আমি খুব কঠিন মানুষ নই, আবার খুব সহজও নই। আমার ভেতরে বাস করে এক ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ শিশু। মাঝে মাঝে সে খুন-খারাবি করতে চায়। রাষ্ট্রীয় অনাচার, সামাজিক শয়তানি, ব্যক্তির পাষণ্ডতা দেখে মুহূর্তে সে হন্তারক হয়ে উঠতে চায়।
আমার বোনের নাম রুপা। ওকে ধর্ষণ করে, ঘাড় মটকে মেরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মাত্র কুড়ি-একুশ বছর বয়সেই ওর সমস্ত স্বপ্ন জীবনের তরে হিমাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ধর্ষিত হওয়ার সময় ও কী অবিশ্বাস নিয়ে বর্বর পুরুষগুলোর দিকে তাকিয়েছিল? ও নিশ্চয়ই নিজেকেই দোষ দিচ্ছিল, কেনো রাতের বাসে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল! কেনো এতো রাতে একজন অন্তত পুরুষ আত্মীয় ছাড়া বাসে উঠেছিল! রুপা কি জানতো দিল্লীর নির্ভয়ার কথা! জেনে থাকলে ও কি কেঁপে উঠেছিল নির্ভয়ার পরিণতির কথা ভেবে?
হায়! রূপা তখনো জানতো না ধর্ষণেই শেষ নয়, তাঁকে বিদায় নিতে হবে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা-ক্রিকেটজ্বরা স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে। মেয়েটি প্রাণের বিনিময়ে ওই পিশাচদেরকে দিতে চেয়েছিল টাকা-পয়সাসহ নিজের কাছে যা কিছু আছে।
রূপার ঘটনা জানার পর থেকে আমি স্তব্ধ হয়ে আছি। ক্রিকেট দিয়েও ওই স্তব্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারছি না। একটা প্রশ্ন থেকে থেকেই আমাকে ঘাঁই মারছে...
ধর্ষণের শাস্তি তর্ক সাপেক্ষে এমনিতেই কঠোর, ধর্ষণ করে মেরে ফেললে শাস্তি আরো বেশি কঠোর; তাহলে দ্বিতীয় পথটি পাষণ্ডগুলো কেনো বেছে নিলো, aঅর্থাৎ ধর্ষণ করে মেয়েটিকে বাঁচিয়ে না রেখে মেরে ফেললো কেনো?
আপনারা অনেকেই হয়তো ভাবছেন, প্রমাণ যাতে না থাকে এ কারণেই হত্যাকাণ্ড। হ্যাঁ, অপরাধী মনে এরকম ভাবনা আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি আর এরকম সরল ও একরৈখিক ভাবনায় সন্তুষ্ট নই।
আমি যখন আমার সমাজের মানুষের দিকে তাকাই, তাঁদের চিন্তা, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করি, সত্যি বলতে কী আঁতকে উঠি! একজন নারী আমাকে বিয়ে করার পর এই ব্যাপারগুলো আরো গভীরভাবে অনুভব করছি। নারীর প্রতি এ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ভয়াবহ রকমের জঘন্য! শিক্ষাদীক্ষা, শ্রেণিগত অবস্থান নির্বিশেষে এই সমাজে দুই রকম মানুষ আছে- প্রথমত প্রবলভাবে আছে পিতৃতন্ত্রের দাসত্বকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এরমধ্যে পুরুষতন্ত্রের সেবাদাসী নারীগণও আছে। দ্বিতীয়ত আছে সংখ্যালঘু কিছু শুভবোধসম্পন্ন মানুষ, সত্যিকারের মানুষ। একজন নারী যার কাছে নিরাপদবোধ করে।
আপনি যদি দিল্লীর মেডিকেল কলেজ ছাত্রী নির্ভয়ার ধর্ষক-খুনিদের স্টেইটমেন্ট পড়ে থাকেন তো রুপার ধর্ষক-খুনিদের মনস্তত্ব বুঝতে সক্ষম হবেন।
পৃথিবীর বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়া দিল্লী রেইপ ও মার্ডার কেইসের ঘটনার পর ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক লেসলি উডউইন দিল্লির অদূরে তিহার কারাগারে বন্দি রেইপিস্ট মুকেশের সাক্ষাৎকার নেন। ওই সাক্ষাৎকারে মুকেশ এধরণের ঘৃণ্য কাজে জড়িত থাকার ব্যাপারে কোনো অনুশোচনা না দেখিয়ে উল্টো ধর্ষিতাকেই দোষারোপ করেন। তার মতে ‘একটা ভালো মেয়ে কখনোই রাত ৯টায় বেড়াতে বের হয় না। ধর্ষণের জন্য ছেলেদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি দায়ী থাকে। ছেলে এবং মেয়ে সমান না। গৃহস্থালীর কাজগুলো মেয়েদের জন্য। অসামঞ্জস্য পোশাক পরে রাতে ডিস্কো আর বারগুলোয় ঘুরে বেড়ানো তাদের কাজ না।’
আমাদের রূপা কর্মজীবী নারী ছিলেন। চাকরির পরীক্ষা দিতে তাঁর ঢাকা আগমন। পরীক্ষা শেষ করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে রাতের বাস ছিল একমাত্র ভরসা। তা আল্লাহ্ - ভগবানকে ভরসা মেনেই এ দেশে পথে বেরোবার নিয়ম। বাসের ভেতরেও ওই ভরসার কথা লেখা থাকে। মেয়েটি কি জানতো, ওই ধর্ষকদের ভেতরে বাস করছিল দিল্লির মুকেশ, পবন, অক্ষয়, বিনয়রা?
