সালমা লুনা

ফিজিক্স আর পলিটিক্যাল সাইন্সে মাস্টার্স করেছেন। লেখালিখি করেন শখে। দায়বদ্ধতা অনুভব করেন নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলায়। হোপ সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন নামে একটি এনজিওর প্রেসিডেন্ট তিনি।

নয়নতারা : ডাক দিয়ে যায়

 আমি একসময় একজন সুইপারের মতো হতে চেয়েছিলাম। বেশ বয়স হলেই .... অন্তত যে বয়সে মানুষ বোঝে যে সুইপারের কাজটা কি - সেই বয়সে। 
কেন? 

এক সুইপার রমণীর জন্য। তাকে কাছে থেকে দেখে, তার কথা শুনে। তার হাতে একতাড়া খুচরো টাকা এবং সেই টাকা দিয়ে সে একা কী কী করবে সেই অনাবিল স্বেচ্ছাচারীতা আর উদ্ধত স্বাধীনতার অহংকার দেখে আমার মনে হয়েছিলো আমি একদিন ওর মতো হবো।

পেশার কর্মকান্ড নিয়ে অত মাথা ঘামাইনি। আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো সেই সুইপার রমনী। সপ্তায় তিন থেকে চারদিন সে আমাদের বাসায় আসতো বাথরুম ধুয়ে দিতে।
তার নাম মনে করতে পারছি না।

ধরা যাক তার নাম নয়নতারা। নয়নতারা নাম দেয়ার পেছনে একটা কারণ আছে অবশ্য।

নয়নতারা নাম কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মীর হতে পারে কেউ বিশ্বাস করবে না। আমিও করিনি। কিন্তু আমি নিজের চোখেই দেখেছি। প্রথমবার যখন সুইপার বস্তিতে একজনকে এই নয়নতারা নামে ডাকতে শুনেছিলাম আমার বুকটা শুন্য হয়ে গিয়েছিলো, একটা সুইপার মেয়ের এত সুন্দর নাম?

বুড়ি একটা মহিলা তাকে নয়নতারাআ-আ-আ- বলে ডাকছিলো। তার পরনে ছিলো লাল শাড়ি, হাঁটুর উপরে পরা। অনেকখানি উদোম, তেল পিছলে যাওয়া মসৃন কালো সরু কোমরে আঁচল গুঁজে রাখা। মাথার চুলে তেল জবজবে, চুঁড়ো করে বাঁধা ঢাউস খোঁপাতে একটা কাঠি নাকি কোনো ফুলের ডাল গোঁজা! আজ এতদিন পরে ওটাকে ফুলের ডাল ভাবতেই ভালো লাগছে বটে। সে একটা শুকর ছানাকে লাথি দিতে দিতে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো।

নতুন বাজার থেকে যে রাস্তাটা সোজা নওমহলের দিকে চলে গিয়েছে, সেটিকে দু’ভাগ করে সমান্তরাল রেললাইনটাও ছুটে গেছে ময়মনসিংহ জংশন থেকে জামালপুরের পানে, ঠিক সেখানেই তাকে দেখেছিলাম। নতুন বাজার, আমাদের ভাড়া বাসা থেকে বেরিয়ে নওমহল বা চরপাড়া যেতে হলে ঐ রেললাইন পার হয়েই যেতে হতো। 

রেললাইনের এপাড়ে ছিলো সম্ভবত তাদের বসতি কিংবা ঝুপড়ি বস্তি।
আমি ওর ভেতরে যাইনি কখনো। তবে ট্রেন যাবে বলে লাল খুপরি ঘরটা থেকে গার্ড বের হয়ে যখন লাইনের দু’পাশের লোহার লম্বা ডাণ্ডাগুলো ফেলে দিতো তখন রিক্সায় বসে থেকে ওদের প্রাত্যহিকতার ছিটেফোঁটা দেখতাম। ওদের বাচ্চাদের ছুটোছুটি, মেয়েদের পা ছড়িয়ে বসে থাকা, পুরুষদের চিৎকার চেঁচামেচি বিড়িতে টান দিয়ে খকখক করে ফুসফুস ছিঁড়ে ফেলার মতো মরন কাশি, চোখে পড়তো, কানে আসতো।

চলমান শহরটাকে আটকে রেখে ট্রেনের প্রতিদিন চলে যাবার ওই জায়গাটায় কোনো একদিন দেখেছিলাম তাকে। আমি রিক্সায় বসা, বুড়িটা ডাকছিলো, নয়নতারাআআ ....।

সেই থেকে কোথাও সুইপার কোনো নারী আমার কাছে নয়নতারা।

তবে রেললাইনের ধারের নয়নতারাকে দেখে আমার সুইপার হতে ইচ্ছে করেনি। 
আমার যে নয়নতারাকে পছন্দ হয়েছিলো সে আমাদের বাসায় কাজ করতো। মাস শেষে টাকা পেতো -দু’শো।

