পশ্চিমের নিমগাছ আমাদের বাড়ীর সকল ভালোবাসা মেখে চেয়ে থাকে তাঁর খোলা জানালার দিকে। অগুনতি সবুজ টিয়ে এসে ছেয়ে যায় গাছ্টা। এসময় ফুল শেষে ফলের টসটসে রসে পাগল সবুজ টিয়েরা। বাঁকা লাল ঠোঁটে টুক টুক করে খায়, উড়ে যায় আবার আসে। সারাদিন সারারাত অনন্ত আকাশজুড়ে কেবল টিয়েদের আনাগোনা।
খোলা জানালার পাশে বসে মা নামাজ পড়েন। কখনো কোরান পড়া শেষে, তাঁর প্রিয় পানের বাটা নিয়ে বসে সুপারি কেটে পান মুখে দেন। মা জানালা দিয়ে তাকালেই নিমফুল ঝরে যায় আঙিনায়।
মাটির চুলোর ভেতর ঠিক মাঝখানটাতে একটা বাঁশের ফুকনি বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে করাত কল থেকে আনা কাঠের তুষ গাদানো হলে, আস্তে করে ফুকনিটা তুলে নিতেন মা। মাঝখানে একটুখানি কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে গুল গুল করে জ্বলত সেই চুলো। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে আমার বাবার মতো অনেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। মা খুব সাম্প্রতিক শিখেছেন রান্নার নতুন এই পদ্ধতি। চেলা কাঠের অভাবে আজ কিছুদিন ধরে আমাদের পাড়ায় প্রায় সব বাড়ীতেই এভাবে রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। এতে অবশ্য ভালই হচ্ছিলো একরকম, একচুলো কাঠের ভুষিতে দুপুরের যাবতীয় রান্না শেষ হয়েও গনগনে আগুন থাকতো চুলোয়। মাঝে মাঝে মা সেই চুলোতে আমাদের জন্যে ডিমের পুডিং বা ডিম ময়দা পামওয়েল চিনি মিশিয়ে একটা ছোটমোটো পাউন্ড কেক বানাবার একটা রিস্ক নিয়ে ফেলতেন।
তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র দু'এক বছর হলো। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরেছেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। পৃথিবীর অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলোর মতো সকল মানুষের জন্যে রেশনের মাধ্যমে খাবারের সমবন্টন শুরু করেছেন। প্রতিটি পরিবারে বন্টন ব্যাবস্থার মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনের সামগ্রী বিতরন হচ্ছে। আমাদের পাড়ায় প্রতি বাড়ীতে ছেলে বুড়ো সবার নামে একটার বদলে দুই তিনটা করে রেশন কার্ড আছে। সব বাড়িতে রেশনের চাল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনি, ঘি, সয়াবিন, পাম অয়েল এসবের অভাব নেই। কিন্তু কোথায় যেন তবু একটা নেই নেই হাহাকার।
