নারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধার পক্ষে আমি কখনোই ছিলাম না। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি বিশেষ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে নারী সমাজকে আরো বেশি আটকে রাখার ফন্দি। যেকোনো মানুষই তার নিজস্ব মেধাশক্তি বলে এগিয়ে যাবে। প্রতিবন্ধী, শিশু, বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে- হওয়া উচিতও। নারীদের জন্য কোনোক্ষেত্রেই আলাদা ‘কোটা’র পক্ষে আমি নই। এই সমাজের সকল অন্যায়-অবিচারকে টক্কর দিয়ে চলতে পারলেই সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব। তা না হলে বিশেষ-টিশেষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখার ফন্দি মাত্র। নারীরা তার যোগ্যতা বলে এগিয়ে যাক। কারো দয়ায় নয়। এটা প্রত্যেকটি নারীর মননে ধারণ করতে হবে।
পয়েন্ট আকারে কিছু বিষয়ের তীব্র বিরোধিতা করছি, এর আগেও করেছি-
১. নারীদের জন্য বাসে আলাদা সিটের পক্ষে মত দিতে কখনোই পারি না। নারীরা নিজ সক্ষমতার বলে বাসে দাঁড়িয়ে যাবে আর দশজন পুরুষ যেভাবে যায়। ‘নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি সংরক্ষিত আসন দেখলেই আমার আঁতে ঘা লাগে। চরম অপমানবোধও লাগে। এভাবে সামান্য সুযোগ দিয়ে নারীদের সম্মান দেওয়া হয় না বরং অসম্মানই করা হয়।
২. নারীদের জন্য আলাদা বাসের পক্ষেও না। নারী-পুরুষ এক কাতারে চলবে। এটাই সমাজের চিত্র হওয়া উচিত। আর যুদ্ধটা সেটা নিয়েই করা উচিত। আলাদা-আলাদা করে কোনো পরিবর্তন করা সম্ভব না।
৩. নারী হওয়ার কারণে লাইনে দাঁড়াতে পারবে না বা নারী দেখার পর কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানেও সিট ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে আমি না। নারী কেনো লাইনে দাঁড়াতে পারবে না, নারী কেনো দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না? নারী বন্ধুদের এসব সুযোগ-সুবিধাকে প্রত্যাহার করা উচিত। এটা পক্ষান্তরে অপমান। যখন কেউ বলেন আহা ‘নারী’ হয়ে কত পরিশ্রম করছে- এটা নারীর দুর্বলতাকে আঘাত করা হয়। আর তাই আমরা লুফে নেই। না নারী সব পারে, যা পারে না তা পারার চেষ্টাও করে- এটাই নারীর শক্তি।
৪. কোনো পার্টি বা সংগঠনে যখন নারী হওয়ার কারণে ‘নারী কোটা’য় তাদের স্থান দেওয়া হয়-এটা তীব্র নিন্দা জানাই। এবং এটাকে প্রত্যেকটি নারী কর্মীর প্রত্যাখ্যান করা উচিত। নারী তার সাংগঠনিক যোগ্যতায়, রাজনৈতিক পারদর্শীতায় কোনো কমিটিতে থাকতে পারলে পারবে নচেৎ না। কোনো করুণায় নারীরা কমিটিতে কেনো ঢুকবে? নারীদের এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে। যে নারীরা এত পরিশ্রম করতে পারছে, রাতের পর রাত, দিনের পর দিন প্রত্যেকটি কাজে অংশগ্রহণ করতে পারছে সেই নারীদেরকে করুণার পাত্র বানানো ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। নারীদেরকে এটা বুঝতে হবে।
৫. তুমি ‘নারী’ এটা পারবে না বলে পুরুষরা যে সমস্ত কাজ নারীকে করতে দেয় না তা নারীকে করার চেষ্টা করতে হবে। আর বুঝতে হবে এমন অনেক কাজই আছে যা পুরুষ করতে পারে না, কখনো পারবে না। সুতরাং, নারী পাবে না বলে করুণা করার কিছু নেই।
