এন এন তরুণ

এন এন তরুণ পেশায় অর্থনীতিবিদ্‌। সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির ইকোনোমিক্সের প্রফেসার। পড়াশুনা করেছেন ইংল্যাণ্ডের ইউনিভার্সিটি অফ লীডজ, লণ্ডন স্কুল অফ ইকোনোমিক্স ও বাথ ইউনিভার্সিটিতে। তিনি একাডেমিক বিষয় হিসেবে অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে লেখেন। অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যাণ্ড, রাশিয়া, ইংল্যাণ্ড, কানাডার বেশ কিছু ইউনিভার্সিটিতে ও কনাফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করেছেন, লেকচার দিয়েছেন ড. তরুণ— রয়্যাল ইকোনোমিক সোসাটি (ইংল্যাণ্ড), ডিভেলপমেন্ট স্টাডিজ এসোসিয়েশন (ইংল্যাণ্ড), বাথ রয়্যাল সায়েন্টিফিক এণ্ড লিটারেরী ইন্সটিইউট (ইংল্যাণ্ড), অস্ট্রেলিয়ার মারডক ইউনিভার্সিটি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সম্প্রতি, ২০১৮-এর জানুয়ারীতে ফিলাডেলফিয়াতে আমেরিকান ইকোনোমিক এসোসিয়েশন কনফারেন্সে পেপার প্রেজেন্ট করেছেন তিনি।

নারীর শ্লীলতাহানি : মূল সমস্যাটা কোথায়?

একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থাই নির্ণয় ক'রে দেয় রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মনন, দৃষ্টিভঙ্গী, জীবনভাবনা, জীবনাচরণ... সব কিছু। ধর্মের নির্যাস থেকে যে শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি সেই শিক্ষাব্যবস্থাই সৃষ্টি করেছে নারীর প্রতি পুরুষের এই অসভ্য দৃষ্টিভঙ্গী। এই শিক্ষাব্যবস্থাই পুরুষকে শিখিয়েছে যে, নারী তাঁর জীবনের শুধুই একটি প্রয়োজনীয় উপকরণ মাত্র। কোনো ধর্মই নারীকে ব্যক্তি হিসেবে, পুরুষের সমকক্ষ— সমাজের একজন সদস্য হিসেবে গণ্য করে নি। যে ধর্ম সৃষ্টির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো নারীকে দাবিয়ে রাখা, অথচ ভীষণ পরিতাপের বিষয় হলো, এই নারীরাই সেই ধর্ম পালনে সবচে বেশি উৎসাহী।

ধর্ম-প্রধান সমাজে, রাষ্ট্রে ও শিক্ষাব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা যে ছেলে, সে তাঁর ধর্মের কাছ থেকে শিখেছে যে, নারী হলো শস্য ক্ষেত্র- তাকে কর্ষণ করা পুরুষের কাজ। যে ছেলে তাঁর ধর্মের কাছ থেকে শিখেছে যে, পুত্রার্থে ক্রিয়তেঃ ভার্যা অর্থাৎ পুত্র সন্তান জন্ম দেয়াই স্ত্রীর কাজ। যে ছেলে তাঁর ধর্মের কাছ থেকে শিখেছে যে, নারী হলো পুরুষের ভোগ্য বস্তু। যে ছেলে তাঁর ধর্মের কাছ থেকে শিখেছে যে, যুদ্ধে প্রতিপক্ষের নারী হলো গণিমতের মাল এবং তাকে ধর্ষণ করা বৈধ। যে ছেলে জানে যে, তার ধর্ম প্রবর্তক যুদ্ধবন্দী নারীকে তার পিতা ও ভ্রাতা যে দিন যুদ্ধে নিহত সেই রাতেই জোরপূর্বক বিছানায় নিয়েছেন। যে ছেলে তাঁর ধর্মের কাছ থেকে শিখেছে যে, নারী হলো পুরুষের অধঃস্তন।

যার ধর্মে পুরুষেরা মহাসমারোহে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করে, সীতার অগ্নি পরীক্ষা নেয়। যে ছেলে তাঁর ধর্মের কাছ থেকে শিখেছে যে, কাজের মেয়ে বা গৃহপরিচারিকার সাথে যৌন সংগম বৈধ কারণ তাঁর ধর্মের প্রবর্তক এ কাজ করে ধরা পড়েছিলেন। যে ছেলে তাঁর পিতাকে দেখেছে বাড়ীর কাজের মেয়ের সাথে যৌন আচরণ করতে, তার মায়ের সাথে কৃতদাসীর মতো আচরণ করতে­— সেই ছেলের ধর্ষকামী হওয়াটাই স্বাভাবিক।

যে দেশে আটক নারীকে পুলিশ সদস্যরা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। যে দেশে পুলিশ সদস্যরা মিছিলে নারীর বুকে হাত দেয়। যে ধর্মীয় শিক্ষা কিশোর-তরুণদের নারীর প্রতি ভোগ-লিপ্সু করে তোলে এবং সেই ধর্মশিক্ষা বিস্তারে প্রতি বছর ক্রমবর্ধমানহারে রাষ্ট্র অর্থ বরাদ্দ করে চলেছে— সেই ধর্মের অনুসারী ছেলে, সেই পিতার সন্তান, সেই দেশের তরুণ নারীকে দেখলে তাঁকে উত্যক্ত করবে, বিবস্ত্র করবে, ধর্ষণ করবে-তারপর অপরাধ ঢাকার জন্য মেরেও ফেলবে- এ হচ্ছে ধর্ম ভিত্তিক সমাজের, রাষ্ট্রের ও শিক্ষাব্যবস্থার অনিবার্য পরিণতি আর সেই সমাজে জন্ম নেয়া হতভাগ্য নারীর অবধারিত নিয়তি।  

নারীর প্রতি পুরুষের এ রকম দৃষ্টিভঙ্গীর ও নির্যাতনমূলক আচরণের কারণ হলো ৯৯ ভাগের চেয়েও বেশি পুরুষ আসলে নারীকে বোঝেই না। নারীকে বোঝার জন্য যে শারীরবিজ্ঞানের ও মনঃস্তত্ত্বের শিক্ষা দরকার তা আমাদের শিখাব্যবস্থায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

নারী যদি মুক্তি চায়, তাঁকে বিদ্রোহ করতে হবে। বিদ্রোহ করতে হবে পুরুষবাদের বিরুদ্ধে, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ধর্মের বিরুদ্ধে। নামতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য দূর্বার আন্দোলনে। তাঁকে, তাঁর সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে পূর্বধারণা থেকে মুক্ত হয়ে, নারীকে ও দূর্বল দরিদ্র শ্রেণিকে শোষণের জন্য ধূর্ত স্বার্থপর পুরুষের তৈরি ধর্মশিক্ষা থেকে সহস্র যোজন দূরে রেখে।

1500 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।