নওরীন পল্লবী

নারীবাদী লেখক।

মহামান্য সতীত্ববাদী সমাজ, আই হ্যাভ অ্যা কোয়েশ্চন - পর্ব ০১

বাঙালীর জীবনে 'সতীত্ব' শব্দটা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মেয়েদের অধিকার হরণ এবং হেনস্তার যত ফাঁদ পেতে রেখেছে, সতীত্ব তন্মদ্ধ্যে প্রধান বললেও ভুল হবেনা। ভুল হবেনা বলছি এজন্যই যে, সমাজপতিদের ভাষ্যমতে, সতীত্বের ধারক একমাত্র মেয়েরাই, পুরুষরা না এবং কখনোই না। এই 'থাকা/না' থাকাটি অবশ্যই আলোচনা করা প্রয়োজন। তবে, সাহিত্যাঙ্গনেও হারিকেন দিয়ে খুঁজে যখন 'সতী' শব্দটির কোন পুরুষবাচক শব্দ পাওয়া যায়না, তখন সন্দেহের অবকাশ থাকেনা যে, সতীত্বের সাথে পুরুষের কোনরূপ যোগাযোগ কোনকালেই ছিলনা। প্রথমেই জানা প্রয়োজন, সতীত্ব কি? সতীত্বের আসল সংজ্ঞা দিতে গিয়ে স্বয়ং উইকিপিডিয়াকেও হিমশিম খেতে হয়েছে। খুবই সংক্ষেপে বললে এটি একটি কনসেপ্ট যা দ্বারা বোঝায় কোন নারী যৌনকর্মে লিপ্ত হয়নি এমন অবস্থা। আমাদের সমাজে সতী বলতে সেই নারীকে বোঝানো হয়, স্বামী ব্যতিত কারো সাথে যার কোন যৌনমিলন ঘটেনি, বিয়ের আগে এবং পরে একই শর্ত প্রযোজ্য। যদিও বিয়ে পূর্ববর্তী সময়ে সতীত্ব রক্ষা বেশি গুরুত্বপুর্ণ।

কোন মেয়ে সতী? কে সতী না? এ বিষয়টি পরীক্ষা করে যাচাই করা খুব পবিত্র দায়িত্ব এদেশের পুরুষদের। প্রথমদিকে মনে করা হতো, প্রথম যৌনসংসর্গে রক্তের উপস্থিতিই প্রমাণ করে মেয়ে সতী, নতুবা নয়। অনেক ভদ্রলোকেরাও প্রথম মিলনে এই রক্তের দাগ দেখতে মরিয়া হয়ে বিছানায় সাদা চাদর বিছায় শুনেছি। যদি রক্ত না মিলে, মেয়েটির হয় সমূহ সর্বনাশ। সইতে হয় লাঞ্ছনা, গঞ্জনা। অসতী অপবাদে সংসার পর্যন্ত ভেঙে যায়। কিছু সচেতন মানুষ অনেকবার বলেছে এবং লিখেছে যে, সতীত্বের সাথে আবশ্যক ব্লিডিংয়ের কোন সম্পর্ক নেই।

বিভিন্ন সময়ে চলেছে বিভিন্ন গবেষণাও। Sexual Pleasure Research (Uni of BIU), WHO এবং মেডিকেল প্রফেসরদের কিছু আর্টকেল অনুসারে,

