সীমান্ত প্রধান

সাংবাদিক ও কলাম লেখক

মেধাতেই হোক নারীর সৌন্দর্য

নারী কি পরবে কি পরবে না, সে সাজবে নাকি সাজবে না, এসব কিছুর সিদ্ধান্ত নেয়ার একক মালিক সে নিজেই। এ নিয়ে আমার কোনো দ্বিমত নেই। পোষণ করছিও না। তবে দ্বিমত তাদের ক্ষেত্রে যারা পুরুষতন্ত্র ভেঙে সাম্যতার পৃথিবী নির্মাণ করতে চাচ্ছেন। সেই তারাই যদি পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেয়া নিয়মগুলো শরীরে ধারণ করে নিয়ম ভাঙার কথা বলেন, তাহলে সেটি একটু হাস্যকরই লাগে।

সীমান্ত প্রধান

সম্প্রতি একবার বলেছিলাম ধর্ম মেনে নারীবাদ আন্দোলন তথা নারীবাদী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, ধর্ম মানেই পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ রচিত ধর্মগ্রন্থ। কোনো ধর্মই নারী অধিকারের পক্ষে নয়। প্রতিটি ধর্মই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোন থেকে লেখা, যার কারণে এখানে পুরুষকে প্রভুর আসনে বসিয়ে নারীকে দাসি বানানো হয়েছে! তাহলে এই ধর্ম মেনে কীভাবে নারীবাদী হবেন? এ বক্তব্যের পক্ষে কেউ মত দিলেও নারীবাদ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত অধিকাংশই বিপক্ষে বলেছেন।

একইভাবে নারীবাদ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কোনো নারী যদি স্নো, পাউডার, আলতা, মেকআপ ইত্যাদিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চান, পুরুষের বাহুতলে সুখ খোঁজার স্বপ্নে বিভোর থাকেন, তাহলে তিনি কেমন নারীবাদী? নারীর এই সাজসজ্জা, চিন্তাভাবনার ধারণাইতো পুরুষতান্ত্রিক। তাছাড়া নারীবাদ আন্দোলন যেহেতু পুরুষতন্ত্রের নিয়ম ভাঙার সেহেতু এগুলো পরিহার করাটাইতো বাঞ্ছনীয়। অথচ পুরুষতন্ত্র যা চাপিয়ে দিয়েছে তা আঁকড়ে ধরে পুরুষতন্ত্র ভাঙার কথা বলবেন (!) সেটি কেমন হয়ে যাচ্ছে না?

আমরা জানি প্রাকৃতিক নিয়মে এক-একজন নারী ও পুরুষের অঙ্গ নিয়ে জন্মায় এটা ধ্রুব সত্য। কিন্তু জন্মের পর তারা কেউ জানতে পারছে না কে নারী কে পুরুষ, তাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত। অথচ আমরা শিখিয়ে দিচ্ছি তুমি নারী এটা তোমার কাজ, এভাবে তুমি চলবে, এভাবে বলবে, ওভাবে বলবে না, ওভাবে চলবে না, এখানে যাবে ওখানে যাবে না ইত্যাদি আদেশ নির্দেশ নিষেধাজ্ঞা। একজন নারীকে ছোটবেলা থেকেই টিপ পরিয়ে, চুল ঝুঁটি বেঁধে, পুতুল খেলায় অভ্যস্ত করে, রান্নাবাটি দিয়ে, বাইরে বেরুনো বন্ধ করে, নানা কুসংস্করাচ্ছন সংস্কারে বন্দি করে, আলতা-পাউডার-স্নো-মেকআপে সাজিয়ে মেয়েলি করে তুলি। একইসাথে গৃহস্থলি কাজ রান্নাবান্না, বাসন মাজা ঘর গোছানোর কাজে অভ্যস্ত করে ফেলছি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা নারীর জন্য এই নিয়ম, গতি  নির্ধারণ করে দিয়েছে।

অপরদিকে একজন ছেলেসন্তানকে শিখিয়ে দিচ্ছি তুমি পুরুষ, তুমি সর্বস্থানে যেতে পারো, ঘুরে বেড়াতো পারো নিজের মতো, বাঁধা নেই। তাকে নানাভাবে বলে কয়ে শিক্ষা দিয়ে ধীরে ধীরে পুরুষ হতে সাহায্য করছি। চুল ছোট রাখা, লিপস্টিক, স্নো, পুতুল খেলনাবাটি, তার জন্য নয়। তার খেলনা হবে মোটর গাড়ি, প্লেন, বন্দুক ইত্যাদি। ঘরের কাজ তার জন্য না, সে বাইরের কাজ করবে। রোদে পুড়লে সমস্যা নেই। চুল ওঠে গেলে সমস্যা নেই। কালো হলেও ক্ষতি নেই। প্রচলিত সমাজের ধারণা মতে পুরুষ সোনার আংটি। সেটি বাঁকা হলেও সমস্যা নেই।

বিপরীতে একজন মেয়ের গায়ের রঙ কালো হলে, চুল ওঠে গেলে অনেক সমস্যা। কেননা, তাকে বিয়ে দিতে হবে। এমন হলে তাকে বিয়ে করবে কে! এমন বদ্ধমূল ধারণা যুগযুগ ধরে বিদ্যমান। এজন্য তাকে দুধ-হলুদ-সর-চন্দন ঘঁষে সুন্দর হতে হবে, থাকতে হবে। তা না হলে বিয়ে দেয়া যাবে না। বিয়ে হবে না। কেননা, এই সমাজে মেয়েরা বিয়ে করতে পারে না, তাদের বিয়ে হয়। যেমন আমরা একজন পুরুষের কাছে জানতে চাই ‘তুমি বিয়ে করোনি?’ আর নারীর কাছে জানতে চাই ‘তোমার বিয়ে হয়নি?’

