চিন্তার জগতে এত ঝামেলা, কূটক্যাচাল রাখলে তো ঝামেলা। শুধু ঝামেলাই নয়, রীতিমতো ঝামেলা। হিজাব, বোরকা, টুপি, পাঞ্জাবী মানেই মৌলবাদী- এই চিন্তা রীতিমতো ঝামেলাজনক চিন্তা। আমি জানি, এই লিখাটি লেখার পর অনেকেই আমাকে মৌলবাদী মনে করবেন। যেমন: অনেক বিশিষ্ট নারীবাদী আমাকে নারীবিদ্বেষী মনে করেন। তাতে আমার কিচ্ছুটি যায় আসে না। চিন্তার দুয়ার প্রসারিত সবার থাকে না, দেখার মনস্তত্ব সবার থাকে না। তাই বলে সত্যটাকে কেউ জেনেবুঝেও সত্য বলবে না তা নয়!
একজন বোরকা পরা, হিজাব পরা, টুপি পরা, পাঞ্জাবী পরা মানুষ প্রগতিশীল হয়। আমার দেখা অনেক আছেন। যারা এরকম বোরকা, হিজাব, টুপি পরেও প্রগতিশীল চিন্তাকে লালন-পালন করেন। বরং যারা সবসময় এদেরকে খাটো বানানোর অপচেষ্টা করেন, এদেরকে ছাগু/টাগু বানিয়ে নিজেদেরকে বৃহৎ পরিচয় দেন- তাদের প্রগতিশীলতা একটা বিষয়ে। সব বিষয়ে নয়। কিন্তু প্রগতিশীলতার ব্যাখ্যা কিন্তু তা নয়। হ্যাঁ, একজন চিন্তাশীল মানুষ, বিজ্ঞানসম্মত মানুষ কেনো বোরকা পরবে, হিজাব পরবে, টুপি পরবে- সেটা ভিন্ন আলোচনা, ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে এই পোশাকগুলো মানেই মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক- তা কিন্তু নয়!
থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট, টিশার্ট পরেও মানুষ মৌলবাদী চিন্তাকে ধারণ করে। এখন বুঝতে হবে মৌলবাদী চিন্তাটা কী? এই যে, আমি থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট পরি বলেই অন্য কারো থ্রি কোয়ার্টারপ্যান্টই পরতে হবে- এটাই মৌলবাদী চিন্তা। আমারটাই সঠিক, আমার লাইন, মত, পথই সঠিক আর সব ফেইক- এই চিন্তাগুলো মৌলবাদী চিন্তা। আমার সাথে মিশলে, আমার সাথে কথা বললে অমুকের সাথে মেশা যাবে, কথা বলা যাবে না- এটাও মৌলবাদী চিন্তা। নারীবাদী না হলে অপর নারীকে যা-তা বলে গালি দেওয়াটাও মৌলবাদী চিন্তা।
নাস্তিকতার নাম করে আর সকলকে গালি দেওয়াও মৌলবাদী চিন্তা। মৌলবাদী চিন্তা মানে মৌলভীরাই ধারণ করবে এমন কিন্তু নয়! মৌলবাদী চিন্তা একজন চরম উদার মানুষও ধারণ করতে পারে- যদি না তার দর্শন ঠিক থাকে। সবকিছুর মূলে ওই দর্শন। হ্যাঁ ‘মানুষে’র দর্শন, মনুষ্যত্ব্যের দর্শন।
বিশেষ করে ২০১৩ সালের পর এই চিন্তাটাকে চরমভাবে একটা গোষ্ঠি ধারণ করছে তা হলো বাচ্চাদেরকে টুপিওয়ালা মানুষ দেখলেই বলছে ‘রাজাকার’। এটা চরম অন্যায়। পোশাক দিয়ে জাস্টিফাই হয় না কে মৌলবাদী আর কে অমৌলবাদী। এই চিন্তা একটা ছোট বাচ্চার মধ্যে দেওয়া খুবই অন্যায়। মাদ্রাসার অনেক ছাত্রই মানুষের চিন্তাকে ধারণ করে, মানবতাকে ধারণ করে। এখন প্রশ্ন তুলতে পারা যায়- মাদ্রাসার শিক্ষানীতি নিয়ে, মাদ্রাসা যারা পরিচালনা করে তাদের দর্শন নিয়ে। কিন্তু, ছোট ছেলেমেয়েরাগুলোকে এক কথায় সমাজ বিচ্ছিন্ন মনে করাটা একপ্রকার অন্যায়।