"হাইমেন (বাংলায় সতীচ্ছদ), মিউকাস মেমব্রেন দিয়ে গঠিত একটা পাতলা পর্দা যা যোনিরন্ধ্রকে ঘিরে থাকে অথবা আংশিকভাবে ঢেকে রাখে। সাধারণত সতীচ্ছদ অর্ধচন্দ্রাকৃতির, তবে তার ব্যতিক্রমও যথেষ্ট হয়। সতীচ্ছদের মধ্যবর্তী ছিদ্রের আকার সবার ক্ষেত্রে সমান হয়না, কারও ক্ষেত্রে বড় আবার কারও কারও ক্ষুদ্র হতে পারে। এই ছিদ্রের মাধ্যমেই ঋতুস্রাবের রক্ত ও অন্যান্য পদার্থ বেরিয়ে আসে। সতীচ্ছদ বা hymen কে নিয়ে বহু কূসংস্কার ছড়িয়ে রয়েছে। সতীচ্ছদের অনুপস্থিতিকে কূমারীত্ব হারানোর লক্ষন হিসেবে গন্য করা হয়। সাধারণ ধারনা এই যে প্রথমবার যৌনসঙ্গমের সময় সতীচ্ছদ ফেটে রক্ত বের হবে; আর যদি তা না হয় তার মানে কন্যা কূমারী নয় ( কিছু কিছু পুরাতন মহিলারা মনে করতেন ) কিন্তু এই ধারনা ঠিক নয়। প্রথমত যৌন সঙ্গমের ফলে সতীচ্ছদ নাও ছিড়তে পারে। যদি যৌনসঙ্গমের সময় সঠিকমাত্রায় লুব্রিকেশন (lubrication) হয় তবে সতীচ্ছদ ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। দ্বিতীয়ত অনেকের সতীচ্ছদের মধ্যবর্তী ছিদ্র এমনিতেই বড় এবং সতীচ্ছদ এত স্থিতিস্থাপক হয় যে যৌনসঙ্গমের ফলে তার ফেটে যাওয়ার কোন সম্ভাবনাই থাকেনা। তৃতীয়ত সাইকেল চালানো, নৃত্য অনুশীলন, বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, হস্তমৈথুন, ট্যাম্পুন ব্যবহার ইত্যাদির ফলেও সতীচ্ছদ ফেটে যেতে পারে। সুতরাং সতীচ্ছদের উপস্থিত বা অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে কখওনই কারুর কূমারীত্ব নির্ণয় করা সম্ভব নয় অথবা এই ধরণের ধারনা সম্পূর্ণ ভুল ও কুসঙ্কস্কার ।"

এছাড়া, Human Sexuality নিয়ে বেশ কয়েকবার গবেষণার ফলে আরও কিছু চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে:

১.প্রতি ১০০০ মেয়ের মধ্য ১জন হাইমেন ছাড়াই জন্ম নেয়।

২.শতকরা ৪৪জন নারীর সতীচ্ছদ কোন প্রকার রক্তপাত ছাড়াই হতে পারে।

৩.হাইমেনের Elasticity অত্যন্ত বেশি হওয়ায়, অনেকসময় এটি না ছিঁড়লেও সঙ্গম কোনরূপ বাধাপ্রাপ্ত হয়না।

বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকার পরও অশিক্ষা-অজ্ঞতা কিংবা গোঁড়ামির কারণে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এই কনসেপ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনা বা চায়না। এর দুর্ভোগ কাকে পোহাত হয়, তা আর নতুন করে মনে করানোর প্রয়োজন নেই বোধ করি।

গবেষকরা প্রমাণ দিয়ে যতই উল্টায়ে পাল্টায়ে ফেলুক না কেনো, প্রচলিত সতীত্ববাদের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। আসেনা এজন্য যে, সমাজে প্রচলিত সতীত্ববাদ সম্পুর্ণভাবে পুরুষতন্ত্র-এর তৈরী ধারণা। বলতে সংশয় নেই যে- "পুরুষতন্ত্র যদি নারী অবদমনের চুল্লী হয়, সতীত্ব তার জ্বালানী। তাই পুরুষতন্ত্র কায়েম রাখতে হলে সতীত্ববাদ বাঁচিয়ে রাখা আবশ্যক। সর্বোপরি সতীত্বই পুরুষতন্ত্রের মূলধন বলে আমার মনেহয়, শুধুমাত্র সতীত্ব কনসেপ্টটি বিলুপ্ত করা গেলে, পুরুষরা আর কোনভাবেই মেয়েদের দমিয়ে রাখতে পারবেনা।"

অনেকের কাছে কথাগুলো অস্পষ্ট বা অযৌক্তিক মনে হতে পারে। সতীত্বের মতো পবিত্র দায়িত্ব কিভাবে নারীকে বঞ্চিত কিংবা পুরুষের অধীনস্ত করতে পারে? নেপথ্যে আসলে কি? আমরা তা দেখবো ২য় খন্ডে এবং অবশ্যই 'মহামান্য সতীত্বকে' প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে।

1954 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।