চারিদিকে একসময় হইহই, মারমার রব শুনেছিলাম। জানতাম না, বুঝতাম না কিসের এই দাঙ্গা। সবেমাত্র কলকাতা এসেছি পড়তে। কলকাতা আমার কাছে স্বপ্নের শহর। ছোট থেকেই স্বপ্ন দেখতাম কলকাতা নিয়ে। অত্যন্ত মাঝারি মানের ছাত্র, তারপরও কলকাতাতে পড়ার স্বপ্ন! এর প্রধান কারণ ছিলো আমার দিদি। আমি আমার দিদিকে খুব ভালোবাসতাম, আর দিদি কলকাতাতে থাকে, কলকাতার মেয়ে, আমিও চাইতাম ওর কাছে কাছে থাকতে।
ইংরাজি সাহিত্যে অনার্স নিলাম বিদ্যাসাগর কলেজে, পার্কসার্কাস গাইডেন্সে ক্লাস করতে শুরু করলাম পরের বছর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবো ভেবে। সেদিন ক্লাস করতে যাচ্ছিলাম, বাস শিয়ালদাহ পার করে মৌলালি ঢুকছে। হঠাৎ বাস থেমে গেলো। গাড়ি যাবে না। সামনে নাকি মারামারি হচ্ছে, অসম্ভব মারামারি! পুলিশ, সাধারন মানুষে ধস্তাধস্তি হচ্ছে। বিএসএফ জওয়ানও এসেছে, গুলি চলছে, আগুন জ্বলছে পার্কসার্কাসে। আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, মাসিকে ফোন করি। মাসি যেই শুনেছে আমি ওই রাস্তায়, আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলে, মাকেও ফোন করে জানিয়ে দেয়।
আমি মৌলালি যুব কম্পিউটার সেন্টারে ঢুকে যাই, জিজ্ঞাসা করি সামনে কি হয়েছে! ওরা বললো, "সামনে পার্কসার্কাসে আগুন জ্বলছে, মুসলিমগোষ্ঠী ও পুলিশের মধ্যে মারামারি হচ্ছে, লাঠি চার্জ চলছে, বিএসএফ রাবারের গুলি ছুঁড়ছে, সাধারন মানুষ ইট, কাঁচের বোতল ছুঁড়ে মারছে পুলিশের দিকে। ওদিকে একদম যাওয়া যাবে না, রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে গেছে সব।"
ছোট ছিলাম, চঞ্চল মাথা। তাই মারামারির কারণ বিশদে জানতে চাই নি। মুখরোচক করার জন্য মারামারির গল্পটাই যথেষ্ট ছিলো। হঠাৎ বাইরে মিছিল দেখতে পেলাম, "তসলিমা নাসরিন হটাও।" প্ল্যাকার্ডে লেখা "তসলিমা নাসরিন হটাও।" একদল সাদা টুপি পরা কিছু মানুষ মৌলালির রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে প্ল্যাকার্ড হাতে। বড় বড় সাদা কাপড়ে লাল রঙ দিয়ে লেখা "তসলিমা নাসরিন হটাও" গর্জন করতে করতে যাচ্ছে, আশেপাশে মানুষ রাস্তার ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে মজা দেখছে আর নিজেদের মধ্যে গুনগুন করে আলোচনা করছে। আমিও মজা দেখছি।
আমি চিনতাম না তসলিমা নাসরিনকে। জানতাম না কেনো এই মিছিল, কেনো মারামারি! সেইসময় কলকাতাতে চাঞ্চল্যকর একটা ঘটনা ঘটেছিলো। পার্কসার্কাসে বিখ্যাত চর্ম ব্যবসায়ী অশোক তোদি এক মুসলিম লোক রিজওয়ানকে খুন করেছিলেন। খুনের কারণ তার মেয়ে প্রিয়াঙ্কা তোদির সাথে রিজওয়ানের প্রেম। মূলত সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পার্কসার্কাসে এই মারামারি শুরু হয়েছিলো। যেটা বিশালাকার ধারন করে। পরে বুঝলাম, সেই সুযোগে রাজনীতি নিজের রঙ পাল্টায়। কিছু ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল বার করায় তৎকালীন সিপিআইএম সরকার। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্দেশে কিছু ভাড়াটে গুন্ডা পার্কসার্কাসের মারামারির জায়গা থেকে কিছু দূরে ওই মিছিল করে তসলিমা নাসরিনের বিতাড়ন চেয়ে। একটা সাজানো নাটক সংবাদ মাধ্যম ও কলকাতাবাসীকে প্রভাবিত করতে।
একটা সাজানো নাটক পরবর্তী বিধানসভার আগে মুসলিমদের নজর সিপিআইএমের দিকে ঘোরাতে। এই সাজানো নাটকের দরকার ছিলো সিপিআইএমের, একটা ইস্যু তৈরি করে তসলিমা নাসরিনকে অপসৃত করে মুসলিম ভোট ফিরে পাওয়ার জন্য। নন্দিগ্রাম কাণ্ড মুছে নন্দিগ্রামের মুসলিমদের ভোট ফিরে পাওয়ার জন্য। মুসলিম ভোট পাওয়ার উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছিলো সেটা বাংলার মানুষ জানে। কিন্তু এই নাটক যথেষ্ট ছিলো তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে বের করে দিতে।
একটা খুনের ঘটনার প্রতিবাদের বিক্ষোভ ঘুরে গেলো একজন লেখকের বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিক্ষোভে। খবর হল - "The 2007 Kolkata riots took place in Kolkata on 21 November 2007, when anti-Taslima protesters under the banner of All India Minority Forum blockaded major portions of central Kolkata and resorted to arson and violence. The Left Front led State Government deployed the army in the afternoon of that day."
