আঞ্জুমান রোজী

লেখক

অমর একুশ, আমার একুশ

একুশে ফেব্রুয়ারি; একটি দিন। উনিশ'শ বায়ান্ন'র একটি দিন। সেই দিনটিকে আমরা বাঙালি চেতনার শক্তি দিয়ে বয়ে নিয়ে যাই সময় থেকে সময়ান্তরে। রক্তরাঙানো সেই দিনটিতে লেখা হয়েছিলো বাঙালির বর্ণমালা। চিরভাস্বর সেই বর্ণমালা আমাদের ললাটের লিখন হয়ে গেলো, হলো অমলিন। কিছু বলতে হয় না; কিছু করতে হয় না; কারো কাছ থেকে কিচ্ছু শুনতে হয় না! অথচ- রক্তে কেমন একটা টান এসে যায়। তারই টানে আত্মহারা  হয়ে আমরা বাঙালিরা- এই দিনে একাকার হই। আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে সবরকম আয়োজনে উঠেপড়ে লাগি। উদ্দেশ্য একটাই; মিলনমেলা! যেখানে বাংলাভাষা এবং বাংলার অক্ষরগুলো মুক্তির আনন্দে নেচে-গেয়ে হেসে উঠবে।

যদিও আমাদের  জীবনযাপনের  দৈনন্দিন কার্যক্রমে বাংলাভাষা আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে শুধু নয়; চিন্তা-চেতনায়, মননে-মগজে শেকড় গেড়ে বসে আছে। তারপরেও  উনিশ'শ বায়ান্ন'র  একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি; বাংলাভাষা অর্জনের দিন। বাঙালি অস্তিত্বের পুনর্জাগরণের দিন। বলতে গেলে সেদিন থেকেই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত। বলতে পারি সেদিনই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হলো। সেই দিনের গুরুত্ব বহুলাংশে অপরিহার্য। সেই দিনটি ভুলে যাবার নয়, কোনো অবস্থাতেই নয়। একে হৃদয়ে মগজে ধারণ করেই কালের যাত্রায় পা রেখে চলে যেতে হবে, রেখে যেতে হবে উত্তরসূরির জন্য পদচিহ্ন। যে চিহ্ন ধরে তারাও হেঁটে যাবে।

অনেকের মুখে শুনি; এসব দিন পালন করে কী হবে? তাদের জন্য আমার করুণা হয়, দুঃখ হয়। মনে প্রশ্ন জাগে- এরা কোন চেতনায় দিনযাপন করে! এরা নিজেদের অস্তিত্বের ঠিকানা কোথায়; কীভাবে আছে; তা জানার বা বোঝার এতটুকু প্রয়োজন মনে করে না। এরা দিন আনে দিন খায়, আর রাতে শুয়েপড়ে ঘুমায়। এরা কেমনতর মানুষ- আমি বুঝি না। এরা স্বাধীনতা বোঝে না, বিজয়দিবস বোঝে না, এরা একুশ বোঝে না। এরা জানে-শুধু এমন একটা দিন ছিলো। সেই রূপকথার গল্পের মতো। আমার চারপাশে এদেরই দেখি, দেখি কিছু নির্জীব মুখ। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এরাও মানুষ। হাত-পা সম্বলিত মানুষ। শুধু তাদের বিবেক নামক যন্ত্রটি বিকল হয়ে গেছে। এদের জাগাবে কে?

অথচ, আমি আমার আমিত্ব ঝালাই করার জন্যেই এই দিনগুলো স্মরণ করি। স্মরণ করার পাশাপাশি আমার চারপাশ জাগিয়ে তুলি। বুঝিয়ে দিতে চাই, আমি কে, আমি কেমন, দেশ-মানুষ এবং প্রকৃতির প্রতি আমার ভূমিকা কী! আমার জীবনচারণও অনেকে বুঝে যায়, বুঝে যায় ভিনদেশের মানুষগুলিও। বিশেষ বিশেষ দিনগুলো মানুষের সুপ্তমননে জাগরণের কাজ করে, বিস্মৃতির অতল থেকে টেনে আনে। সেজন্য নিজ অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য বিজয়দিবস, স্বাধীনতাদিবস, ভাষাদিবসের গুরুত্ব বহুলাংশে। এই দিনগুলোকে অবহেলা করা মানে; নিজ পরিচয়কে অবহেলা করা। এই বিষয়টি প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের উপলব্ধি করা উচিত। ভাষাদিবস তেমনই একটি দিন, তাকে স্মরণ করতে হয় হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধাভরে। কারণ, এই ভাষাদিন থেকেই বাঙালি অস্তিত্বের জয়যাত্রা শুরু।

প্রতিবছর ভাষাদিবস বিশেষভাবে পালন করার মূল লক্ষ্য হলো নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে দেওয়া- এই হলাম আমরা; এই হলো আমাদের ভাষা! একে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তোমাদেরও। এই দিনটিকে তোমাদেরও বয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেইসাথে এই দিনের গুরুত্ব এবং মাহাত্ম্য তুলে ধরে আমাদের বাঙালি চেতনাকে শাণিত করা। এই চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে শুধু বাংলাদেশেই নয়; বিশ্বব্যাপী সব বাংলা ভাষাভাষীর মিলনমেলার আয়োজন চলে। এমনতর মিলনমেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিরাট একটি অংশ বাংলা একাডেমির আয়োজনে পরিচালিত একুশের বইমেলা। যে বইমেলা এখন বাংলা শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যের তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণও এই বইমেলাতে ঘটছে। সবকিছু মিলিয়ে একুশের বইমেলা এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