কি কারণে যেন আমাদের বাসার গৃহকর্মীরা তখন বাথরুম সাফ করতে চাইতো না। আম্মাও তাদের কোনো জোর জবরদস্তি করেনি কাজটা করিয়ে নিতে। তার বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আম্মা সেই সুইপার মহিলাকে কিভাবে যেন বন্দোবস্ত করে নিয়েছিলো। সে সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন এসে বাথরুমগুলো ধুয়ে দিয়ে যেতো। 

বাসাটা ছিলো চারতলা। আমরা তিন তলায় থাকতাম। বাড়ির সামনে অনেকটা ফাঁকা জায়গা তারপর গেইট। ভেতরে বাউন্ডারি ঘেষে অনেকগুলো নারকেল গাছ। সে গেইট পেরিয়ে লম্বা বাঁশের ডাণ্ডাঅলা ঝাড়ু নিয়ে উপরে আসতো। মাঝেমাঝে উপরে উঠে আসার আগে নারকেল গাছের নীচে বসে খানিক জিরিয়ে নিতো। কখনো বিড়ি ধরিয়ে টানতো। বাথরুম গুলো ধুতো বেশ পরিস্কার করে। আমার পরিষ্কারের বাতিকগ্রস্ত আম্মাও খুঁত ধরার বদলে প্রশংসা করতো নয়নতারার।

বেশ লম্বা নয়নতারা। কিন্তু সেই কালো কুচকুচে গাত্রবর্ণ, মাথায় একরাশ চুলের খোঁপা -চূঁড়ো করে বাঁধা। আমার নানি তাকে বলতো 'উইড়া বেডি'। মানে সম্ভবত উড়িয়া। রাস্তা ঝাড়ু দেয়াটা তার পৌর করপোরেশনের চাকরি। এছাড়া সরকারী অফিসারদের বাসাবাড়ি, স্কুল বা অন্যদের বাথরুম পরিষ্কার করে দিয়েও আমাদের নয়নতারা ভালোই টাকা পেতো মনে হয়। কারণ তার কানে ছিলো রূপার গয়না। একটা না, বেশ কয়েকটাই! সে ওগুলো বদলে বদলে পরতো। মাকড়ি ধরনের ওই গয়নাগুলো ছাড়াও তার নাকে ছিলো ইয়া বড় নাকফুল -মাঝে একটা লাল টুকটুকে পাথর। কানে হরওয়াক্ত গুঁজে রাখা, হয় বিড়ি নয়তো পাখির পালক। কাজ করে বিড়ি ফুঁকবে আর কান চুলকাবে ওই পাখির পালকে। 

আর সে শাড়ি পরতো খুব চকচকে। হলুদ লালের বড়বড় ফুল ছাপা শাড়ি ...... খাটো ব্লাউজ ... কোমরের অধিকাংশই বেরিয়ে আছে, তেল চিকচিকে, একফোঁটা মেদ নেই। কালো একটা সাপের মতো হিলহিলে শরীর। কালো সাপ আমি টিভিতে দেখেছি বাস্তবে দেখিনি। আমি শুধু নয়নতারাকে দেখেছি। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখা।

নয়নতারা তার বরের কথা বলতো

-উয়াক কিয়েরে টেকা দিবেক! উয়া নামের সোয়ামী আছে। হামি টেকা দিবার বউ লয়। মদ খাইবে, মাতারি লয়ে ফুর্তি করবেক এর লাই টেকা দিবেক হামি! হামার টেকা হামি খর্চা করবেক। একখান বিছা বানাইবেক। নয়া ছাপা শাড়ি আর নাকফুল কিনবে। মাইয়া পইড়বেক। মায়ের এই গু সাফ করার কাম করবেক লাই।

ও কাজ করার সময় গান গাইতো ... গুনগুন করেই। কি ভাষার গান বোঝা যেতো না। বাসার অন্য কোনো ঘরে যাবার তার অনুমতি ছিলো না, ডাইনিং এরিয়াতে থাকা বাথরুমগুলো ধোয়াই ছিলো তার কাজ। 
কাজ শেষ হলে মাঝে মাঝে আম্মা তাকে রুটি টুটি থাকলে খেতে দিতো। সে ওই সদর দরজার পাশেই বসে খেতো। পানি নীচে গিয়ে টিউবওয়েল চেপে চেপে খেতো। তাদের যে ঘরে ঢোকা মানা। কিছু ধরাছোঁয়া বারণ। অচ্ছুত তারা। 

এই অচ্ছুত নয়নতারার মতো স্বাধীন হওয়ার গোপন ইচ্ছেটা কবেই মরে গেছে। 
মনে পড়ে- কে যেন ইচ্ছেটা শুনে বলেছিলো-

-ছিঃ! এত ছোট হওয়ার ইচ্ছা কেনো তোমার? এইসব ইচ্ছা কারো হয়? 
আমার হতো। এখনো নিজেকে কখনো কখনো খুব পরাধীন মনে হলে আর নিজের একান্ত নিরীহ ইচ্ছে গুলোকে আবিলতার ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে দেখলে আমার নয়নতারাকে বড় মনে পড়ে।

আমি যে নয়নতারার চেয়ে এতবছর পরেও আরো ছোট হলাম; বড় তো দূর! 
এমনকি কালো কুচকুচে নয়নতারার ঝলমলে দীপ্তিটুকুও আমার নাই।

4024 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।