যুগযুগ ধরে এই সমাজ মেয়ের বাবাকে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা হিসেবে দেখলেও ছেলের বাবার ক্ষেত্রে একবারও উচ্চারণ করা হয়না পুত্রদায়গ্রস্ত পিতা! পুরুষতান্ত্রিক একপেশি দৃষ্টিকোন জাগতিক আদেশ, নির্দেশ, নিষেধাজ্ঞা কেবল নারীকে কেন্দ্র করে। ঘর থেকে বাইরে সর্বত্রই লিঙ্গ বৈষম্য। সাহিত্য থেকে সংস্কৃতিতেও একই অবস্থা। আমাদের নারীরাও এসব ধ্যান ধারণা নিজেদের মধ্যেই লালন করছেন জ্ঞাত বা অজ্ঞাত।

অনেকেই বলেন, আমি অফিসে যাই, আমাকে সাজতে হয় যা আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলে। একজন নারী যখন বলেন ‘সাজুগুজু করলে তিনি আত্মবিশ্বাসী’ হয়ে ওঠনে তখন এটুকু বোঝা যায় যে একজন নারী মেধার থেকে সৌন্দর্যটাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন! আর না দিয়েই বা কী করবেন! আমাদের সমাজ ব্যবস্থাতো এভাবে চলে আসছে। এখানে সুন্দরের কদর একটু বেশিই হয়। অনেক সময় অফিস বা কর্মক্ষেত্রে মেধাবী কিন্তু সুন্দর নন, এমন নারীরা পিছিয়ে থাকছেন পক্ষান্তরে সুন্দর কিন্তু মেধাবী নন এমন নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন!

পুরুষ সুন্দরের পুজারি। পুরুষ নারীকে সুন্দর রূপেই দেখতে চায়। পুরুষের এই চাওয়ার কারণে নারীও সুন্দর করে সেজেগুজে থাকে যা পুরোটাই পুরুষতান্ত্রিক চাওয়া, পুরুষের ইচ্ছে। অথচ নারী জেনে হোক বা না জেনে সে কিন্তু পুরুষের চাওয়ায় নিজেকে সাজাচ্ছে! পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম নিজেদের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছে। যার কারণে মেধার মূল্যায়নের থেকে সুন্দরের মূল্যায়ন বেশি। বিয়ে, কর্মস্থল থেকে শুরু করে সর্বত্রই সুন্দর নারী অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। অনেকটা স্বাস্থ্যবান সুন্দর গরুগুলো যেমন কোরবানি হাটে একটু বেশি চাহিদা সম্পন্ন তেমনি এই সমাজে সুন্দর নারীদের চাহিদাও একটু বেশি।

আমাদের সমাজে অনেক নারীবাদীকে দেখি কড়া মেকআপ দিয়ে নিজের গায়ের রঙটা আড়াল করতে চান! বিভিন্ন সময় নানা উপায়ে ফর্সা হতে চান। কালো হওয়ার কারণে কারো কারো মনে আক্ষেপও জন্মায়। সুন্দর হতে না পারার কষ্ট তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। যার কারণে বিভিন্ন সভা সমাবেশে কৃত্রিম উপায়ে নিজেকে সুন্দর হিসেবে উপস্থাপন করার কতই না চেষ্টা তাদের মধ্যে দেখি! আর এতে করেই বোঝা যায় তিনিও পুরুষতান্ত্রিক ধারণা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছেন না। অথচ তিনিই নারীমুক্তির কথা বলছেন, পুরুষতন্ত্র ভাঙার আহ্বান করছেন!

অনেকে বলেন আমি নিজের জন্য সাজি! আমি কি করবো না করবো সেটা আমার ইচ্ছে। আমিও বলি একজন নারী কি করবে আর না করবে সেটি একান্তই তার ব্যক্তিগত। এ নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু পুরুষতন্ত্র যা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর সেটি কীভাবে করেন! আর করছেনই যেহেতু তাহলে পুরুষতন্ত্র ভাঙবেন কি করে? এখন আপনি বলতে পারেন, ঠোঁটে লিপিস্টক, চোখে কাজল, মুখে স্নো মাখলে আমাকে একটু সুন্দর লাগে, তাই এসব মাখি। তাহলে কী আপনি এগুলো ছাড়া সুন্দর নন! তাই কি কৃত্রিম উপায়ে আপনাকে সুন্দর হতেই হবে?

একজন পুরুষ কিন্তু ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে স্নো, চোখে কাজল পরে না। কারণ, এসব নারীদের জন্য পুরুষের জন্য নয়। পুরুষকে সুন্দর হতে হবে এমন কথা নেই কিন্তু পুরুষতন্ত্র বলে নারীকে অবশ্যই সুন্দর হতে হবে, মৌলিক সৌন্দর্য তার না থাকলেও কৃত্রিম উপায়ে সুন্দর থাকতে হবে! যেহেতু পুরুষতন্ত্রের কাছে নারী মানেই ভোগ্যপণ্য আর পুরুষ ভোক্তা সেহেতু নারীকেই ভোক্তার মন যুগিয়ে চলার জন্য সাজসজ্জা করতে হবে! অথচ এই ধ্যান ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা দরকার। পাল্টানো দরকার এই সিস্টেম। তবেই মূল্যায়ন হবে মেধার। ঘুচিয়ে আনা যাবে লিঙ্গ বৈষম্য, ভাঙা যাবে পুরুষতন্ত্র থেকে চাপিয়ে দেয়া নিয়ম। এজন্য আগে নিজেকে পুরুষতান্ত্রিক নিয়ম থেকে অবমুক্ত করতে হবে।

 

3254 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।