দিনা ফেরদৌস

আমেরিকা প্রবাসী। লেখালেখির পাশাপাশি ছবি আঁকেন জল রঙে।

নারীর পোষাক হোক তার স্বাচ্ছন্দ্যে, সামাজিক চাপে যেন না হয়

নারী-পুরুষ যেই হোক কে কি জামা পরবে সেটা একান্তই তার নিজস্ব ব্যাপার। এই ব্যাপারে অন্যের কিছু বলার কোনো অধিকার নেই। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, কে শাড়ি পরবে আর কে হিজাব লাগাবে তা নিয়েও কারো কিছু বলার নেই। কিন্তু বলতে হয় ঠিক তখনি, যখন কোনো নারীর পোশাক তার চরিত্র নির্ণয়ের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়।

যেই সমাজে সংবাদপত্রের পাতা খুললেই প্রতিদিন দেখা যায় দুধের বাচ্চা রেইপ হচ্ছে, রেহাই পাচ্ছে না মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঢেকে রাখা নারী; সেখানে পোশাক দেখে নারীর চরিত্র নিয়ে কথা উঠলে কিছু বলতেই হয়। কেউ  তার ভালোলাগা থেকে নিজের পছন্দের পোশাক বেছে নিতেই পারে সেখানে বলার যেমন কিছু নেই; তেমনি বাঁকা চোখে তাকাবারও কোনো মানে হয় না।গতবার বৈশাখের অনুষ্ঠানে 'মেরিলেন্ড' গিয়েছিলাম। বিদেশের মাটিতে এই রকম অনুষ্ঠান মানেই বাঙ্গালিদের এক মিলনমেলা। সেখানে আমাদের কিছু বন্ধুরা গিয়েছিলেন নাটক করতে। আমি যাওয়ার পর পরই সেই বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, তাদের দিকে হিজাব পরা কিছু মহিলা বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন তাচ্ছিল্য করে। অথচ এই রকম কোনো অনুষ্ঠানে বাঙ্গালি দেখলেই আমরা এগিয়ে যাই কথা বলি, কে কোন অঞ্চলের জিজ্ঞেস করি। চেনা নেই জানা নেই তারপরও কত আপন মনে একে অপরের। কিন্তু এখানে পোষাক-ই যেন এক দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই বিদেশের মাটিতেও হিজাব মানেই আমরা এক দলের, বাকিরা অন্য দলের। অর্থ এমন দাঁড়ায় যে, হিজাব লাগিয়ে হাতে বেহেস্তের টিকিট নিয়ে বসে আছি, বাকিরা সবাই দোযখে যাবে ওদের সাথে আবার কিসের খাতির। কথা হচ্ছে যেখানে ধর্মীয় নিয়ম মেনে পর্দা করছো, সেখানে এইসব নাচ, গানের অনুষ্ঠানে আসার দরকার কি? সব একসাথে হয় না, মানলে সব ঠিকঠাক করেই মেনে চলো বাপু। ধর্মে নাচ, গান নিষিদ্ধ সেটা কারোই অজানা নয়। শুধু সুবিধামতো বেছে বেছে নিয়ম পালন করতে গেলে লোকে তো বলবেই। তখন আর একদল রেগে গিয়ে বলবেন, পর্দা নিয়ে আপনাদের এতো চুলকানি কেনো? আরে মান্যবর পর্দা নিয়ে চুলকানির কিছু নেই, সুবিধামতো পর্দার ব্যবহার দেখে বাধ্য হয়ে কিছু বলতে হয়।