একবার দুধের অভাব হলো খুব, মনে পড়ে ঢাকায় আমাদের এক আত্মীয়, বাচ্চার জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে একটিন দুধ কিনতে গিয়ে নাজেহাল হলেন। কেরসিনের অভাব, চালের অভাব খুব প্রকট আকার নিলো। স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর সারা দেশেই কোনো ধানের জমি চাষ হয় নি। আমাদের বর্গাদার দেবেনদত্ত খুলনার বোটিয়াঘাটা, গল্লামারীতে পাকিস্তানী মিলিটারীর গনহত্যার ভয়ে দেশ ছেড়ে পায়ে হেঁটে জীবন মরন যুদ্ধ করে পৌঁছেছিলেন ভারতের শরণার্থী শিবিরে। দেবেন মামারা ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে ফিরেছেন বটে কিন্তু জমির চাষবাস শুরু করতে পারেন নি তখনো, ফলে আমার মায়ের সোনার পায়ের ছাপ নেই উঠোনভরা সোনার ধানে এবছরেও। চাটাই ভরা সোনার ধান দেখে চোখ মুখ জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছে না মায়ের তবু সে মুখ বুজে আছে স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দে।
আমাদের বাড়ীর কেউই সেসময় রুটি খেতে অভ্যস্ত ছিলো না। কথিত আছে খুলনার মানুষ রোজকার ভিত্তিতে রুটি খায় না। শখের বসে শীতের দিনে তেলওয়ালা হাঁসের মাংশের সাথে চালের রুটি, বা ছিতরুটি খায় বছরে দু'একবার, সেই তাদের রুটি খাওয়া। তো সেসময় মা একটা অভিনব খাবার বের করলেন। আমাদের বাড়ীতে থাকতো যবেদ আলী। স্বাধীনতার আগে খুলনার আরো দক্ষিন থেকে আমাদের বাড়ীতে রাজের জোগাল দিতে এসে, আমার মাকে মা ডেকে চিরদিন সে থেকে গিয়েছিলো। মা তাকে বিয়ে টিয়ে দিয়েওছিলেন, তো সেই যবেদ আলীকে দিয়ে রেশনের দোকান থেকে গম এনে, তা ধুয়ে মুছে শুকিয়ে আবার পাঠাতেন আমাদের পাড়ার নান্নুমিয়ার আটা ভাঙ্গানো কলে। সেই গমের আটায় একটু একটু ঝিরি ঝিরি পানি ছিটিয়ে দিয়ে সেটা ঝাঁঝরিতে দিয়ে সেদ্ধ করে এক রকম ঝুর ঝুরে আটার ভাত বানাতে শিখলেন। আমার মায়ের এসব কাজের উৎসাহদাতা ছিলেন আমাদের বাড়ীর ঝড়ুর মা খালা। সেই ঝুর ঝুরে আটার ভাত তরকারি দিয়ে খেতে বা দুধ দিয়ে দুধভাতের মতো খেতে কিন্তু মন্দ লাগতো না।
আমরা খুলনার মানুষ, ভাত হলো আমাদের প্রধান খাবারের চেয়েও বেশী। আমাদের অঞ্চলে সকালের নাস্তাও গরম ভাত। দুপুর, রাত সব বেলাতেই গরম ভাত খাবার প্রচলন। সকালে ছেলে মেয়েরা গরম ভাতে ঘি আলুভর্তা, গরম ডাল, ডিমভাজা এসব খেয়ে স্কুলে যায়। বাড়ীর পুরুষেরা যায় কাজে। আমরাও তাই করতাম।
সেইসময় এই আটার ভাত বাড়ীতে একটা থমথমে পরিবেশ তৈরি করেছিলো। চালের অভাব তো ছিলোই তবু অল্প একটু ভাত সবার পাতে সমান ভাগ করে দিতেন সেই অভিনব আটার ভাতের সাথে আমার অভিযোগহীন নিরব মা। বাবা তখন বদলীর চাকুরী উপলক্ষ্যে রামপাল, বাগেরহাট, ফকিরহাট ছুটে বেড়াচ্ছেন। আমাদের এতোগুলো ভাইবোনের লেখাপড়া, ভরনপোষণের দায়ভার তাঁর একার কাঁধে তুলে নিয়ে ক্লান্তিতে নীচু হয়ে আছেন তিনি। দিনগুলো তবু উজানেই বয়ে যায়।
