মা বললো, ওরে সোনাবী পাশের খালের কূয়ো থেকে এক কলস পানি নিয়ে আয় ।পড়ন্ত বিকেল। ভ্যাপসা গুমোট গরমে ঝিমুচ্ছিলাম পাটির ওপর। মায়ের ডাকে উঠে পড়ি। সময় থাকতে অবশ্যই পানি ঘরে তুলে রাখতে হবে। গ্রামে একটা মাত্র নলকূপ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বসানো হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে অতিরিক্ত ব্যবহারে নলকূপটি দ্রূতই নষ্ট হয়ে যায় ।
দেরী না করে কলসটি কাঁখে নিয়ে গেলাম বাড়ী থেকে কিছুটা দূরে খালের পাড়ে। ভাদ্রমাস, চমৎকার শরৎকাল। পরিষ্কার নীল আকাশে সাদা মেঘের দল উত্তরে ভেসে যাচ্ছে। খালের পাড়ে পাড়ে সাদা কাশফুল হাওয়ায় নুইয়ে নুইয়ে পড়ছে। কিছুদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় খালের পানি স্বচ্ছ ও পরিষ্কার দেখাচ্ছে। আমি পানিতে আমার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ পিঠে কারও হালকা চাপড় খাই। পিছন ফিরে দেখি পাশের গ্রামের এক ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। বললো, ভয় পেয়েছো?
-না পাইনি, কোথায় যাচ্ছো?
-এইতো তোদের গ্রামে যাচ্ছি। একটা কাজে।
-তাহলে যাও।
-আচ্ছা। এই সাবধান। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। ঐখানে সেটলার পাড়া আছে ভুলে যেও না কিন্তু।
সত্যিতো খালের শেষ মাথায় যে সেটলার পাড়া আছে সেটা বেমালুম ভুলে গেছি। দু’বছর হচ্ছে ওরা বসত গেড়েছে। ওসব জায়গায় আমাদের অনেকের কলা বাগান ছিলো। অনেকেই আদা হলুদ চাষ করতো। বিভিন্ন বনজ ফলজ গাছ লাগিয়েছিলো অনেকে। কিন্তু হঠাৎ একদিন পাশের সেনা ক্যাম্প থেকে আর্মিরা ঘোষণা দেয় সেখানে নাকি সেটলাররা বসতি স্থাপন করবে।
তাদের সিদ্ধান্তে আমাদের গ্রামসহ পুরো পাহাড়ি জনগোষ্ঠী প্রতিবাদ এবং বিরোধীতা করেছিলো। কিন্তু আর্মিরা যারা প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলো তাদের কে ধরে অমানুষিক নির্যাতন করে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে আটকে রেখেছে। তগুন দাকে ও ওরা মেরেছে। খুব কেঁদেছি তুগুন দাকে মার খেতে দেখে। তারপর প্রতিবাদ বন্ধ হয়ে গেলে সেটলাররা বিনা বাঁধায় সেখানে চলে আসে।
এরপর থেকে আমরা সেটলারদের অত্যাচার সহ্য করছি। ধানী জমিতে গরু বেঁধে দেয়। চুরি করে। কত না নোংরা কাজ করে।
যাক কলসিতে পানি ভরে ফিরতে গিয়ে তুগুন দার কথা খুব মনে পড়ছে। সবে যখন ক্লাস এইটে উঠেছি তখন সে কলেজে পড়ে। মাঝে মাঝে আমাকে অংক আর ব্যাকরণ গুলো বুঝিয়ে দিতো। নাইনে উঠলে কোন বিভাগে পড়লে ভালো হবে তা বিস্তারিত বুঝিয়ে দিতো ।
সে আমাকে মাঝে মাঝে ঝর্ণা এবং ফুলের উপমা দিতো। আমি না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে মুচকি হেসে বলতো,
-তুমি এখন ও ছোটো। মনটা এখন ও শিশুর মতো। আর একটু বড় হও। তাহলে বুঝবে।
আমি ভেবে পাইনা আর কত বড় হবো। এখন তো মায়ের থেকে এক বিঘত লম্বা হয়েছি। তারপর ও আমাকে বড় হতে বলে। অনেকেই আমাকে বলে আর একটু বড় হও। তুমি বড্ড শিশু।
স্কুলের সহপাঠিরা বলে আমি নাকি লম্বা হয়েছি। আর খুব সুন্দরী ও হয়েছি।
ধ্যাৎ তুগুন দার কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যে চলে গেলাম।
তুগুন দা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছে। মাঝে মাঝে আসে। বলে
-সাবধানে থেকো। কেউ খারাপ কিছু বললে বা ইঙ্গিত করলে আমাকে জানাবে। চোখ টিপে হেসে বলতো
-আমি কিন্তু আছি মনে রেখো। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে বলে
-সময় এলে বলবো, তুমি ও বুঝবে। মন দিয়ে পড়ালেখাটা করো।
