বহুদিন আগে মিশরের নোবেল লরিয়েট আরবি কনটেম্পরারি কথাসাহিত্যিক নাগিব মাহফুজের একটা বড়সড় সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম কাগজে। সাক্ষাৎকার প্রার্থীর কাছে তিনি প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন, তসলিমা নাসরিন কেমন আছেন? পরে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা এক পর্যায়ে নাগিব মাহফুজের কাছে জানতে চান, আপনি শুরুতেই তসলিমা নাসরিনের কথা জানতে চাইলেন কেনো? নাগিব মাহফুজ বলেছিলেন, একটা সমাজে বা দেশে নারীর অবস্থা সমন্ধে জানতে পারলে ঐ সমাজ বা দেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়।
সমাজে নারীর অবস্থা যে শুধু একটা দেশের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেয় তা নয়, এটা ঐ সমাজের পুরুষের মানসিকতাকেও প্রকাশ করে।
একটা সমাজে নারীর অবস্থা কীভাবে নির্মিত হয়? পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় একটা সমাজে নারীর অবস্থা নির্মাণ হতে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির উপর অনেকাংশে নির্ভর করে, মন্দ অবস্থা, কি ভালো দু'টোই। সেটা কেমন? যেমন বাবা হিসেবে আপনার মেয়েকে আপনি পড়াশুনা, নাচ গান ইত্যাদি শিখিয়ে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী স্বাধীন ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়তা করবেন, অথবা ঘরকন্নার কাজ শিখিয়ে বিয়ে থা দিয়ে পরনির্ভর ভবিষ্যৎ বানিয়ে দিবেন।
আবার ধরুন, একটা সমাজে পুরুষ নারীকে কীভাবে দেখে, নারীর সাথে কেমন আচরণ করে, নারীকে কীভাবে সম্বোধন করে, বা কতটুকু সম্মান করে এগুলিও নারীর সামাজিক অবস্থা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। আমাদের সমাজে পুরুষ নারীকে কীভাবে দেখে? নারীর সাথে কেমন আচরণ করে? নারীকে কীভাবে সম্বোধন করে? উত্তরগুলি আমাদের জন্য সুখকর নয়।
নারীকে সম্মান করা শিখতে হয়। আপনার সমাজ যদি পশ্চাদপদ হয় তবে উন্নত সমাজ ব্যবস্থার অনুকরণে শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। দুঃখের বিষয় আমাদের তথাকথিত শিক্ষিতদের মাঝে নারীকে সম্মান করার শিক্ষাটা যথাযথ নেই। তাই নারীর প্রতি পুরুষদের একটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী কাজ করে। পুরুষ তাদের সাথে যা তা আচরণ করে, যা তা সম্বোধন করে এবং কর্তৃত্ব করে নিজেদেরকে বীর বানিয়ে পুরুষতন্ত্রকে সংহত রাখে।
এই সংহত রাখা, এটা একটা সাম্প্রদায়িক আচরণ। আসলে পুরুষতান্ত্রিকতাও এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা। এটা নারী ও পুরুষকে আলাদা সম্প্রদায় ভাবতে শেখায় এবং পুরুষ নিজেদের শ্রেষ্ঠতর ভাবে আর নারীকে ভাবে নিকৃষ্টতর। এবং এই পুরুষতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক শিক্ষা (পড়ুন অশিক্ষা বা কুশিক্ষা) জন্ম দেয় অন্যান্য সাম্প্রদায়িক আচরণ। তখন তারা নিজেদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট করে এবং নিজ সম্প্রদায়কে মহান ভাবে আর তারা নারীর প্রতি যেমন অপমানজনক আচরণ করে, অশালীন সম্বোধন করে, নিজ সম্প্রদায়ের বাইরের লোকদের প্রতিও একই আচরণ করে। এর একমাত্র কারণ অশিক্ষা কুশিক্ষা। এসব মনোভাবাপন্ন লোকেরা কখনো সুশিক্ষার সন্ধান পায় না।