৬. চাকরির ক্ষেত্রে নারী বলে বিশেষ সম্মানের নামে অসম্মান করার নীতিটাকে নারীদের বুঝতে হবে। বিশেষ সম্মানের কপালে লাথি মেরে নিজের শক্তিব লয়ে চলতে হবে। কোথাও বিশেষ সুযোগ নিবেন না হে নারীসমাজ। এই সমাজটা যাতে প্রত্যেকটি মানুষের হয় সেই লড়াইটা করুন। অযথা নারীর দুর্বলতাকে কোনো গোষ্ঠিই যাতে পুঁজি করতে না পারে খেয়াল রাখতে হবে।
৭. নারী হয়েছে বলে আলাদা নিরাপত্তায় রাখতে হবে তাকে, আর সেই নিরাপত্তা দেবে পুরুষ শ্রেণি তার পক্ষেও আমি না। নারীকে তার নিজের নিরাপত্তা দেওয়ার মতো শক্তি অর্জন করতে হবে। যে সমাজে নারীর জন্য আলাদা নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই সেই সমাজই নির্মাণ করতে হবে আমাদেরকে। লড়াইটা মূলে আঘাত করেই করতে হবে। একটু সুযোগ-সুবিধা পেয়ে বাহ্বা, অভিনন্দন দেওয়ার মনস্তত্ব ত্যাগ করতে হবে।
৮. পুরুষ সিনেমায়, নাটকে অভিনয় করলে পণ্য হয় না নারী কেনো হবে- যদি নারীর এটা পেশা হয়? এটাকে কেনো বলা হবে ‘নারীকে পণ্য’ বানানো হচ্ছে? পুরুষও নাটক, সিনেমা করে থাকে! হ্যাঁ, বুঝতে হবে এক্ষেত্রে ইন্ড্রাস্টিয়ালগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি তারা কোন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছে। আর দেখাটায় আঘাত করতে হবে। নারী এসবে অভিনয় করতে পারবে না বলে মনস্তত্ব ধারণ করা যাবে না। এটা তার পেশা।
৯. পরিবারগুলোকে বুঝাতে হবে আমি নারী বলে তুমি/তোমরা আলাদা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার নামে আমাকে বন্দি করবে না, আমি তা মেনে নেবো না। আমাকে আলাদা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার নেই। আমার মেধাকে বিকশিত করার জন্য যা করা দরকার তা করো। না পারলে চুপ থাকো।
১০. সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার কারো কোনো বিশেষ সুযোগ নারীদেরকে নেওয়া যাবে না, কারো অনুকম্পায় নারী বেঁচে থাকবে না। নারী-পুরুষ মিলেই এই সমাজ। এই প্রকৃতির সৃষ্টি নারী-পুরুষ উভয়ই। এখানে ভেদাভেদ টেনে বৈষম্য তৈরি করার পক্ষে মত দেওয়াটা বোকামী। যার যতটুকু মর্যাদা তার ততটুকু পাওয়ার জন্য যা যা করণীয় তাই করতে হবে। প্রয়োজনে এই রাষ্ট্রযন্ত্রকে উচ্ছেদ করে মনুষ্য সমাজের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরি করতে হবে। আর সেজন্য লড়াইটা প্রয়োজন। বিশেষ সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন নেই।
পরিশেষে, এই মাত্র কয়েকটা বিষয়ই সমস্যা নয়। আরও বহু সমস্যা এই সমাজে বিদ্যমান। তবে নারীদেরকে আলাদা করে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্রকে বুঝতে হবে। এসব এনজিওমার্কা হালকা সুযোগ-সুবিধার ফাঁদে না পড়ে আমূল পরিবর্তনের জন্য লড়াইটা করতে হবে। এই পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় কোথাও নারী নিরাপদে নেই। আর এই যে কোথাও নারী নিরাপদে নেই এই শ্লোগানকে সামনে আনতে হবে, সেজন্য বিশেষ সুযোগকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে। সমাজটা যাতে মানুষের সমাজ হয় সেই চিন্তাকে শান দিতে হবে- লড়াইটাও সেভাবেই জারি রাখতে হবে। না হলে হেরে যাবো। এই ভোগবাদী সংস্কৃতির কাছে পুরোই হেরে যাবো।