জেসমিন চৌধুরী

প্রবাসী, সমাজকর্মী

শিশুকে মিথ্যা বলা কতটুকু নির্দোষ?

এক

চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে। চকলেট খেয়ে সবগুলো দাঁত ক্ষয়ে গেছে তার, এর মধ্যে বারোটাই তুলে ফেলতে হবে যাতে স্থায়ী দাঁতগুলো সুস্থভাবে সুস্থ মাড়িতে গজাতে পারে। মামুলি অপারেশন হলেও এনেস্থেসিয়া দিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে বাচ্চাটাকে।

হাসপাতালের খেলার ঘরে মনের সুখে খেলছে শিশুটি। হাসলেই কালো হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ছে, তবু মিষ্টি লাগছে দেখতে। আমরা অপেক্ষা করছি কখন ভেতরে ডাক পড়বে। হঠাৎ আমার মনে হলো, বাচ্চাটা এতো হাসিখুশি কেন? সে কি জানে না কিছুক্ষণের মধ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে?

মাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'ও কি জানে আজ কী ঘটবে?' 
'না আপা। জানলে করতে দিবে না।' 
'ওকে তাহলে কী বলে হাসপাতালে নিয়ে এলেন?'
'বলেছি ওর গায়ে জ্বর, তাই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।'
'কিন্তু এভাবে ওকে না জানিয়ে এতগুলো দাঁত তুলে ফেলা কি ঠিক হচ্ছে?' 
'ওকে তো ডাক্তার ঘুম পাড়িয়ে দেবে, কিছু টের পাবে না।' 
'যখন জেগে উঠবে?' 
'তখন সামলানো যাবে, এখন বললে অনেক ঝামেলা'।

ব্যাখ্যাটা আমার তেমন মনঃপুত হলো না, কিন্তু আমি তো শুধুই একজন দোভাষী, আমার ভাবনায় কী আসে যায়? চুপ করে গেলাম।

কিছুক্ষণ পর ডেন্টিস্ট এসে বাচ্চার সার্বিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করলেন। উত্তরগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করার ফাঁকে আমি তাকে জানালাম যে বাচ্চাটা অপারেশন সম্পর্কে কিছুই জানে না। শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। হোক ছোট্ট একটা বাচ্চা, তাকে না জানিয়ে তার মুখের ভেতরে এমন তুলকালাম কাণ্ড করাই যাবে না।

তিনি মা'কে বললেন, 'ওকে সবকিছু বলতে হবে। বাচ্চাকে না জানিয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে পারি না আমরা। নিয়ম নেই।' 
মায়ের জবাব, 'কিন্তু জানলে ও কাঁদবে তো।' 
'না জানলে জেগে ওঠে আরো বেশি কাঁদবে, চমকে যাবে। তার চেয়ে বড় কথা হলো তোমাদের প্রতি, ডাক্তারদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে বাচ্চাটা। একটু বড় করে ভেবে দেখো।'

বাচ্চার মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তারা এই নিয়মটাকে একটা উটকো ঝামেলা হিসেবেই দেখছেন।

ছোট একটা বিষয়, কিন্তু আমি এর মধ্যে একটা গভীর জীবন-ভাবনা দেখতে পেলাম। আমাদের কাছে অনেক সময় শিশুর এক মুহুর্তের কান্নাটাকেই বড় ঝামেলা মনে হয় তাই নিজের কাজকে সহজ করার জন্য আগুপাছু না ভেবে তাকে মিথ্যা কথা বলে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি। এসব মিথ্যার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা ভাবি না। আমি নিজেও সে জেগে ওঠার পর তাকে কীভাবে সামলানো যাবে সেকথাই শুধু ভেবেছি। অথচ এখানে তারা শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশের উপর এই মিথ্যার কী প্রভাব পড়বে তাও ভাবছে। অনেক দূরের ভাবনা, কিন্তু কথাটা আমার খুব মনে ধরলো। মাকে ভালো করে বুঝিয়ে বললাম, মনে হলো তিনিও বুঝলেন।

ধরে আনা হলো একজন প্লে-ওয়ার্কারকে। সে এসেই একগাল হেসে বাচ্চাটার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, 'তুমি টুথ ফেয়ারিকে চেন?' 
বাচ্চাটা এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। মা বললেন, 'ও এখনো ইংরেজি তেমন বোঝে না।' বাসায় ইংরেজির চর্চা নেই তেমন। মা-বাবা ইংরেজি তো দূরের কথা, বাচ্চাদেরকে বাংলাতেও কখনো কোনো কিসসা কাহিনী শোনান না। টুথফেয়ারির কথা জানবে কেমন করে বেচারি?

প্লে-ওয়ার্কার একটা বই খুলে বাচ্চাটার সাথে গল্প করতে বসলো। বইয়ের ভেতরে আগে চিকিৎসা হয়ে সুস্থ হয়েছে এমন অনেক বাচ্চার নানান ভঙ্গির ছবি। ওগুলো দেখিয়ে দেখিয়ে খেলার ছলে সে বাচ্চাটাকে দাঁতগুলো ফেলার প্রয়োজনের কথা বোঝাতে থাকলো, মনে হলো বাচ্চাটা ভালোই ইংরেজি বোঝে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে খুশিমনে অপারেশন থিয়েটারে যেতে রাজি হলো, নার্সের হাত ধরে লাফাতে লাফাতে থিয়েটারে গিয়ে ঢুকলো। পেছনে তার মা এবং আমি।

অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে তো আমার চোখ ছানাবড়া। এনেস্থেসিস্ট এবং আরো একজন ডাক্তার একটা বাবল মেইকার দিয়ে বাচ্চাদের মতো খেলছে। একজন টিউবে ফু-উ-উ দিচ্ছে, শত শত বাবল বের হচ্ছে এবং অন্যজন সেগুলো ফাটাচ্ছে। বাচ্চাটাকে বিছানায় শোয়ানো হলো, তার হাতে বাবল মেকার দেয়া হলো। সবাই মিলে কিছুক্ষণ খেলা হলো।

ডাক্তার যখন এনেস্থেসিয়ার মাস্ক বের করলেন তখন বুঝলাম অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তারদের এই শিশুসুলভ খেলাধূলার মর্মটা কী। এনেস্থেসিয়ার সাথে যুক্ত গ্যাসের ব্যাগটি দেখতে একটা বেলুনের মতো। ডাক্তার বাচ্চার হাতে মাস্কটা দিয়ে বললেন, এখন আমরা একটা অন্যরকম বাবল ফুলাবো। মেয়েটা খুশি মনে নিজের হাতেই মাস্কটা মুখে লাগিয়ে শ্বাস নিতে লাগলো। গ্যাসের বেলুনটা ছোটবড় হতে থাকল।

অন্যদিকে একজন নার্স তখনো বাবল ফুলিয়ে যাচ্ছে, মেয়েটার চোখে মুখে উড়ে গিয়ে পড়ছে বাবলগুলো। মেয়েটা একহাতে মাস্ক ধরে রেখেছে, অন্য হাতে বাবল ফাটাচ্ছে। মুখটা মাস্কে ঢাকা কিন্তু চোখে খুশির ঝিলিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একটু পর শেষ বাবলটা ফাটানোর জন্য প্রসারিত হাতটা ঝুলে পড়লো, বাচ্চাটা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন সে জেগে উঠবে হয়তো তখন তার মুখে অনেক ব্যথা থাকবে কিন্তু তার চেনা জগতের প্রতি, ডাক্তারদের প্রতি মনে গভীর আস্থাও থাকবে বলেই মনে হলো।

দুই

ফেসবুক স্ট্যাটাস হিসেবে লেখা উপরের গল্পটা অনেকেরই ভাল লেগেছে। তারা লক্ষ্য করেছেন বিলেতে শিশুদের চিকিৎসা কতটুকু মানবিকতার সাথে করা হয়, কিন্ত শিশুদের মনস্তাত্বিক দিকটা বুঝতে আমাদের মাবাবাদের অপারগতার বিষয়টা অনেকেরই নজর এড়িয়ে গেছে।

কিছু বিষয় বুঝতে হলে উন্নত বিশ্বে বাস করতে হয় না, মানবিক ও সাংস্কৃতিক বোধ থাকতে হয়। আলোচ্য গল্পটির মা-বাবা এই উন্নত দেশটিতে দীর্ঘদিন বসবাসের পরও নিজেদের সাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে শিশুটির সাথে আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ মিথ্যাচারিতার মনস্তাত্বিক ক্ষতির দিকটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন একবার আমার বোনেরা কার সাথে যেন গাড়িতে করে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। আমি সাথে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছিলাম, গাড়ির দরজা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকে বলা হলো, 'তোমার পায়ে তো স্যান্ডেল নেই, খালি পায়ে যাবে কী করে? যাও, স্যান্ডেল পরে এসো।' আমি নিজের পায়ের দিকে তাকালাম, তাইতো! ছুটে গেলাম স্যান্ডেল আনতে। ফিরে এসে দেখি কোথাও কেউ নেই। কী প্রতারণা! কী অবিশ্বাস! কী কষ্ট!

শিশুদের সাথে প্রায়শ বলা এসব নির্দোষ মিথ্যা আসলে কতটা নির্দোষ? বরং টুথ ফেয়ারির অস্তিত্বের মতো কিছু মিথ্যা শিশুর কল্পনাশক্তি বাড়াতে পারে, কিন্তু সে ধরনের মিথ্যা রচনার ক্ষমতা বা সাংস্কৃতিক বোধ ক'জন মাবাবার আছে?

আমাদের নিজেদের সুবিধার জন্য আমরা অহরহ শিশুদের সাথে মিথ্যা কথা বলি, যার ফলে তারা তাদের চারপাশের জগতের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। আরো অনেকের মতো এমনই এক আস্থাহীন শৈশব কাটিয়ে এসেছি আমিও। এখনো কারো উপর পরিপূর্ণ আস্থা রাখতে পারি না, খুব ঘনিষ্ঠ মানুষদের উপরও নয়। ক্ষতিটা আমার নিজেরই।

মা হিসেবে অনেক ভুল, অনেক অক্ষমতা আমার ছিলো এবং আছে, কিন্তু এই অন্যায়টা অন্তত বাচ্চাদের সাথে কখনো করিনি। আজ যখন ছেলেকে এই গল্পটা বলছিলাম, সে মনে করিয়ে দিলো- 'একবার তুমি আমাদের সাথে মিথ্যা কথা বলেছিলে। বলেছিলে দাদাবাড়ি যাচ্ছি, পরে দেখি গাড়ি অন্যদিকে যাচ্ছে। মিথ্যা কথা বলে এডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে নিয়ে গিয়েছিলে আমাদেরকে। অনেক আনন্দের ছিলো দিনটা।' আসলে ওটা মিথ্যা নয়, বরং একটা প্লেজান্ট সারপ্রাইজ ছিলো।

 

 

2294 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।