লোক সমাজের প্রেমচেতনা বা পিরিতি ভাবনা একনিষ্ঠতার মধ্যে দিয়েই চরিতার্থ হতে চায় বটে, কিন্তু কোনো মতেই তা কামগন্ধহীন বা দেহ মন নিরপেক্ষ নয়। দেহকে বাদ দিয়ে 'মন' নামক কোনো নির্বস্তুক স্বত্তার বিদ্যমানতা একে বারেই অসম্ভব। লোক সমাজে অনামি কবি যৌবন প্রাপ্ত নারী-পুরুষের প্রেমাবেগ থেকে যৌন চেতনাকে আলাদা করে রাখার ভণ্ডামি দেখান না। নারীর প্রেমলিপ্সাকে অনায়াসে "যৌবনের জ্বালা" আখ্যা দেন। যৌবনের আগমনে দু'কুল প্লাবিত হয়ে উঠে যে চেতনা তাকে বলা হয় "যৌবন জোয়ার" এই যৌবন জোয়ারে ভেসেই নারীর অকপট ভাবনা-
"সহিতে পারিনা আর কাম-শরাসন
অবলা বলিয়া সদা করে জ্বালাতন
মধু মাসে কে থাকিবে ভাবিয়া আকুল
ক্রমে যেনো ভরা নদী ভাসে দু'কুল ..।"
এই অকপট ভাবনার স্বাভাবিক চরিতার্থতার সমাজ স্বীকৃত পথ একটিই, তার নাম-বিবাহ। কিন্তু বিবাহ নারীর বাসনা চরিতার্থতার গ্যারান্টি না হয়েই সে বাসনাকে বরং গলাটিপে হত্যা করে, বিবাহের মাধ্যমে হৃদয়হীন পুরুষতন্ত্রের বেদিতে নারী তার হৃদয়াবেগকে বলি দিতে বাধ্য হয়। শ্রেণি বিভক্ত সমাজের পুরুষতন্ত্র "বিবাহ" নামক ইনিষ্টিটিউশনকে শ্রেণি শাসন ও পুরুষ আধিপত্যকে নিরঙ্কুশ রাখার কাজেই ব্যবহার করেছে। পুরুষের বহু বিবাহকে বিধিসম্মত করেছে। পুরুষের জন্য বিচার বহির্ভূত যৌনাচারের সদর দরজা সহ অলিগলি পথও খোলা রেখেছে; কিন্তু নারীর কাঁধে তথাকথিত সতীত্বের বোঝা এমনভাবে দিয়েছে যে, তার পান থেকে চুন খসলেই তাঁকে ব্যভিচারের দায় ভাগিনী হতে হয়েছে। আবার পুরুষই ব্যভিচারের পথে ঠেলে দিয়ে একদল নারীকে বহু পুরুষের ভোগের পণ্য বানিয়েছে, অথচ সেই নারীদেরই তারা বেশ্যা বা পতিতা আখ্যা দিয়ে সমাজ বহিস্কৃত ও ঘৃণ্য করে রেখেছে।
নারী কিন্তু বিবাহ ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েই তাঁর যৌনতৃষ্ণা ও প্রেমাবেগকে সার্থক করে তুলতে চেয়েছে, সন্তানের জননী হয়ে বাৎসল্যরসে অবগাহন করতে ও নিজেকে সম্প্রসারিত করতে চেয়েছে, যে অজানা অচেনা পুরুষের সঙ্গে তাঁকে বিয়ের বাঁধনে বেঁধে দেয়া হয়েছে, সেই পুরুষকেই নারী বলেছে পতিধন। এই পতিধনের কাছেই সে তাঁর সর্বস্ব সমর্পণ করে ধন্য হতে চেয়েছে; কিন্তু ধন্য হওয়ার বদলে প্রায়শই তাঁকে ব্যর্থতা বরণ করতে হয়েছে। তাঁর সেই ব্যর্থতা জনিত ক্ষোভ ও হাহাকারের কথাই পুরনো লোক সাহিত্যের বিভিন্ন নারীর জবানীতে শুনতে পাওয়া যায়। স্ত্রীকে যখন ঘরে একলা ফেলে রেখে স্বামী বাইরে (বিদেশ) চলে যায়, তখন স্ত্রী কন্ঠে আকুতির দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘ হয়-
