অধরা স্পর্শী

ছাত্রী

নারী এবং বাংলাদেশ

বাংলাদেশ। সতেরো কোটি মানুষের দেশ। কিন্তু মেয়েরা? দেশটি কি আদৌতেই মেয়েদের? বর্তমানে নারী পুরুষ অনেকেই দেখি সাম্যবাদী হয়ে উঠছেন। সবাই সমতার কথা বলছেন। কিন্তু সত্য তো এই যে, মেয়েরা হচ্ছে ঘরের জিনিষ, এদের চার দেয়ালেই মানায়। আজ একটি মেয়ের গল্প বলি।

মেয়েটি মধ্যবিত্ত পরিবারের। সাধারণ ভাবেই বড় হতে থাকে সে। কিন্তু, ছোট থেকেই তার মাথায় ঘুরতে থাকে মুক্তি। সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফেরা, ছেলেদের সাথে না মেশা, বড় বড় ওড়না গায়ে দিয়ে চলাফেরা করা, নিচ দিক তাকিয়ে ভদ্রভাবে হাঁটা, এগুলো তাকে ছোট থেকেই গেলানো হয়েছে আর পাঁচটা বাঙালি মেয়েদের মতোই। কিন্তু সে কোনোদিন এগুলো মন থেকে মানতে পারেনি। প্রতিবাদের ভাষা সে জানতো না। কেউ শেখায়নি। বরং শেখানো হয়েছে কেউ কোনো অশ্লীল মন্তব্য করলে অতি দ্রুত শেখান থেকে চলে আসতে। মাথার মধ্যে ঢোকানো হয়েছে, রাস্তার পুরুষ রা খারাপ। তাদের সামনে ভদ্রভাবে চলতে। কিন্তু, মেয়েটির মনে প্রশ্ন জেগেছিলো যারা খারাপ তাদের জন্য ই চুপ থাকতে হবে? কেনো?

প্রশ্নটা সে অনেককে করে। কিন্তু কেউ উত্তর দিতে পারেনি। মেয়েটি বড় হতে থাকে। রোজ রাস্তায় বেরোলে তাকে "পুরুষের" লোলুপদৃষ্টির শিকার হতে হয়। সে কাঁদে। তার মনে হতে থাকে এটা অন্যায়। হঠাৎ একদিন সে প্রতিবাদ করে। এরপর প্রায়ই বাড়িতে হুমকি আসতে থাকে, মেয়েটি তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হবে। বাবা মা ভয় পায় এবং তারাও দোষ দেয় মেয়েটির। এরকম অনেক ঘটনা ঘটে মেয়েটির সাথে কিন্তু ঘটবে বা ঘটলো এর উত্তর একটিই ছিলো! "তুমি মেয়েমানুষ"!

কোনোকিছুই মেয়েটিকে থামাতে পারেনি। কলেজ থেকে ফেরার পথে একদিন এক ছেলে তার বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো। গিয়ে সে থাপ্পড় মারে। একদিন এক ছেলে বাজে মন্তব্য করলে সে কলার ধরে থাপড়ায়। কেউ কোনো ভাবে টিজ করতে চাইলে তাকে শাসিয়ে আসে। কিন্তু, এগুলো করার পর তাকে শোনানো হয়, "তুই একদিন বিপদে পরবি, মেয়েমানুষের এত সাহস ভালো না"!

ছোট থেকে ১৭ বছর অব্দি এই বারবার "মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষ" শুনতে তার কাছে শব্দটি এখন গালি মনে হয়। মাঝে মাঝে কান্না পায় তার। যখন সে চারদিকে দেখে লোকজন সাম্যতার কথা বলে তখন তার বড্ড হাসি পায়। করুণা হয় তাদের মতো বিজ্ঞবিচি হিপোক্রিট দের ওপরে। বাবা মা একা বাইরে ছাড়তে ভয় পায়। রাতের বেলা মেয়েটির ঘরের বাইরে বেরোনো বারণ।

এখন মেয়েটি ভাবে বাংলাদেশ মেয়েদের জন্য নয়। যে দেশে বলা হয় মেয়েরা পোশাকের জন্য ধর্ষিত হয় সে দেশ তার নিজের নয়। যদি স্বাধীনতার কথা বলি, তবে তারা বলে ওঠে কটাক্ষ করে, "শরীর দেখানো স্বাধীনতা চাও?" যেখানে নিজের কমফোর্ট নিয়ে চলা যায় না, সে দেশ নিজের না। যে দেশের নাগরিক হয়েও প্রতিটা মুহুর্তে শঙ্কায় কাটাতে হয়, সে দেশ অন্তত নিজের হতে পারে না। রাস্তায় বেরোলে বাবার বয়সী লোকজন যখন তাদের চোখ দিয়ে বলাৎকার করে তখন মনে এদেশ আমার নয়! এতক্ষন যে মেয়েটির গল্প বললাম সে মেয়েটি আসলে আমি নিজেই।

এই গল্প প্রতিটি বাংলাদেশী মেয়ের গল্প। তারা এভাবেই বড় হয়। কেউ জ্বলে ওঠে, কেউ নিভে যায়। কেউ প্রতিবাদ করে, কেউ ভয়ে চুপচাপ চলে যায়। আসলে প্রতিটি পুরুষই সাবকন্সাশে একেক জন ধর্ষক। যখন তার মূল্যবোধ জাগে তখন সে মানুষ, অন্যথায় একজন ধর্ষক। তাই মেয়েদের বলি, জ্বলে উঠুন। দেশকে নিজের করুন। নিজেকে 'মেয়েমানুষ ' না, "মানুষ" ভাবুন। আত্মায়, মস্তিষ্কে গেঁথে নিন, "অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে"!

1798 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।