একবার এক অনুষ্ঠানে যাবো বলে কয়েকটি শাড়ি বের করে রেখেছি, কেউ একজন আমাকে জ্ঞান দিতে আসলেন বউ হিসেবে পাতলা শাড়ি পরে গেলে অমুক রাগ করবেন, বুঝে শুনে যেন শাড়ি বাছাই করি। কথা হচ্ছে অমুক কে, যার ভয়ে আমাকে শাড়ি বুঝে-শুনে নির্বাচন করতে হবে, আমার নিজের কথা ভেবে নয়। আমি হয়তো ভারি শাড়িই নির্বাচন করতাম, কিন্তু যেখানে অন্যকে খুশি করার বিষয় জড়িত আছে; সেই অনুষ্ঠানে আমি যাই নি। যেই জায়গা আমার না সেই জায়গাতে আমি কেনোইবা যাবো। তার উল্টোটাও আছে। একবার পরিচিত একজন আসছেন আমার কাছে শাড়ি পরতে। ব্লাউজের ডিজাইন হচ্ছে হাতের লম্বা কব্জি পর্যন্ত আর গায়ের দিকের লম্বা নাভী পর্যন্ত। আমাকে বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কিভাবে পিনাআপ করতে হবে যাতে শরীর দেখা না যায় (আমাকে বার বার বুঝিয়ে দেয়ার ফলে মন চাইছিলো বলি, এতোই পারেন তো নিজেই পরলে পারতেন আমার কাছে আসার দরকার কি)। মুখে বললাম এই শাড়ি পরার দরকার কি, সেলোয়ার কামিজ পরলেই পারতেন? বললেন সে কি করে হয়, ঘরের বউ বলে কথা, পরিবারের সবাই শাড়ি পরছে। শাড়ি না পরে গেলে কথা হবে আবার আঁচল একটু সরে গেলেও রক্ষা নেই। শাড়ি পরানোর পর মনে হলো শাড়ির আদলে অন্য কোন জুব্বা পরে আছেন (ভদ্র শাড়ি পরানো শিখলাম, আর মনে মনে তওবা করলাম, জীবনেও শাড়িকে এই রকম অপমান করবো না কোনদিন)।

আমি মনে করি শাড়ি পরলে তা শাড়ির মতো করেই পরা উচিৎ আর বোরকা পরলে তা বোরকার মতো করে। কিন্তু দেখা যায় সেই ক্ষেত্রেও বিপরীতটাই ঘটে। বোরকা পরে স্কিন টাইট জামার মতো করে। হিজাব করে চুল ঢাকে একদিকে আর মুখে কড়া মেকআপ করে, মাথায় ঝক্কি-মক্কি লাগিয়ে দ্বিগুণ ফ্যাশন করে পর্দার নামে। যেখানে ঢিলেঢালা পরার কথা সেখানে হয়ে যায় টাইট, আর যেটার নিয়ম-ই হচ্ছে খোলামেলা সেটাকে বানানো হয় জুব্বা। মূর্খদের বুঝানো গেলো পর্দা করা হচ্ছে, আর ফ্যাশনেবলদের কাছে তুলে ধরা হলো ফ্যাশন।

তবে সবাই এক না, অনেকে নিরাপত্তার জন্যও হিজাব লাগায়, কেউ কেউ পারিবারিক চাপে বাধ্য হয়ে, কেউ কেউ সময় নষ্ট হবে ভেবে ঘরের পোশাকের উপরে সহজে পরা যায় ভেবেও পরেন। তবে বোরকা যে নিরাপত্তা দেয় না, তা ইতিমধ্যে প্রমাণিত। আর পারবারিক চাপে বাধ্য হয়ে যারা করছেন, তারা পরিবার থেকে একটু দূরে গেলেই খুলে ফেলেন সেটাও কারো অজানা নয়। আর যারা সত্যিই নিজের মনের তাগিদে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে পরছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ রইলো, আপনাদের এই সৎ মনোভাবনা সফল হোক, কিন্তু যারা আপনাদের মতোই তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক বেছে নিছেন; তাদের দিকে দয়া করে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকাইয়েন না, তাহলে আপনাদের নিয়েও কেউ কথা বলবে না। হিজাব লাগালেই ভালো হয়ে গেলেন আর হিজাব না পরলেই কেউ খারাপ হয়ে গেলো এই জাতীয় ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। কেউ যদি খারাপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে চায় তো বোরকা লাগালেও তাকাবে। নিজে বোরকা পরার সাথে সাথে নিজেদের ছেলে সন্তানদের চোখ সংযত করে বড় হয়ে উঠার জ্ঞান দিন। শুধু মেয়েকে ঢেকে চলার জ্ঞান দেবেন আর ছেলের বেলায় বলবেন, জামা-কাপড় ঠিক না থাকলে ছেলেরা তাকাবেই; জেনে রাখুন এই জ্ঞান পেয়ে ছেলেরা বড় হয়ে উঠে বলেই আপনার মেয়েও বোরকা পরে নিরাপদ না। 

পোশাক নির্বাচন করে বেশিভাগই নিজের ভালোলাগা থেকেই। তাই নিজের ভালোলাগার পাশাপাশি অন্যের ভালোলাগাকেও সম্মান করতে শিখুন।

1832 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।