একা একটা মেয়ে রাত-বিরেতে বাসে চড়বে কেনো? তাঁর তো ঘরে থাকার কথা, তেল-নুন-মাছ-মাংসের সাথে মিশে থাকার কথা। 'ভাল মেয়ে' কি অতো রাতে একা বাড়ি থেকে বের হয়, বাড়ি ফিরতে চায়? দুশ্চরিত্রা মেয়েমানুষেরাই কেবল রাতে বাড়ি ফেরে, রাতের বাসে ভ্রমণ করে। এরকম চরিত্রহীন মেয়ের সাথে যা-খুশী তা-ই করা যায়। এমনকি ধর্ষণ করে ঘাড় মটকে মেরে চলন্ত বাস থেকে ছুড়ে ফেলা যায়। যেমন দিল্লির নির্ভয়াকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং খুনের ব্যাপারটিকে কেবল অপরাধীর অপরাধ ভীতি দিয়ে বুঝতে চাইলে বোঝাপড়াটা কমপ্লিট হয় না। এতে কেবল দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষ করে অপরাধের বিচার পর্যন্ত পৌঁছানো যায়, পরবর্তী অপরাধ নির্মূলে এই গৎবাঁধা সমীকরণ আদতে কোনো কাজেই আসে না।
বায়োলজিক্যাল গঠনে আমি একজন পুরুষ। কিন্তু যখন জানতে পারি একজন নারী একজন পুরুষকে ভয় পাচ্ছে, অনিরাপদবোধ করছে তখন সত্যি ঘৃণা হয় নিজের উপর। যখন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রাতের শহর দেখতে আমার নারী সঙ্গিটিকে নিয়ে বের হতে পারি না তখন ঘৃণা হয় লিঙ্গবাদী পুরুষের উপর, এই নিকৃষ্ট সমাজের উপর। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেছে। আজো এদেশ, এ সমাজ নারী বান্ধব হতে পারলো না। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে কোথাও একজন নারীকে নিরাপত্তা দিতে সক্ষম নয় এই রাষ্ট্র। মানুষের মতো দেখতে পালে পালে শকুন শুয়োর দিকে দিকে ছড়িয়ে আছে। ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে হয় প্রতিদিন প্রতিক্ষণ।
চারিদিকে ধর্ষক, খুনি, ইতর, বদমাশদের সহস্র চোখ দেখতে পাই। একজন নারীর চোখ দিয়ে সমাজটাকে দেখুন, আপনিও দেখতে পাবেন। যতদিন না, নারীর চোখ দিয়ে দেখতে পারছেন ততদিন আপনার দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটাও অমীমাংসিত থেকে যাবে। বিচার চাই, ফাঁসি চাই - স্লোগানসর্বস্ব এরকম দাবীতেই কেবল নির্ভয়া - মিতু - আফসানা - রূপাদের জীবনের করুণ কাহিনী লেখা হতে থাকবে।
ধর্ষণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আইনের নেই। শাস্তি নিশ্চিত করে পরবর্তী ধর্ষকের মনে ভীতি সঞ্চারিত করা ব্যতীত আইনের পক্ষে বেশিকিছু করা সম্ভব নয়। দরকার নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো। দেখার নতুন চোখ সৃষ্টি করা। কাজটা সহজ নয়। কিন্তু শুরু তো করতে হবে। দায়িত্বটা রাষ্ট্রকেই নিতে হবে, নেওয়া উচিৎ। একইসাথে প্রতিটি পরিবারে, সমাজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষা কারিকুলামে, আইনে জেন্ডার সেন্সেটাইজেশনের বিষয়গুলো বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
মোদ্দাকথা, নতুন মানুষ ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি করতে না পারলে আপনার কন্যা সন্তানটি এ সমাজে সুস্থ থাকতে পারবে না। আপনার প্রিয় সন্তানকে অসুস্থ রেখে আপনিও ভাল থাকবেন না।