ফারহানা আনন্দময়ী

লেখক

অধ্যাপক জাফর ইকবাল, আপনি দেশ ছাড়ুন, বাঁচুন!

আমি বিশ্বাস করি, অভিজিৎ রায় আর জাফর ইকবালের মতো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মগজগুলো অমূল্য। এই মগজগুলো যতদিন সচল থাকবে, তাঁদের সৃষ্টি, কীর্তি দেশের এবং বিশ্বের মঙ্গলে ভূমিকা রাখতে পারে।

অভিজিৎ রায় আমেরিকায় বসবাস করেও শুধু বাংলা ভাষায় বই লিখে বিজ্ঞান, বিবর্তনবাদ, ধর্ম, মানবতাবাদের কথা সহজ ক'রে, বোধগম্য ক'রে বাংলাদেশের মানুষকে জানাতে চেয়েছেন, মগজের জানালাটা খুলে দিতে চেয়েছেন। কিছু মানুষ অন্তত পাঠ করুক, আলোকিত পথে ভাবতে শিখুক সেই চেষ্টা তিনি মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত ক'রে গেছেন। যতদিন অভিজিৎ রায় আমেরিকায় ছিলেন ততদিন নির্বিঘ্নে এই কঠিন কাজটি অনায়াসে করতে পেরেছেন।

তাঁর বাংলায় লেখা বইগুলোর সাথী হয়ে যখনই তিনি বাংলাদেশে এলেন, অন্ধকার মগজের মানুষগুলো নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করলো। 

বিজ্ঞানের বইগুলো বাংলায় লেখা, বাংলাদেশীদেরকে উপকার করা এই বাঙালি লেখককে আমরা বাংলাদেশের মাটিতে রক্ষা করতে পারলাম না। আমরা অভিজিৎ রায়কে হারালাম দেশের মাটিতেই।

অধ্যাপক জাফর ইকবাল-ও ঠিক এই কাজটি ক'রে চলেছিলেন বাংলাদেশে ব'সে। বিজ্ঞান বিষয়ক গল্প, কল্পকাহিনী তিনি সহজ-সুন্দর ক'রে বাংলা ভাষায় লিখে বাংলাদেশের কিশোর-তরুণদেরকে আলোর পথ দেখিয়ে চলছিলেন। শিশু-কিশোরদের কাছে অঙ্ক'কে দানব থেকে বন্ধুতে রূপান্তরিত করার উৎসব আয়োজন ক'রে চলেছিলেন। আমরা কৃতজ্ঞ, এই ধারার মানুষদের প্রতি।

তিনিও আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণাকাজ শেষ ক'রে ওই দেশেই থেকে যেতে পারতেন, তাঁর মেধার প্রয়োগের সর্বোচ্চ সুযোগ আর সুবিধা তিনি সেখানেই চাইলে পেতেন। জাফর ইকবাল দেশে ফিরে এসেছিলেন।

কেনো তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন? দেশকে ভালোবেসে, দেশের মাটিতে থেকে দেশকে কিছু দিতে চেয়েছিলেন। দিয়ে-ও যাচ্ছিলেন। আমরা এই দেশবাসীরা কী করলাম এর প্রতিদানে? তাঁর ঘাড়ে কোপ দিলাম চারটি। মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলাম। তাঁর ওই অমূল্য মগজটি বিকল ক'রে দিতে চাইলাম। হ্যাঁ, আমরাই তা করলাম। তার উপর হামলার খবরটির নীচে কুৎসিত মন্তব্য-লেখা মানুষগুলো আমাদের থেকে আলাদা কেউ নয়। আমরাই, আমাদের আশেপাশের মানুষ, আমাদের ঘরের মানুষ।

এতোসব ঘটে যাওয়ার পরেও ইয়াসমিন হকের বাংলাদেশে থেকে যাওয়ার ঘোষণাকে যারা সাধুবাদ জানাচ্ছেন, আমি তাদের দলের নই। আমি ইয়াসমিন হক বা সাধুবাদ জানানো মানুষদের মতো মহান নই। আমি স্বার্থপর। আমি আমার দেশের মঙ্গলের স্বার্থেই স্বার্থপর, আগামি প্রজন্মের মঙ্গলের স্বার্থেই স্বার্থপর।

আমি আমার দেশকে ভালোবাসি। আমি চাই আমার দেশকে গ্রাস ক'রে নেয়া অন্ধকার কেটে যাক। আমি চাই, আমার দেশের শিশু-কিশোরেরা আলোকিত মগজ নিয়ে বেড়ে উঠুক, তারা বিজ্ঞানমনস্ক হোক। আর চাওয়া পূরণের জন্য জাফর ইকবালের বেঁচে থাকা খুব জরুরি, অভিজিৎ রায়ের বেঁচে থাকাটাও খুব জরুরি ছিলো।

অধ্যাপক জাফর ইকবাল, আপনি দেশ ছাড়ুন। এই অন্ধকারময়, অকৃতজ্ঞ, নির্লজ্জ, নির্লিপ্ত বাংলাদেশ আপনাকে রক্ষা করতে অপারগ। আপনি বেঁচে থাকুন দীর্ঘদিন, আপনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের কথা লিখুন, অঙ্ক'কে বন্ধু ক'রে উৎসব আয়োজন করতে সাহায্য করুন... সবই করুন দেশের বাইরে গিয়ে। আপনার দীর্ঘায়ু লাভ করাটা খুব প্রয়োজন, আমাদের দেশের স্বার্থেই, আমাদের আগামি প্রজন্মের স্বার্থে। 
অভিজিৎ রায়, জাফর ইকবাল... এঁদের মগজগুলো অমূল্য। চাপাতির কোপ খাওয়ার জন্য এই মগজের জন্ম হয় নি।

1528 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।