তাই একুশের বইমেলা এখন প্রাণের মিলনমেলা। এই মেলায় সমাগম ঘটে লেখক, পাঠক, প্রকাশকসহ সাধারণ মানুষের। বই না-কিনুক কিংবা বই না-পড়ুক; যে যেভাবেই বইমেলাকে দেখুক না কেনো; একবার হলেও কেউ না-কেউ এই বইমেলার প্রাঙ্গণে পদধূলি দেবেই। এখানে যেন স্বস্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়, এখানে যেন ভাষার প্রতি ভালোবাসার তুমুল আলোড়ন টের পাওয়া যায়। এর সাথে চলে প্রাণবন্ত আড্ডা। কত রথী মহারথীর আগমন ঘটে এখানে। যাদের স্বাভাবিক পরিবেশে দেখার কথা নয়; তাদের সাথেও দেখা হয়ে যায়। বাংলাভাষার রমরমা আবহে এভাবেই পুরো ফেব্রুয়ারি মাস ধরে ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।

ভুলে গেলে চলবে না; বাংলাভাষা বাংলার মাটি উৎসারিত ভাষা। যে ভাষা বাংলার আলো বাতাস নিয়ে ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর হচ্ছে। যত বিদেশী বুনিয়াদ আসুক না কেনো; অন্য ভাষার আগ্রাসী আস্ফালন যতই চলুক না কেনো; বাংলাভাষার শেকড় কেউ কখনো উপড়ে ফেলতে পারবে না। হাজারবছরের লালিত এই ভাষা আমাদের রক্তে বহমান। এই রক্তের স্রোত কে রুখে দেবে! আছে কি কোনো শক্তি? বাঙালি গর্জে উঠতে জানে। তার জ্বলন্ত প্রমাণ আমাদের স্বাধীনতা। রক্তের বিনিময়ে রক্ত দেওয়া হবে; তবুও নিজ অধিকার ছাড় দেওয়া হবে না। 

দেশের সার্বিক পরিস্থিতির চলমান অবস্থা; দল, গোষ্ঠী  বা কোনো রাজনৈতিক অস্থির চেতনার ধারাবাহিকতাকে দায়ী করে নিজ দায়িত্বপালন থেকে দূরে সরে যাওয়াটা এক ধরণের পালিয়ে বেড়ানোর মতো। নিজের ভিত শক্ত করতে হলে- নিজেদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রত্যেক মানুষ সচেতন হলে- কোনো দল বা রাজনৈতিক শক্তি কিছুই করতে পারবে না। জনগণের রায়ের কাছে সব ক্ষমতাই ধূলিসাৎ হতে বাধ্য। জনগণ যখন দ্বিধাবিভক্ত থাকে তখনই একটি দেশ টালমাটাল থাকে। যা বর্তমান বাংলাদেশের রূপ। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে জাতিকে বই পড়ুয়ায় রূপান্তরিত করতে হবে। বই পাঠে অভ্যস্ত হওয়া শুধু নয়; বইয়ের বিষয়বস্তু অনুধাবন করতে হবে। তা না-হলে কোনো মুক্তি মিলবে না। বই মুক্তচিন্তার ধারক বাহক এবং মানবতার মূর্তপ্রতীক। 

মূলত মানুষকে বইমুখী করার জন্যই এই বইমেলার আয়োজন- একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে চলে আসছে। সেইসাথে পাঠকের সঙ্গে লেখকের মিলন ঘটছে। যদিও এমন ভাবনা থেকে বইমেলার আয়োজন হলেও বিষয়টা ধীরেধীরে  হয়ে যাচ্ছে পুরোটাই বাণিজ্যকরণ। যার ফলে বইয়ের ভেতরের আকর্ষণের প্রতি জাগছে অনীহা। বই কিনলেও কেউ পড়ছে কিনা তাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বইপড়ুয়া জাতির পরিচয় বহন করে মুক্তচিন্তার ধারকেরা। যেখানে মানবতার ঝাণ্ডা ওড়ে পতপত করে। এখন সারা বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি তার উলটো। সবকিছুই চলছে প্রচার প্রচারণার ডামাডোলে, বই পড়ে বোধের জায়গা শাণ দেওয়া বা বইয়ের বিষয়কে অনুধাবন করার মানসিকতা খুব একটা পাওয়া যায় না। বই হয়ে গেছে এখন বসাররুমের সাজানো বস্তু। দুঃখজনক হলেও এটাই হলো বাস্তবতা। 

তারপরেও বইমেলার আবেদন রয়েই যাবে। বই ভালোবাসুক আর না বাসুক, বইয়ের সমাগমের সাথেসাথে মানুষের সমাগমে ঠিকই মানুষকে কাছে টানবে। সেইসাথে দেশে- বিদেশে একুশের চেতনার বিচ্ছুরণ ঘটছে। তবে যে চেতনায় আমাদের জেগে ওঠা প্রয়োজন, তা কি হচ্ছে, হলেও তা কতটুকু হচ্ছে? তা নিরূপণের সময় এসেছে। কারণ, বাংলাদেশ এখন মৌলবাদীর আগ্রাসনে আচ্ছাদিত। বাংলাভাষা  এক উন্মুক্ত ভাষা, মুক্তচিন্তার ভাষা। নিজ মাটি থেকে নিঃস্বরিত যে ভাষা; সে ভাষা কখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকতে পারে না। একদিন মুক্তি আসবেই। একুশের চেতনাই একদিন মুক্তির দ্বার খুলে দেবে। জয়তু একুশ।  জয়তু বাংলাভাষা

1558 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।