোমাকে বাঁধব।

কী যে তান লাগে আমার। বড় হতে থাকি টানে, বড় হতে থাকি।

 

এসএসসি পরীক্ষার ঠিক আগে একদিন সাহস করে হেডস্যারের সামনে গিয়ে বলে ফেললাম;

: স্যার নীল অঞ্জনাকে বিয়ে করব।

 

হেডস্যার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন যেন যদি তারে নাই চিনি সে কী !

অদ্ভুত যাত্রা ভঙ্গিতে খন খন করে উঠলেন;

: বাহ বাহ। খুব ভালো কথা। আমার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়া দেই আর আমার মেয়ে তোমারে নিয়া যাত্রায় রঙ মাইখা কোমর দুলাইয়া নাচ করতেছে। সবাই টিকেট কাইটা আমার মাইয়ার কোমর দুলা নাচ দেখতে আসবে।

: বাহ বাহ.. চল আইজকে কাজী ডাকি। এই ফকিরের বাচ্চার লগে বিয়া দেই আমার কলিজার টুকরা..

 

বাইরে টরকী স্কুলের রোদের শিহরণ। আড়িযাল খাঁ নদীর পাশ ঘিরে ঘাটে জামাল মিয়ার লঞ্চ ভেঁপু বাজাচ্ছে। ছাড়বে ছাড়বে বলে লোকজন তাড়াহুড়ো করছে। কাঠের সিঁড়ি এখনো পাড় থেকে সরায়নি।  

প্রাক বিকেলের তেরসা রোদ এসে পড়ল আমার লাবণ্যহীন মুখে।

2364 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।