সমাজের কাছে প্রশ্ন-মেয়েরা কি মানুষ নয়?
-মানুষ, তবে মেয়ে মানুষ।
আসলে বেশীরভাগ মেয়েরা নিজেও তাই মনে করে। এজন্যেই মেয়ে শব্দের সমার্থক শব্দ "অবলা" এবং মেয়েরা এই সাহিত্যিক অনাদর ও নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। এজন্যেই বেশীরভাগ নারীরা পাব্লিক বাসে সিটের জন্যে আবেদন করেন, চাকুরীতে নারী কোঠার আশা রাখেন এমনকি নারী হিসেবে আত্মকর্মসংস্থান না খুঁজে ভাতা ও বৃত্তি প্রার্থনা করেন। এর কারণ নারীদের মানসিক পশ্চাপদতা এবং জন্ম থেকে তাদের এই অসারতার শিক্ষাই দেয়া হয়। নারী নিজেই নিজের এই অনুর্বরতার স্বীকার করে নেয়, স্বেচ্ছায় পড়ে নেয় সমাজের শাসনের এই অর্গল। কোনো নারী যদি এই অর্গল ভেঙে বেরোতে চায় তখন সমাজ তাকে নোংরামো বলে আখ্যা দেয়। আগেকার দিনে এসব নোংরা নারীদের সমাজ পতিত করত। কিন্তু বর্তমান সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত
সমাজব্যবস্থা সরাসরি তা করতে পারে না, তারা মিছরিরছুরিকায় অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। ব্যাপারটা এমন, হয়তো আপনার বান্ধবী জিন্স পড়লে বা রাস্তায় ছেলেদের সাথে কথা বলা অবস্থায় আপনার বাবা দেখলে তাকে সরাসরি কিছু না বলে আপনাকে ডেকে বলবে মেয়েটার সাথে চলবি না, মেয়েটা ভালো না। বাঙালী যতই আধুনিক হোক, যতই এপিকিউরিজম, কম্যুনিজম, সেক্যুলারিজম, ফেমিনিজম চর্চা করুক না কেনো-পাব্লিক প্লেসে কোনো মেয়ে বা মহিলাকে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে দেখলে শিক্ষিত থেকে শিক্ষিততর ব্যক্তিও রিএ্যাক্ট না করে থাকতে পারেন না। কিন্তু আইন প্রণয়ন এর পরেও যদি কোনো পুরুষ একই কাজ করে পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা সেদিকে ভ্রুকুটিও করেন না। কারণ উচ্চকণ্ঠে যতই ফেমিনিজমের কথা তারা উচ্চারণ করুক না কেনো, পুরুষ ও নারী স্বাধীনতাকে একই আদর্শিক মাপকাঠিতে মাপার প্রয়াস তাদের থাকে না।
আমি নিজে কখনো পাব্লিক ট্রান্সপোর্ট এ অবলাদের জন্যে আসন ছেড়ে দিই না কারণ সমান অধিকারের বুলি কপচালেই হয় না, সমান অধিকারর জন্য সমান কাজও করতে হয় বলে আমি বিশ্বাস করি। আমিও মাঝে মাঝে এ ব্যাপারে নিয়মভঙ্গ করি। যদি সে নারী -প্রথমত অসু্স্থ কিংবা বৃদ্ধা হয়, দ্বিতীয়ত, সে বোরকা পরিহিত নারী হয়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আপনি হয়তো আমাকে হিপোক্রেট বা মোনাফেক ভাববেন। ব্যাপারটা তেমন নয় আসলে এইসব নারীরা আগেই নিজেকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নিয়োজিত সেবাদাসী হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই তাদের এই দাসবৃত্তির প্রতিদান দেয়া পুরুষ হিসেবে বা দাসপ্রভু হিসেবেও আমার নৈতিকতা বা এথিক্সের মধ্যে চলে আসে।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন বোরকা ত্যাগ করে খোলামেলা কাপড়চোপড় পরা, ঠোঁটে বেঢপ লিপিস্টিক মেখে ঘুরে বেড়ানো, রাস্তাঘাটে সিগারেট ফুকে বেড়ালে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিঁড়ি ডিঙানোই নারীমুক্তির সমূহ লক্ষণ দেখা যাচ্ছে এবং নারীবাদের পথ এতই সুগম হচ্ছে যে তা নিতান্ত পঙ্গু দেশটার পক্ষেও খুব সহজ অতিক্রান্ত ও সুগম্য। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। যে মেয়েটি স্কুল কলেজের সিঁড়ি ডিঙিয়ে, একটা বিরাট বড় ঘর বা টাকাওয়ালা পতির পাণিগ্রহণ করে নির্দ্বিধায় সারাদিন ড্রয়িংরুমে বসে ঠোঁটরঞ্জন আর রুপমঞ্জন করেন, সকাল বিকেল স্বামীর পয়সায় পার্লার আর শপিংমলগুলোর টহলদারি করে স্বামীর পকেট খসিয়ে সম্পদের সুষমবন্টন করে এই উপায়ে দেশে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ ফিরিয়ে আনতে চান এবং নানা অঙ্গভঙ্গি ও পাউট করে বর্ণিল ঠোঁটে সোস্যালগুলোকে সমৃদ্ধ করে তোলেন এবং রাতের বেলায় স্বামীর বদৌলতে এই সারাদিনের গলদঘর্ম মেকআপ বিছানায় বিসর্জন দেন-আমি বলবো তাদের শিক্ষার শতভাগই মা গঙ্গায় অঞ্জলিত (জলাঞ্জলি) হয়ে গেছে। স্যার হুমায়ুন আজাদ এই ধরনের নারীদের বলছেন "লিপিস্টক রমনী"।
অন্যদিকে, আমাদের দেশের বৈদেশিক রপ্তানির সিংহভাগ যাদের বদৌলতে সেই সব নারী গার্মেন্টসকর্মী; যারা স্বল্পশিক্ষিত, যাদের পারিপাট্যের কোনো বালাই নেই, নেই রুপচর্চার অবসর, সারাদিন নানা শারীরিক ও মানসিক শোষণের পর ঘাম আর শ্রমের জ্বালানীতে যারা সচল রেখেছেন এদেশের অর্থনীতির চাকা ও পরিবার নামের দু’চাকার অভিহিত গরুর গাড়িটি(যদিও কতখানি দো পেয়ে আমি জানি না) তাদের শিক্ষা আমার কাছে ঢের শ্রদ্ধার। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন ,"শিক্ষা কোনদিন কেউ কাউকে দিতে পারে না"। আসলেই আমাদের দেশের অধিকাংশ সার্টিফিকেটধারীর শিক্ষাই ধার করা, এবং তাদের শিক্ষা অশিক্ষা ও ক্ষেত্রবিশেষে কুশিক্ষাও বটে। এ শিক্ষা যত্ন করে সো-কেস এ সাজিয়ে রাখাও যা ডাস্টবিনস্থ হওয়াও তাই। তাই আমি বলতে চাই শুধু পাশ্চাত্য অন্ধ অনুকরণে বাহ্যিক পারিপাট্য আর সার্টিফিকেট ধারী বিদ্যাই যথেষ্ট নয়। আমি জোর দেই নারীমুক্তির উপরে আর এ ব্যাপারে বাহ্যিক মুক্তির চেয়েও বেশী জোর দিই নারীর মানসিক মুক্তিকে; নারীর মানসিক দাসত্বমুক্তি। আমাদের দেশের বেশীরভাগ মা বাবা মেয়েকে শিক্ষিত করতে চান, বিয়ের বাজারে শিক্ষিত নারীপণ্যটির দাম বেশী চড়া বলে। নারীকে পণ্য বললাম কেননা সমাজ তাকে সে হিসেবেই দেখে আর এ জন্যেই নারীর সমার্থকে ''মাল' শব্দটি অধিক প্রচলিত।
এখনকার দিনে অনেক ধনী ও উচ্চশিক্ষিত যুবক শিক্ষিত নারীকে জীবনসহচর হিসেবে পেতে চান, এর কারণ এই নয় যে তাদের অর্থানুকূল্যে বাঁচতে চান। এর সাথে বলা যায় তসলিমার একটি কথা-"শিক্ষিত মেয়ের সেবা পাওয়ার মধ্যে আলাদা এক ধরনের মজা রয়েছে।"তাছাড়া শিক্ষিত বউ নিয়ে সমাজে গর্ববোধ করা চলে তাও নিতান্ত কম নয়।