হিজার পরে, বোরকা পরে দিনের পর দিন মিছিল করছে, শ্লোগান দিচ্ছে, জেল জুলুম-হুলিয়া মাথায় নিয়েও মাঠে আছে- এমন সংখ্যা কিন্তু কম নয়! গ্রামের একজন সহজ-সরল মানুষ টুপি, পাঞ্জাবী পরেও যে পরিমাণ উদার- তা কিন্তু যারা ওদেরকে মৌলবাদী বলে খারিজ করে তারা নয়। বহু এরকম সাধুকে চেনা আছে! প্রত্যেকের চিন্তা-চেতনায়-অস্থি-মজ্জায় মৌলবাদী চিন্তাকে ধারণ করেন। খোলা চোখে দেখলে যা কোনোদিনই বিশ্বাস করা যাবে না, সবসময় প্রগতির কথা বলে, সাম্যের কথা বলে, সমাজতন্ত্রের কথাও বলে- কিন্তু ভিতরে পোষণ করে চরম মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক চিন্তা। এর সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়। আপনার/আমার পাশে এর সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়! ঠিক নারীদের বেলায়ও এ কথাটিই প্রযোজ্য। যে নারীটি এরকম বোরকা, হিজাব পরে সবসময় কিন্তু কোনো অন্যায় দেখলে, অবিচার দেখলে আপনার/আমার আগে দৌড়ে যায়, পাশে দাঁড়ায়। দেখে দেখে, বেছে বেছে যায় না। কোনটায় গেলে ফেসভ্যালু থাকবে, কোনটায় গেলে থাকবে না এ চিন্তাও করে না।
মূলত, পোশাককে সম্পদ করে কোনো মানুষকে খাটো করা বা ছোট করা হীনমন্মতার কাজ। যে কাজটি আমাদেরকে ধীরেধীরে জনবিচ্ছিন্ন করা ছাড়া আর কিছু করছে না।
হ্যাঁ, আমার পোশাক দেখে একজন বোরকাওয়ালী ভুঁ কোচকায়, মনে মনে গালিও দেয়, টুপিওয়ালারা মনের ভিতর কামবাসনায়
জাগায় ফাঁক পেলে হস্তমৈথুনও করে ফেলে। এই সংখ্যাটাই বেশি। তাই বলে আমি পোশাক বোরকা, টুপি হওয়ার কারণেই এই গোষ্ঠিটাকে একেবারে খারিজ করে দিতে পারি না। আপনার/আমার কাজটা কি? এদের চিন্তার জগতে সুন্দর চিন্তাকে জাগ্রত করা। সেটা করতে হলে এদের মধ্যে কাজ করতে হবে, এদেরকে জাগাতে হবে। এদেরকে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, দূরে সরিয়ে রেখে বিপরীত মেরুর ভেবে ক্ষতি ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না, হবেও না।
এই পুরুষশাসিত সমাজে একজন বোরকাওয়ালীও পুরুষদের আক্রান্তের বাহিরে নয়। একজন বোরকাওয়ালীর চিন্তাকেও তারা স্তব্ধ করে। আর স্তব্ধ করে কারা- পুরুষতন্ত্র ধারণ করা পুরুষরা। এই পুরুষতন্ত্র ধারণ করতে পারে টুপিওয়ালাও/থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরাওপুরুষরাও। বহু প্রগতিশীল ‘পুরুষ’ তার ঘরের বউটির অনিচ্ছায় বোরকা