আমি দিদিকে জিজ্ঞাসা করলাম তসলিমা নাসরিন সম্পর্কে। কে এই ব্যক্তি! কি এমন করেছে?
দিদি আমাকে লেখকের বাংলাদেশ থেকে নির্বাসনের গল্প শোনালো। বললো লেখকের লেখা "লজ্জা" বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করেছিলো, লেখক দু’মাস অন্তর্ধানে ছিলেন। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে বেড়াতে হতো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গাতে। সেখানে নাকি আরও ভয়ঙ্কর বিক্ষোভ মিছিল বেরিয়েছিলো সেই সময়। কিন্তু লেখক তাতে দমে যান নি একদমই। দেশ থেকে নির্বাসিত হয়েও তিনি লেখার মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদ জারি রেখেছিলেন। ভয়ঙ্কর সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও লেখক এখনও তাঁর লেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে "দ্বিখণ্ডিত" নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে লেখকের বিরোধ হয়। হাইকোর্ট পর্যন্ত লড়াই চলে। পরে ২০০৬ তে "দ্বিখণ্ডিত" মুক্ত ঘোষিত হলে রাজ্য সরকার সেটা ভালো চোখে নেয় নি। লেখককে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। রাজ্য ছাড়তে বলা হয়। কিন্তু লেখক একেবারেই নারাজ।
এসবকিছু শুনতে শুনতে আমি যেন একপ্রকার কাল্পনিক জগতে দেখতে পাচ্ছিলাম লেখক তসলিমা নাসরিনের জীবন। মনে মনে তসলিমা নাসরিন তখন আমার হিরোর আসনে জায়গা করে নিচ্ছে। এরপরই দিদি আমাকে "লজ্জা" বইটা পড়তে দেয়। দেখি লেখকের লেখা। শুধুই লেখা নয়, বাস্তব জীবনের এক যুদ্ধ, সমাজের যুদ্ধ। তার পরবর্তী ঘটনাগুলো জানতে থাকি, বুঝতে থাকি। লেখক যেন অগ্নি গহ্বর থেকে উঠে আসা সেই অগ্নি যে সমাজকে সত্যের সাথে পরিচয় করাতে চাইছে, সমাজের সামনে সত্যের রূপ তুলে ধরতে চাইছে। মানুষকে এক নতুন চিন্তাভাবনার জগত খুলে দিচ্ছে। আর এই প্রতিবাদে যে কিছু মানুষের মুখোশে আঘাত লেগেছে, তাদের প্রভাবে, এবং রাজনৈতিক নাটকের প্রভাবে লেখক বারেবারে মানুষের ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছে। লেখককে সাধারন মানুষের সামনে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বারেবারে। এতকিছুর সাথে লড়াই করেও এই লেখক তসলিমা নাসরিন একদম দমে যায় নি। একাই উঠে দাঁড়িয়েছে, লড়াই করেছে, আবারও লিখেছে। মনের ভিতরে যে সত্যের আলো, সমাজে নিষিদ্ধ চিন্তাভাবনাগুলোর নেতিবাচক ও ইতিবাচক রূপ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তুলে ধরেছে।
হ্যাঁ, আমি চিন্তাভাবনার এমনই ধার অনুভব করেছিলাম তাঁর লেখাতে। ছোট ছিলাম, কিন্তু ছোট বয়সেই সমাজের যে সত্যির সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তা সমাজ স্রোতের প্রতিকূলে বয়ে যাওয়া সব সত্য। যা সমাজ স্রোতের অনুকূলে বয়ে চলা মানুষের সত্যিকারের লজ্জা। তসলিমা নাসরিন সেদিন বাংলা থেকেও নির্বাসিত হয়েছিলো। কিন্তু জায়গা করে নিয়েছিল সেই ছোট ছেলেটার হৃদয়ে।