বাবার মৃত্যুর পরে আমাদের মধ্যবিত্ত্য জীবনে সেই টানাপোড়ন আবারও শুরু হলো। মা একাই কেমন করে সব দিক দেখেশুনে চালিয়ে নিয়েছেন ভাবতেও অবাক হই। তখন মাঝে মাঝে মা যেতেন আমাদের গ্রামের বাড়ীতে। যেখানে আমাদের পৈত্রিক ভিটা, বাড়ী, গাছ গাছালি ছাওয়া, পাখী ডাকা সেই অবাক বিস্ময় ভরা গ্রাম।
আমার নানা বাড়ীর গ্রাম আর দাদা বাড়ীর গ্রামকে আলাদা করেছে এক নদ ভৈরব। দুরন্ত সে ভৈরব। কালে কালে সেই নদ প্রশান্ত হয়েছে, ক্ষীণকায় হয়ে বয়ে চলেছে খুলনা বাগেরহাট আলাইপুর হয়ে বহুদূর। এই ভৈরব নদ পার হলেই তাঁর বাবার বাড়ী। ফেরার পথে সেখানে থেমে বিরাম নিয়ে আসেন মা। তো সেবার মৌভোগ থেকে মা ফিরছেন সঙ্গে আমার ছোট মামী। বহুদূর গ্রামের রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এসেছেন মধ্য বয়সী একাকী দুই নারী। সন্ধ্যানাগাদ পৌঁছেছেন আমার নানাবাড়ীর কাছাকাছি এক ঘাটে। নৌকো, মাঝি কিছুই নেই কোথাও। ছোট্ট নদ, এক সাঁতারে পেরিয়ে যাবেন ভেবে কোমরে কাপড় পেঁচিয়ে ওরা দু'জনে নদীতে নেমেছেন একসাথে। মায়ের হাতে জোড় বাঁধা বাঁধা নারকেল। নানা রকম ফল ফুলুরি, সেসবের ওজনে মা আর সামলে নিতে পারছেন না, হঠাৎ স্রোতের টানে মা তলিয়ে যাচ্ছেন, মা ভেসে যাচ্ছেন। আমার আদুলগায়ে চলা মা ডুবসাঁতারে পেরে উঠছেন না কিছুতেই ঐ দুরন্ত ভৈরবের সাথে। মা অজ্ঞান প্রায় বহুদূর ভেসে যাচ্ছেন আর যেতে যেতে দেখছেন ওপারে দাস পাড়ার বৌঝিরা নদীকে সন্ধ্যেপ্রণাম জানিয়ে যে রক্তজবা ভাসিয়ে গেছে তারই দু'একটি ছেড়া পাপড়ি এসে তাঁকে সাজিয়ে দিচ্ছে চির অজানার সাজে।
সেবার কেমন করে যেন ছোট মামী তাঁকে টেনে টুনে বাঁচালো সেকথা কেউ জানে না। বাড়ী ফিরে মা কোনদিনও আমাদের কাছে বলেন নি সেকথা। সেসব কথা কেবল আমাদের পশ্চিমের নীম গাছের, ছোট্ট সাদা ফুলের মতো মা'র বুকের পরে ঝরে যায়।
বাবাকে হারিয়েও মা কিন্তু সেই সব আকালের দিন পাড়ি দিয়ে বিজয়ীর বেশে আবার সব উদ্ধার করেছেন একা হাতে। তাঁর সন্তানদের শিখিয়েছেন সকল কুসংস্কার পায়ে দলে মুক্তমনে মাথা উঁচু করে বাঁচতে। শিখিয়েছেন সততা, সত্যনিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস আর কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে। আমাদের প্রতিটি ভাইবোনকে শিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছেন। দীক্ষা দিয়েছেন মানবতার মন্ত্রে। দিয়ে গেছেন মানুষের পরিচয়ে বাঁচবার প্রেরণা।
মা নেই। বাড়ীর মধ্য উঠোনে নেই সেই রক্তলাল শিমুলের গাছটা। যে গাছের ছায়া মেপে মা বলে দিতেন সময়। বলতেন 'স্কুলের বেলা হল রে লুতু, আয় চুল বেঁধে দেই।' পশ্চিমের নিম গাছ আজ আর নেই, তবু তারই অগনিত সবুজাভ সাদা ফুলের ম ম গন্ধে বাতাস কেঁদে ফেরে একা।
চলবে…