নায়না শাহ্‌রীন চৌধুরী

সঙ্গীত আর লেখালেখি’র সাথে দীর্ঘদিন পথ চলা। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী ও গীতিকবি। কাজ করছেন অডিও শিল্প, মঞ্চ ও ফিল্মেও। এ পর্যন্ত তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। জীবিকা নির্বাহে জ্বালানী ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।

সৌদি আরবে গৃহকর্মী নির্যাতন অথবা রাষ্ট্রীয় অক্ষমতা

সম্প্রতি একটি চ্যানেলে সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী নিগ্রহের ঘটনার একটি ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে দেখতে পেলাম। (লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/DesperatelySeekingDhaka/videos/1955444628039595/)

মেয়েটি একটি টেইলরের দোকানে গিয়ে বাংলাদেশী কর্মীদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলো। কাকুতি মিনতি করেছিলো। বলেছিল তাকে বাঁচাতে, কিন্তু মেলেনি আশ্রয়। সৌদি মালিক তাকে ধরে নিয়ে গেছে চ্যাং দোলা করে। তার হাত ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গেছে যা মনে হলো। জানিনা তার এখন কি অবস্থা। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী মহোদয় পুরোপুরি কাঠের চশমা চোখে বললেন, এধরনের কোনো অভিযোগ নাকি তিনি পাননি। এর থেকে আমাদের দেশে নাকি নির্যাতন বেশি হয়। ভালো কথা। উনি ওনার পদে থেকে ওনার বিবেক বুদ্ধিতে যা এসেছে তা বলেছেন। কিন্তু অন্য সবাই তো চোখ বন্ধ রাখছেন না। সৌদিতে গৃহকর্মীকে কে নিগ্রহের ঘটনা কি নতুন শুনলেন? শোনেন নি তো? ওখানে এটা ওপেন সিক্রেট যে তারা বাড়ির কাজের মেয়েটিকে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আই রিপিট, “যা ইচ্ছা তাই।” তো মানলাম, এখন আমাদের মেয়েরা কম যাচ্ছে। কিন্তু যারা থাকছে তাদের কথা আমরা একটা বার ভাববো না এত ঘুম কাতুরে আমরা? যে মেয়েটা প্রকাশ্যে বেরিয়ে উপায়ন্তর না দেখে সাহায্য প্রার্থনা করলো তার জন্য আমরা কিছুই করতে পারলাম না। ওরা আমার দেশের বোনটাকে ধরে নিয়ে গেলো। সৌদি প্রবাসী ভাইদের কাছে প্রশ্ন , “আপনারা কোন লজ্জায় বেঁচে আছেন? লজ্জা করে না? একবার ও তো বাধা দিতে দেখলাম না। আপনারা কি আসলেই মানুষ নাকি আপনারাও মনে করেন দাসী বাঁদিদের অত্যাচার করা, সেক্স করা অবৈধ নয়।

সৌদিতে অবস্থিত বাংলাদেশী এম্বেসি ই বা কি করবে? মন্ত্রী মহোদয় তো কোনো দোষ পাচ্ছেন না।

আমাদের সত্যি খুব সৌভাগ্য যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং একটি বিশাল রাজনৈতিক দলের প্রধান - নারী। না হলে, এই দৃশ্য দেখেও আমরা নির্বিকারে হাই তুলতে পারি। ওই বেটি একটা কামের বেটি, ওরে সৌদি শেখ পিটান দিসে, আকাম করসে, বেশ হইছে। কামের বেটিরে এইগুলা করাই যায়। সবার সামনে টাইনা হেঁচড়ায়া হাত পা ভাঙ্গা যায়। আর আড়ালে ছ্যাকা দেওয়া, মাইর দেওয়া, বাড়ির সব পুরুষ মিলে ধর্ষণ করা, প্রেগন্যান্ট করে লাত্থি দিয়ে দেশে পাঠায় দেওয়া যায়। ২০/৩০ জন মরলে কার কি। কারণ আমরা তো মিসকিনের জাত। তাই না?   

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের সঙ্গে নারী গৃহকর্মী নিয়ে চুক্তি সইয়ের পর এখন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে গেছেন প্রায় দেড় লাখ নারী। এ বছরের প্রথম চার মাসে সৌদি আরবে যাওয়া নারী গৃহকর্মীর সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩১১।

সৌদি আরবে যাওয়া প্রায় ৫০ জন নারীকর্মীর অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গত বছর দূতাবাস ঢাকায় একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিলো। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডজনখানেক কারণে বাংলাদেশের নারীকর্মীরা ঝুঁকিতে পড়ছেন। এসব কারণের মধ্যে আছে ধর্ষণ কিংবা ধর্ষণ-আতঙ্ক, গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রীর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, বেতন না দেওয়া, ফোন কেড়ে নেওয়া, নির্যাতনের পর পালিয়ে গেলে থানায় চুরি ও নাশকতার মামলা দেওয়া, নির্যাতনের পর পালিয়ে পুলিশের আশ্রয়ে গেলে আবার আগের নিয়োগকর্তার কাছে ফেরত পাঠানো, অসুস্থ হলে চিকিৎসা না করা, বেশি অসুস্থ হলে রাস্তা কিংবা দূতাবাসের সামনে ফেলে যাওয়া এবং দূতাবাসকে না জানিয়ে ক্রীতদাসের মতো এক এজেন্সি থেকে অন্য এজেন্সিতে বিক্রি করে দেওয়া উল্লেখযোগ্য। এ অবস্থায় সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী পাঠানো সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার পক্ষে মত দেওয়া হয় ওই প্রতিবেদনে।

ওই মূল্যায়ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে নির্যাতনের কারণে অন্তত পাঁচজন আত্মহত্যা করেছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ জন, যাঁদের দু’জন সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। আর বাকিরা নানা রকম অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন প্রাণ বাঁচাতে ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হয়েছেন।

তো এই হলো অবস্থা। এখন এসব পড়ে যার যার চেয়ারে বসে হাই তোলেন। কারণ ভাবার মতো আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তাই না?

3334 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।