আমার পরিচিত অন্ততঃ তিন জন তরুণীকে জানি যারা এই মূহুর্তে ঢাকার বাইরে বেশ দূরের মফস্বলে জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থায় হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের কাজ করে সংসারের আয় নির্বাহ করছেন এবং তাদের পুরুষ জীবনসঙ্গী হয়তো এই মূহুর্তে কর্মহীন।
কর্মহীন বলতে তিনজনের একজনের জীবনসঙ্গী বিয়ের পর থেকে প্রায় কয়েক বছর কর্মহীন থেকে সম্প্রতি একটি কাজের জায়গায় ঢুকেছেন। আর্থিক অনিরাপত্তাজনিত কারণে মেয়েটি মাঝখানে সন্তান নিতে পারে নি বা সন্তান এলেও আর্থিক বিবেচনায় বৈধ বিবাহের সন্তানকে পৃথিবীর আলোয় আনা যায় নি। যেহেতু রোজগারের পুরো দায় মেয়েটির কাঁধে ছিলো। মেয়েটির ভেতর তারপরও জীবনসঙ্গীর প্রতি তিক্ততা ছিলো না। হাসিমুখে জীবনসঙ্গীর তথ্যচিত্র বানানোর পয়সা যোগাড় করার চেষ্টা করে গেছে অবিরত। এখনো সংসারের মূল আয়ের দায় তার কাঁধে- মাত্রই কয়েকদিনের ছুটিতে ঢাকায় এসে জীবনসঙ্গীর তথ্যচিত্র তৈরির কাজে সাহায্যও করে গেছে।
ওদের দু’জনের প্রেম হ্যাভেনলি। বরটি আবার একদমই ‘নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ’ করে না। বউকে সে-ই ঠেলে ঢাকার বাইরে কাজ করতে পাঠিয়েছে যেন মেয়েটি বড় কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে পারে। এখন ছিদ্রান্বেষীরা যদি ছিদ্র খুঁজতে চান যে মেয়েটি ছেলেটির ‘সমবয়সী’ বা ‘খানিকটা বড়’ কিনা- তাই ‘বুড়ো বয়সে কচি ছেলে’ বিয়ে করে উল্টো তাকে টানছে- সেটাও ভুল হিসেব। মেয়েটি ছেলেটির কয়েক বছরের ছোটই (আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বর যদি একদিনের বড়ও হয়, তবেই বর হবার যোগ্য এবং আজীবন স্ত্রীর ভরণ-পোষনে বাধ্য)- হ্যাঁ, মেয়েটি ডানাকাটা পরী নয় তবে তার বরও খুব রূপবাণ নয়। দু’জনার প্রেমেরই বিয়ে।
আর এক তরুণী তার থেকে বয়সে তেরো/চৌদ্দ বছরের বড় বর ও নিজের (যিনি এক বছর ধরে কর্মহীন- আগে কাজ করেছেন অবশ্য, যিনি একজন মোটামুটি ফেসবুকার -এমন না খুব বড় লেখক বা বিপ্লবী) খরচসহ গোটা সংসারের দায় টানছেন। মেয়েটির হৃৎপিন্ডে অতি সম্প্রতি একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তবু ঘর ভাড়া, বাজার খরচসহ উইক-এন্ডের ক্যাফের খাওয়া সবকিছু মেয়েটিই সামলাচ্ছে। সামলাবে না কেনো? ছেলেরা স্ত্রী সমেত সংসারের দায় টানলে মেয়েরাও টানতেই পারে। ছেলেরা ১৪ বছরের ছোট মেয়ের দায় সামলালে মেয়েরাও ১৪ বছরের বড় বরের দায় হাসিমুখে সামলাতেই পারে। বিষয়টা তো দাম্পত্য এবং পারষ্পরিক ভালোবাসার বোঝা-পড়া। উপনিষদে মৈত্রেয়ীকে বলা যাজ্ঞবল্ক্যের কথা, ‘পুত্রকে পিতা ভালোবাসে কারণ তাকে ভালোবেসে পিতার আত্মা খুশি হয়। পতিকে ভালোবেসে পত্নীর আত্মা বা পত্নীকে ভালোবেসে পতির আত্মা খুশি হয় বলেই ভালোবাসে।’