একসময় তসলিমা বলেছিলেন-"বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীনিবাসগুলো সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে যায়, হাঁস মুরগীর খোঁয়াড় যেমন বন্ধ হয়। অচিরেই এইসব এইসব উপকারী গৃহপালিত জন্তুর নাম নারীর নামের সমার্থক হবে। "এ সম্বন্ধে আমার নিজস্ব একটি ঘটনারই অভিজ্ঞতা রয়েছে তাও মেডিকেল কলেজের মতো উচ্চশিক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক। যার মূল হোতাই ছিল নারীরা। এজন্যেই নারীর হোস্টেল, ছাত্রাবাস ঘিরে থাকে কঠোর প্রাচীর পাহারা, যা নারীর প্রকৃত স্বাধীনতায় বা নিরাপত্তায় কতটুকু সহায়ক -তা আলোচনাসাপেক্ষ। নারীরাও এই প্রতিবন্ধকতাকে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে কেননা তারা নিজেদের দেখতে চায় পুরুষের আদর্শ সঙ্গী হিসেবে-আর এই আদর্শের মাপকাঠি হল ছেলেরা যেমনটি চায়। তাদের পারিপাট্য ও হয়ে ওঠে সেই মাপকাঠি অনুসারেই। ফিমেইল ইউনাক মতে-মেয়েদের হাইহিল জুতো উদ্ভাবনের পেছনে একটি কারষ হলো পুরুষ যখন মেয়েটিকে আক্রমণ করে, মেয়েটি নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রথম দৌড় দেয়, সে যেন ভালো দৌড়াতে না পারে-হাইহিলের জন্য। আমার মতে বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন গুলো নারী ফিগারকে ও বাহ্যিক পারিপাট্যকে এমন এক মাপকাঠিতে তুলে ধরে না নারীকে শরীরী দুর্বল করে, সাথে সাথে তাদের প্রসাধনী ব্যবসায় সুপথ করে দেয়। এর থেকেই হয়তো জিরো ফিগারের এত জনপ্রিয়তা; কেননা আমরা যতই নারী মুক্তি কিংবা নারী স্বাধিকারের বুলি কপচাই আমরা নারীর প্রতিশব্দ রুপে অবলাকেই বেশি পছন্দ করি।
তাছাড়া সমাজে একটি প্রচলিত চিন্তাধারা হলো পুরুষ যতই বহুগামি হোক নারীর ক্ষেত্রে তা জন্মান্তরীণ পাপ। ধর্মগ্রন্থগুলোও এ ব্যাপারে সোৎসুকভাবে পুরুষালী ভূমিকা নেয়। এজন্যেই মাগী, খানকি , কুলটা, বেশ্যা, নটি প্রভৃতি শব্দগুলো নিত্যস্ত্রীবাচক শব্দ হিসেবে পরিগণিত হয়। শুধু আমাদের সমাজই নয় ,পাশ্চাত্য সমাজেও নারীর বহুগামিতা নিয়ে ট্যাবু প্রচলিত। বাসররাত্রে নারীর ভার্জিনিটি পরীক্ষার জন্য তাকে বিছানায় সাদা চাদর বেছানো হয়, আর যোনীর রক্তপাত দেখে পৈশাচিক উওপ্ত হয় ঘৃণ্য পৌরুষব্যঞ্জক মন। এমনকি উচ্চশিক্ষিত নারীরাও এমন পরীক্ষা দিতে পিছপা হয় না, কেননা এটা সমাজ তাদের জন্যে একটি আদর্শিক মাপকাঠি করে দিয়েছে। কিন্তু কুমারীত্ব প্রমাণের এই পরীক্ষটি অবৈজ্ঞানিক ও একটি মিথও বটে।
একটি অতিসরল(wide-eyed) কথা হল, নিজে উপরে উঠতে না চাইলে শুধু নিচ থেকে ঠেলে কাউকে উপরে তোলা সম্ভব হয় না। তাই এক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক স্বদিচ্ছার প্রয়োজন -সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। এই কথা বোঝানোর জন্যেই আমি খামখা এতগুলি বুলি আওড়ালাম। নারীরা যেদিন এর মর্মাথ বুঝে স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজ শৃঙ্খলের সাথে যুঝে নিজেকে অর্গলহীন করতে শিখবে সেদিনই নারীর অবলা, ভার্যা( পরনির্ভর ), প্রমদাজন, রমনী, রক্ষিতা, অঙ্গনা, পরিচারিকা প্রভৃতি প্রতিশব্দ থেকে মুক্তি পাবে। তাই আমাদের নারীশিক্ষার পাশাপাশি নারীমুক্তির দিকে প্রতি যত্ন নেয়া উচিত। কেননা নারীশিক্ষা নারীমুক্তির একটি সহশক্তি এবং নারীমুক্তির একটি অঙ্গ ও অংশবিশেষ হিসেবে বিবেচ্য ।