আমি এস এস সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তুগুন দার কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ আমার মুখ জোরে চেপে ধরে। দেখতে পাই দুটো লোমশ কালো কুচকুচে হাত আমার মুখ আর গলা চেপে ধরেছে।
কোনো মতে মাথাটা পিছনে ঘুরিয়ে দেখি তিনজন সেটলার। একজন আমার মুখ গলা চেপে ধরেছে। অন্যরাও ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কাঁখ থেকে আমার পানির কলসি ধুম করে মাটিতে পড়ে গেলো। আমি হাত দিয়ে ঠেকানোর আগে বাকি দু’জন আমার হাত পা ধরে চ্যাং দোলা করে অদূরে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেলো। আমি সর্বশক্তি দিয়ে হাত পা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। আমার পায়ের লাথি একজন সেটলারের মুখে পড়লে সে খেপে গিয়ে আমার একটা পা মচকে ভেঙ্গে দেয়। ভীষণ যন্ত্রণায় আর্তচিৎকার করতে গেলে আমার ঠোঁটে একজন শক্ত কামড় বসিয়ে দিয়ে ঠোঁট ছিনিয়ে নেয়। গলগল রক্তের ধারা বেরিয়ে আমার মুখের ভিতর ঢুকতে শুরু করলো। ফেলার সুযোগ না পাওয়ায় নিজের রক্ত নিজেকেই পান করতে হচ্ছে। নাক দিয়ে নাকের ভিতর রক্ত ঢুকে যাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছি না।
নরপিশাচ বর্বর হায়েনার দল আমার দু’টি চোখ আর কষ্টের অনুভূতি ছাড়া সব খুবলে খুবলে খাচ্ছে। হাত দিয়ে প্রাণপণ ঠেকাতে গেলে আবার ও একটা হাত ভেঙ্গে দেয়। আর্তনাদের স্বর গলা দিয়ে বেরোতে না পারায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমার তখন শুধু তুগুন দা আর পজ্জন দার কথাই মনে পড়ছে। আজ তারা যদি ঠিক পথে থাকতো তাহলে আমাকে এমন নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো না।
পা থেকে মাথা অব্দি কিছুই বাকি রাখে নি নরপিশাচ সেটলার ধর্ষকরা। পালাক্রমে তাদের লালসা মেটানোর পর একজন বলে, মেরে ফেলি। বেঁচে থাকলে আমরা বিপদে পড়বো।
আর একজন তাতে সায় দিয়ে বললো, অবশ্যই। খুব তাড়াহুড়ো করে ওরা আমার গলায় ছুড়ি চালিয়ে সটকে পড়ে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ঠিকমত ছুড়িটা গলায় না বসায় আমাকে আবার ও কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। কোনো ভাবেই নড়াচড়া করতে পারছিলাম না। নাক মুখ গলা থেকে শুরু করে সর্বাঙ্গ শরীর থেকে রক্ত ঝড়ছে।
এই কি তাহলে নরক? এর চেয়ে বেশি কষ্টকর হতে পারে না নরক।
আমি শুধুই চেয়ে আছি আর মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করছি।
মা হয়তো আমার পথ চেয়ে বসে আছে। হয়তো ভাবছে আনমনা মেয়েটা কাশফুলের রূপ দেখে বিভোর হয়ে আছে। আর তুগুন দা, পজ্জন দা তারা কি ভাবছে? তারা তো ইউনিভর্সিটিতে।
আমার মামাতো ভাই পজ্জন দা। সে ও তুগুন দার মতো আমাকে ভালোবাসে, স্নেহ করে আর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। কিন্তু ওদের মধ্যে সদ্ভাব নেই।
আমি বস্ত্রহীনা বলে ওপর থেকে থেকে শুকনো পাতাগুলো ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে আমার বিবস্ত্র ক্ষত বিক্ষত দেহের ওপর। হয়তো প্রকৃতি আমার দূর্দশাকে সহ্য করতে পারছিলো না। একটা অচেনা পাখি করুণ স্বরে কাছে কোথাও বসে থেকে থেকে ডেকে যাচ্ছে। সেকি আমাকে শেষ বিদায় জানাচ্ছে? আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। শেষ বেলায় কেউ মমতা মাখা হাতে মুছে দিতে আসলো না। জানলো না কেউ আমি যে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছি।
এই নরক যন্ত্রণার মধ্যে ও শুধু তুগুন দা আর পজ্জন দার কথাই মনে পড়ছে। কারণ, আমি দুজনকেই শ্রদ্ধা করলেও তারা একে অপরের বিরোধী। ইউনিভার্সিটিতে পাহাড়ি ছাত্র ছাত্রীরা দুই দলে বিভক্ত। এসব আমি জানতাম না। মামার বাড়ি থেকে পজ্জন দা আমাকে নিতে আসে। চিত্তি দি (পজ্জন দার বড় বোন) তার সদ্য বিয়ে করা জামাইকেসহ বেড়াতে এসেছে তাই আমাকে পজ্জন দা নিতে এসেছে। ইউনির্ভাসিটি তে ক্লাশ বন্ধ বলে তুগুন দা ও গ্রামে ফিরে এসেছে। আমার বাড়িতে দু’জন মুখোমুখি হলে ও কেউ কারো সাথে কথা বলে নি। দু’জন দুজনকে এড়িয়ে গেছে।