পরায়, হিজাব পরায়। ঘরের বাহিরে যাওয়া অবরুদ্ধ করে। হ্যাঁ, যুগের পর যুগ নারীরা এটাকে ভালোবাসা মনে করে, বন্ধন মনে করে মেনে আসছে। এই যে, মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া এটাকেই বন্ধ করতে হবে। যার যেমন ইচ্ছে তেমন থাকবে। এক্ষেত্রে কোনো বিশেষ গোষ্ঠির চাপ চলবে না। ইচ্ছে হলে বোরকা পড়বে, ইচ্ছে হলে টিশার্ট পরবে। এতে কার ভালো লাগলো, কার না লাগলো- এই চিন্তা নারীকে মাথা থেকে বাদ দিতে হবে।
একইসাথে আমাদের আরো বেশি সহনশীল হতে হবে। মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাটা বাড়াতে হবে। তেল-গ্যাস কমিটির এক হরতালে দেখেছি একজন বোরকাওয়ালী মধ্যবয়সী মহিলা ছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির মিছিলে মধ্যবয়সী বহু মহিলা দেখা যায়, কৃষক নারীদেরও দেখা যায়, কৃষকদের অনেকেই টুপি পরে লাল পতাকার মিছিলে আসেন। ওনারা কিন্তু এরকম প্রশ্ন তুলে না- ওই মিছিলে যাবো না, ওই মিছিলে মেয়েরা শার্ট-প্যান্ট পরে আসছে, ওই মিছিলের মেয়েরা ওড়না নেয় নি। বরঞ্চ কোনো নারীকর্মীর শ্লোগান, বক্তৃতা ভালো লাগলে অনুপ্রাণিত হয়ে কপালে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আর্শীবাদ করে দিবে। এটা তাদের সরলতা। কিন্তু আমাদের মনস্তত্ব এতটা কুটীলতায় ভরা এদেরকে সরলভাবে মেনে নিতে পারি না।
আলো দিয়ে জ্বালো বলে একটা কথা আছে। সুতরাং যারা আলোকিত তাদের উচিত সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে আলোকিত করার দায়িত্ব নেওয়া। এক্ষেত্রে কাউকে ইগনোর করাটা একজন আলোকিত মানুষের কাজ নয়। সারাক্ষণ এদেরকে মৌলবাদী মনে করে নিজেরা বিশিষ্ট প্রগতিশীলতার লেবাসধরা এক ধরনের ভণ্ডমী। যে ভণ্ডমীর মাত্রা দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে।
আবার একই সাথে কারো কারো মনস্তত্বেও এটাও ধারণ করে ধুতি হিন্দুয়ানী পোশাক। যে ধুতি পরেন সে হিন্দু। প্রগতিশীল হতে পারে না। এটা ভুল চিন্তা। কেননা, পোশাক কারো কারো স্টাইল হতে পারে। কেউ সারাজীবন ধরে ধুতি পরে যেতে পারে, আবার কেউবা সারাজীবন ধরে শাড়ি পরে যেতে পারে। প্রথমে বুঝতে হবে এটা তার লেবাস না অন্তরে এটাই ধারণ করে। ধুতি অনেক প্রবীণরা তাদের স্টাইল মনে করে পরে। সুতরাং এটাকে সাম্প্রদায়িক পোশাক বানিয়ে ফেলাটা বোকামী।
যা আমাদের কিছু উগ্রচেতনার মানুষ করে থাকে। সহজসরল কথায় যেটা বলতে চাই তা হলো- পোশাক যাই হোক না কেনো, বুঝতে হবে তার চিন্তা কী? তার দর্শন কী? পোশাকের মধ্য দিয়ে সে আসলে কী বোঝাতে চায়- তবেই এগুলোর সমাধান করা সম্ভব। নচেৎ দ্বন্দ্ব বেড়ে যাবে সমাধান হবে না।