"এই মোর নচিবের লেখা একলা শুইয়া আছি।"
শুধু একলা শুয়ে থাকার যন্ত্রনাই নয়, উপযুক্ত সময়ে সন্তান ধারণ না করতে পারার দুঃখও নারীকে ক্ষুব্ধ ও বেদনার্ত করে তোলে। লোক সঙ্গীত রসজ্ঞ মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন কাশিমপুরী লিখেছিলেন, "নারীর বারো মাসে বারো বার ঋতু হইয়া থাকে, গর্ভধারণের ফুল ফোটে; কোনো দিন এই ফুলের অবস্থা কেমন হয়, তা স্বামী জানে বা জানা উচিত। এই সময়ে যে নারীর স্বামী বিদেশে থাকে তাঁর ফুল ফোটা নিরর্থক।
স্বামীর এরকম প্রবাস কিংবা স্ত্রীর প্রতি অবহেলা কিংবা সন্তান প্রজননে স্বামীর অক্ষমতা-অনেক সময়ই নারীকে বিদ্রোহিনী করে তোলে। লোক সমাজের এই বিদ্রোহিনী নারীরা যখন স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষে আসক্ত হয়ে পড়ে, তখনই তাঁদের অনেকেরই মধ্যেই বেপরোয়া ভাবনা উদয় এবং আচরণেও তারা বেপরোয়া হয়ে উঠে বিদ্রোহিনী নারীর এমন বেপরোয়া ভাবনা ও আচরণের অনেক পরিচয় বিধৃত হয়ে আছে লোক গাঁথায়, সঙ্গীতে ও প্রবাদ প্রবচনে। বিড়ম্বিত বিবাহিত জীবনে অক্ষম স্বামীর প্রতি বিদ্বেষে ও প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের তীব্র আকুতিতে নারীর এমন মনে হয় যে -
"পরের অধীন নারী লো এই সে হইল দায়
মনে লয় পতিরে (স্বামী) কাইট্টা দিতাম বন্ধের পায়।"
বিবাহিত জীবনে অতৃপ্ত নারীকে সেই বন্ধুর পথে হাঁটতে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক অনেক লাঞ্চনা-গঞ্জনা সইতে হয়। অনেক কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিতে হয়। আরো চিরন্তন সত্য আবার এরকম কলঙ্কিনি হয়েও -এবং অনেক লাঞ্চনা-গঞ্জনা সহ্য করার পরও নারীকে তার প্রেমাস্পদের কাছে প্রতারিত হতে হয়। পুরুষ নিজেকে মনে করে ভ্রমর। ভ্রমরের মতোই ফুলে ফুলে মধু খাওয়ার -অর্থ্যাৎ বহু নারীভোগের-অধিকারকে সে একান্তই বৈধ বলে মনে করে, প্রেমে একনিষ্ঠ থাকার কোনো দায়ই যেন তার নেই। তাই পুরুষের প্রেমকে অনেক সাবধানী নারীই বাজিয়ে দেখতে চায়, সহজে তার কাছে ধরা দেয় না । এরকম "অধরা" নারীকে করায়ত্ত করতে না পেরেই হতাশ প্রেমিকরা নারী নিন্দায় মুখর হয়ে উঠে, নারীকে কেবলই ছলাকলা-নিপুনা ও রহস্যময়ী রুপে চিত্রিত করে-
"নারীর প্রেমে মইজ্যনা 'অমল'
নারীজাতি কালসাপিনী-
পুরুষমারা কল,
প্রেমরশি গলায় ফাঁসি লাগিবে যখন-
তোমায় ছাড়ি ভিন পুরুষে দিবে তারা মন।"
পুরুষের এই রকম দৃষ্টিভঙ্গিই নারীকে প্রতিনিয়ত হেয় করে চলছে, নারীর মানবিক অধিকার অস্বীকার করছে, ধর্মের বিকৃত ভাষ্য তৈরি করে নারীকে বলছে "নরকের দ্বার"।