মামার বাড়িতে গিয়ে রাতে চিত্তিদির সাথে ঘুমাবো এই আশা করেছিলাম। কতদিন তার গল্প শুনে ও পিঠে হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর আদরটুকু পাচ্ছিলাম না। কিন্তু মামী যখন বললেন তোর দিদির খাটে তুমি আঁটবে না। তোর দাদার সাথে ঘুমাও। ভীষণ রাগ হয় আমার বনোইয়ের (দিদির জামাই) ওপর। সে আমার দিদিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। মন খারাপ করে যেই না পজ্জন দার শোয়ার কক্ষে এগোচ্ছি দেখি যে পজ্জন দা মুচকি হেসে বগল বাজাচ্ছে। আর আমাকে পায় কে। অমনি বনোইয়ের ওপর ওঠা সমস্ত রাগ পজ্জন দার গায়ে ঝেড়ে ফেললাম। পজ্জন দার হাতে একটা পুরোনো ক্ষত ছিলো সেখানে আমার হাত পড়তেই সে ব্যাথায় কঁকিয়ে ওঠে।
সেই পুরোনো ক্ষতের কথা জানতে চাইলে বলে, বাড়িতে ফিরে গেলে তোমার তুগুন দার কাছে জেনে নিও। যাহোক সেদিন পজ্জন দার সাথে এক বিছানায় ঘুমাই। কই পজ্জন দা তো আমার ধারে কাছে ও আসে নি। আমার হাত কিংবা পা ও স্পর্শ করে নি। আমাদের অনেক পাহাড়ি ছেলের সাথে আমরা রাত বিরাতে নির্জনে কত না ঘুরে বেড়িয়েছি। কই কখনও তো কোনো ভাবেই তারা আমাকে বা আমাদের নারীদের সাথে এতটুকু খারাপ আচরণ করে নি। তবে কেনো সেটলাররা আমাদের একলা পেলে এভাবে নারকীয়ভাবে ধর্ষণ করে? এটা কি তাদের জাতিগত স্বভাব?
আমি এসব ভেবে মৃত্যু যন্ত্রণাকে লাঘব করার চেষ্টা করছি।
মামা বাড়ি থেকে ফেরার পর আমি পজ্জন দার ক্ষত’র ব্যাপারে তুগুন দার কাছে কৈফিয়ত চাই। সে প্রথমে উত্তর দিতে চায় নি। আমার পীড়াপীড়িতে অবশেষে মুখ খুলতে বাধ্য হয়।
সে বলে,পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ দুটি দলে বিভক্ত। একটা জে এস এস আর একটা ইউ পিডি এফ। আমরা দু’জনেই দুটি দলে কাজ করি। আমাদের কর্মসূচী নিয়ে প্রায়ই আমাদের মধ্যে দ্বন্ধ সংঘাত হয়। পজ্জনরা ও একবার আমাকে খুব মেরেছিলো। কয়েকদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি।
সেদিন ও পজ্জনরা আমাদের কর্মসূচীতে বাঁধা দিতে আসলে তাদের সাথে হাতাহাতি হয়। তাতেই ও আঘাত পায়।
আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম সেসব শুনে। তারা জাতির স্বার্থে কাজ করতে গিয়ে নিজেরাই মারামারি করে। দু’জনেই আমাকে সাবধানে চলাফেরা করার অনুরোধ করতো। কারণ, সেটলাররা আগের বার পাশের গ্রাম থেকে এক মধ্যবয়সী পাহাড়ি মহিলাকে জমিতে একা পেয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু মহিলার হাতে দা থাকায় সফল হয় নি।
কিন্তু আমি তো দূরে যাই নি। আমাদের বাড়ির পাশেই খালে গিয়েছিলাম। সেটলার পাড়া তো অনেক দূরে। তারপর ও ওরা আমাদের এলাকায় কতটা সাহস নিয়ে এসে আমার ওপর নৃশংসতা চালালো।
ওরে তুগুন দা, ওরে পজ্জন দা তোমরা জাতির কাজ করতে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংশ করার খেলায় মেতে উঠেছো আর এদিকে তোমাদের ভালোবাসার প্রেয়সীর সর্বনাশ করে গেছে তারা যাদের বিরুদ্ধে তোমরা আন্দোলন করবে বলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদে নাম লিখিয়েছো।
আমি এখানে মৃত্যুর প্রহর গুনছি আর তোমরা হয়তো প্রতিপক্ষকে কিভাবে ঘায়েল করা যায় সে পরিকল্পনাই করছো।
আর ভাবতে পারছি না। দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। আলোর বদলে কুয়াশা নেমেছে। ওই পাখিটার করুন সুরের ডাক ও শুনতে পাচ্ছি না । দেহে কেমন যেন শীতলভাব এসে গেছে। কুয়াশা সরে গিয়ে অন্ধকার নেমে এসেছে। এ কিসের অন্ধকার!.....