না- ঐ তরুণীদের ‘ছোট’ করতে বা তারা ‘বোকা’র মতো কাজ করছে এজাতীয় ট্রল লেখার জন্য আমি এই পোস্ট লিখতে বসি নি। ফেসবুকে ঢুকেই দেখলাম যথারীতি মেয়েদের বিরুদ্ধে ঢালাও ধারণার চর্বিতচর্বন কুৎসায় একজন লিখেছেন, ‘মেয়েরা প্রেম করে কবির সাথে আর বিয়ে করে বিজনেস ম্যাগনেটকে।’ এসব কুৎসা সারাদিনই দেখি। মেয়েরা প্রেম করলে চা-কফির বিল দেয় না। উল্টো আমি বরং ভার্সিটি জীবন থেকে অদ্যাবধি যত ক্যাফেতে টোনা-টুনিদের দেখেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েটিকে বিল দিতে দেখেছি। তার স্যোশিও-পলিটিক্যাল কারণও আছে। আমাদের শ্রেণির (মধ্যবিত্ত/উচ্চ মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত) ছেলেরা অনেকেই বিদেশে বাবার টাকায় বা স্কলারশিপে পড়তে চলে যেতো ইন্টারের পরেই। মেয়ের ‘কৌমার্য’ রক্ষায় চিন্তিত হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি মধ্যবিত্ত ঐ পরিমাণ মেয়েদের বিদেশে পড়তে পাঠাতো না। কাজেই ঢাকার দামি স্কুল-কলেজ শেষে ভার্সিটিতে পড়া মেয়ের প্রেমের জন্য ছেলে জুটতো মফস্বল থেকে আসা lower-middle class বা টিউশনি করে বাঁচার চেষ্টারত ছেলের সাথে। উচ্চ মধ্যবিত্তের মেয়ে বাবার কাছ থেকে পাওয়া টাকা হাসিমুখে প্রেমিকের সাথে সময় কাটাতে অকাতরে ব্যয় করছে এ দৃশ্যই বেশি দেখেছি।
এবার বলবেন তো এই প্রেমগুলো কয়টা টিঁকেছে শেষমেশ? অত তো জনে জনে জরিপ করতে যাই নি। তাই বলে মেয়েরা প্রেমের জন্য ত্যাগ করে না এটা ঠিক নয়। বহু মেয়েকেই বিদেশের চাকরিরত ‘দামি’ পাত্র ছেড়ে ‘বেকার’ প্রেমিকের জন্য অশ্রুমোচন করতে দেখেছি। এমনকি আমরা যারা খুব উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে নই, আমরাও- ছাত্র জীবন থেকে কাজ করতে করতে বন্ধুবৃত্তের ছেলে বন্ধুদের চা-কফির বিল আমরাই বেশি মিটিয়েছি।
আমাদের সময়টা এমন এক সময় যখন চারপাশে ছেলেরা ২৫-৩০-এর সময়টা বেশ লেথার্জিক বা কুঁড়ে- কাজ করছে না- মেয়েরা এদিকে হু হু করে ঢুকছে চাকরি ক্ষেত্রে। সেজন্যও নানা নারী-বিদ্বেষী বক্তব্য শোনা যায় : ‘মেয়েদের ত’ সব ক্ষেত্রে কোটা। এনজিওতে অগ্রাধিকার। বসের সাথে শরীর...।’ অথচ, বাস্তবতা হলো আমরা একটা প্রজন্মের মেয়েরা পাহাড়ে-চরে-চা বাগানে-সমুদ্র তীরে ঘুরে ঘুরে যখন চাকরি করছি- এবং সত্যি সত্যি বস জাতীয় সমস্যায় পড়লে চাকরি ছাড়ছি এবং আবার চাকরি খুঁজছি, আমাদের ছেলে বন্ধুরা তখন অনেকেই সারাদিন আড্ডা মারছে, বিড়ি-গাঁজা টানছে ও আঁতলামি করছে।
সেই বন্ধুরাই ত্রিশের পর কেউ কেউ সিরিয়াস হয়ে গেলো। বিয়ে করতে গিয়ে তারা অনেকে আবার পাবলিক ভার্সিটির ভালো ছাত্রীর বদলে ডিগ্রি কলেজের কোনোরকম একটি মেয়ে জুটিয়ে নিয়ে গৃহস্থ হয়ে গেলো। বউ দেখতে মোটামুটি (যেটুকু ভার্সিটির বান্ধবীরাও), যোগ্যতা খানিকটা কম ও মোটামুটি গৃহবধূ (মানে ওটুকু রান্না-বান্না তুখোড় কর্মজীবী মেয়েটিও করছে)।
