নারীর স্বপক্ষে বা পুরুষদের নানা অনাচারের বিপক্ষে আমরা যারা কথা বলি তারা যে জীবনের কত ক্ষেত্রে নারীদের দ্বারাই শোষিত নিষ্পেষিত, অপমানিত ও লাঞ্ছিত তা কি সবসময় বলা হয়? পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী বলেন অথবা পারিবারিক বা ব্যক্তিগত জীবনে হতাশ, নেতিবাচক ব্যবহারে অভ্যস্ত নারীরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ ব্যবহার ছড়িয়ে দেন অন্য কারো মধ্যে। এই ছড়িয়ে দিয়ে তারা তাদের উপর হওয়া অন্যায়ের (যেগুলোকে তারা ন্যায় জ্ঞান করেন) যন্ত্রণা অন্য কারো উপর দেখে নিজের যন্ত্রণার একটু উপশম খোঁজেন বোধকরি। এটা এক ধরণের স্যাডিস্ট প্লেজার, কিন্তু এই মানুষগুলো যে একধরণের অসুস্থতার মধ্যে আছেন তারা সেটা টের পান না। যারা ভুক্তভোগী, তারাও কি বুঝি?মায়ের মতো আপন কেহ নাই রে... গানটার কথা মনে আছে। যখন একটা মেয়ে ইভ টিজিং এর শিকার হয়, তখন কি মা বলে না, তোকেই কেনো জ্বালায়? অথবা, স্বামী কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে অথবা ধর্ষণের শিকার হয়ে যখন একটা মেয়ে মায়ের কাছে আশ্রয় খুঁজতে যায়, তখন গর্ভধারিণী মা যখন ঘেণ্ণায় মুখ কুঁচকে বলে, ‘মরতে পারিস না...’ তখন সেই ঘৃণার বাষ্পে কতো শতাংশ মেয়ে বাংলাদেশে মরে যায় আমার জানতে ইচ্ছা করে। বয়ঃসন্ধিতে মেয়ের বুকের গ্রোথ যাতে পুরুষদের উত্তেজনা না বাড়ায়, তার জন্য মায়েদের কত তৎপরতা। ‘দুধ গালা’, দমবন্ধ অন্তর্বাস, ওড়না, বড় গলার জামা মিনিটে মিনিটে অ্যাডজাস্ট করার চেষ্টা, ব্রার ফিতা বেরিয়ে থাকলো কিনা অথবা ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে কিনা, সেটা দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে মেয়ে জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্প সংস্কৃতি, বই, খাবার, বন্ধুত্বের মতো বিষয় গুলোর চেয়ে শরীরকে দেখে বড় করে। সে এই জ্ঞান অন্যদেরও ছড়িয়ে দিতে চায়। যখন সে তার থেকে কম কাপড় পরা কোনো মেয়েকে দেখে তখন সে সেই মেয়ের কুৎসা গায়। কারণ সে জেনে এসেছে যে মেয়েটা ওড়না সামলাতে পারে না, যে মেয়েটা হিজাব করে না, যে মেয়েটার পিঠের কাপড় ভেদ করে ব্রা বোঝা যায় সে মেয়েটা ভদ্র না। ঐ মেয়েটা ভদ্র না, যে রাত করে বাড়ি ফেরে। যে মেয়েটা নিউজ চ্যানেলে কাজের সুবাদে শহরের বাইরে রাত কাটায় সে মেয়েটা এর তার সাথে যৌনকর্ম ও অপকর্ম করে। যে মেয়েটা হন হন করে শিরদাঁরা টান টান করে চলে, ও বেহায়া। যে মেয়েটা তর্ক করে, সে বেয়াদব। যে মেয়েটা যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে সে নিজেই খারাপ। আর এই বিষয়গুলো মেয়েরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে ছড়ায়।
আপনার স্বামীর বা আপনার ছেলের সাথে অন্য একটি মেয়ের সম্পর্ক। দোষটা মেয়ের, একদম আপনার স্বামী বা ছেলের নয়, তাই না? ছেলের বৌয়ের বাচ্চা হয় না, ডাক্তারী পরীক্ষা ছাড়াই বলে দেন, বউ বাঁজা। আপনার ছেলের কোনো অক্ষমতা নাই। চাকরিতে আপনার পাশের টেবিলের মেয়েটি প্রমোশন পেলো, মেয়েটার চরিত্র নিয়ে, বা বসের সাথে কাল্পনিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে মুখ চুলকে ওঠে, তাই না?
এখন প্রশ্ন আসে, কেনো। ঐ শুরুতেই বললাম, এখানে বিরাট একটা সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক বিষয় লুক্কায়িত আছে। দিনের পর দিন শোষিত আর সব কিছুতে নিরাপত্তাহীন মনে করা বাঙালি নারী সমাজ গাদা গাদা ডিগ্রি নিয়েও পরিবারপ্রোথিত অশিক্ষা, কুসংস্কার আর চোখ সওয়া অন্যায়কে ন্যায় বলে মানে। বিশদ, সমাজ বিজ্ঞানী বা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষকরা ভালো বলতে পারবেন।কিন্তু, এ ধরনের আচরণ, আমাদের মেয়েদের মনের এই ধারনা, আমাদের নারীদেরকেই ভাঙতে হবে। আমাদের অনেক বিষয়ে জ্ঞানের অভাব। কোনটা ঠিক কোনটা অন্যায় সে ধারনাও অপ্রতুল। আমাদেরকেই আমাদের পরিবার থেকে জানাতে হবে সেসব। অন্যায়গুলো অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় ভেবে চুপ করে থাকলে সমাজ আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা মেয়েরা যদি এক না হই, একটা সমতার সমাজের যে লড়াই আমরা করছি প্রতিনিয়ত তার সুফল আমরা কেনো, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও ভোগ করতে পারবে না।
একটি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের উদাহরণ টানতে হচ্ছে। তাদের নারী সদস্যরা কিন্তু বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে নানা কিছুর বয়ান দেন। তারা কিন্তু এক। আমরা কি পারি না, সুন্দর যে সমাজের আমরা স্বপ্ন দেখি তার জন্য ব্যক্তিগত ভাললাগা মন্দ লাগার ঊর্ধ্বে উঠে একত্রে সহমর্মী হয়ে কাজ করতে? ‘ওর মতাদর্শ, চাল চলন ভাল লাগে না’, কিন্তু একটা জায়গায় তো আমরা এক, আমরা নারী ও শিশু বান্ধব একটা সমাজ চাই, যে সমাজ চলবে সমতার মাপকাঠিতে, যেখানে কোনো পক্ষ শোষিত হবে না। পথটা বন্ধুর, সহজ করে নিতে হবে। নিতে পারবো, তাই না?