আসলে পুরুষবাদী সমাজ যেহেতু ছেলেদের মাথায় ঢোকায় যে ‘অনেক টাকা’ আয় না করে বিয়ে করা যাবে না, অনেক ছেলের ভেতর এমন মনোভাব দেখা যায় যে সমবয়সী বা সতীর্থ মেয়ের সাথে ক’দিন ‘সময়’ কাটাবে (সে ধরেই নিয়েছে এই মেয়ে তার নয় বা হতে পারে না- মেয়েটির সব আকুলতা সত্ত্বেও- সব ত্যাগের ও দায় বহনের মানসিকতা সত্ত্বেও), তারপর তাকে পাশ কাটিয়ে দরকারে খুব মন্দ ব্যবহার করবে, মেয়েটি বহুদিন অপেক্ষা করে এবং হতাশ হয়ে যখন অন্যত্র বয়স্কতর এবং অপেক্ষাকৃত সেটেলড ছেলে বিয়ে করবে, তখন ছেলেটি ক’দিন শরতের দেবদাস-অঞ্জন দত্তের বেলা বোস হ্যানো ত্যানো বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত, ব্যর্থ প্রেম কান্নাকাটি ছ্যাঁকা-ন্যাকা করে আরো কিছুদিন ভ্যাগাবন্ড গিরি করবে। বহু বছর পর সে একটু একটু করে সেটেলড হবে। তারপর বয়সে অনেক ছোট কোনো মেয়েকে বিয়ে করে (যে হয়তো তার অতীতের বান্ধবীর থেকে রূপ-গুণে কোনোকিছুতেই বেশি নয় বরং কমও হতে পারে) উদাসীন তবে কর্তব্যপরায়ণ গৃহস্থ হয়ে যাবে।
ছেলেদের এই ‘ডিকোটমি’ সাঙ্ঘাতিক। এক পুরনো প্রেমিকাকে আজীবন জীঘাংসার সাথে মনে রেখে (যার সব আকুলতা ও ত্যাগ বহনের মানসিকতা সত্ত্বেও তাকে সে নেয় নি সময় থাকতে দায় বহনের ভয়ে) সে এমনকি নিষ্প্রেমভাবে আর একটি মেয়ের সাথে সন্তান উৎপাদন থেকে সংসারের আসবাব ক্রয়- সবকিছু করে যায়।
এখন এই যে মেয়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগ : তারা ‘সেটেলড’ পাত্র দেখলে কেটে পড়ে- এর তো কিছু ‘বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর’ও আছে। একটি মেয়ে সবোর্চ্চ মধ্য-চল্লিশ অবধি মা হতে পারে (তীব্র ঝুঁকিসহ) যেখানে একটি ছেলে মধ্য-পঞ্চাশ অবধি বাবা হতে পারে। আছে সমাজের চাপ, লোকনিন্দা (নির্দিষ্ট বয়সে বিয়ে না করলে বা না হলে) ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ, অনেক ‘বোকা’ মেয়েকেই জানি যারা ‘পড়বি ত’ পড় মালীর ঘাড়ে’ জীবনে সব মিলিয়ে দুই বা তিনবার যখনি প্রেমে পড়েছে কেনো জানি ‘রোজগেরে, সফল’ ছেলের বদলে ‘বেকার, ব্যর্থ’ ছেলের প্রেমে পড়েছে। এর কারণ আছে। যে ছেলেকে সকাল ছয়টা থেকে রাত নয়টা অবধি বাইরে রুটি অর্জনের সংগ্রাম করতে হয়, সে তত ভাবের কথা, পুঁথির বিদ্যা, গল্প-কবিতা, মার্ক্স-এঙ্গেলস ঝাড়তে পারে না। তবে সে ‘মোটা ও বাস্তব’ দায়িত্ব নেয়। কিন্ত আমার মতো বা আমার কিছু বোকা বান্ধবীর মতো আজকাল যে মেয়ে নিজেই নিজের খাবার বা পোশাক কেনে, সে ঐ ভাবের কথার রংধনুর আবর্তে পড়ে যায়। তার তো আসলে খাবার বা পোশাকের জন্য কেজো ছেলের সাথে বাধ্যতামূলক বিবাহে বসার দায় নেই। সে তাই কেজো, সৎ ছেলের বদলে ব্যর্থ কবি-চলচ্চিত্রকার-বিপ্লবী ইত্যাদি ইত্যাদি খুঁজে ফেরে। কিন্ত ব্যর্থ কবি বা চলচ্চিত্রকার বা বিপ্লবী তো কোনো দায় বহনেই নারাজ। এমনকি মেয়েটি দায় নিতে চাইলেও তার ইগো : ‘ওর খাবো-পরবো আমি? ছিঃ ছিঃ লোকে কি বলবে? পারলে ও কোথাও সেটেলড হোক। আমি দরকারে ১০ বা ২০ বছর পর সেটেলড হলে কোনো বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করবো।’ আর পুরুষতন্ত্র তার মাথায় হাতুড়ির ঘাই দিয়ে শিখিয়েই দিয়েছে ‘মেয়েরা ছলনাময়ী’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রিয় পুরুষেরা, জানি আজো সমাজে উল্টো ঘটনাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। কবির সাথে প্রেম করে বিজনেস ম্যাগনেটকে বিয়েই করে বেশি মেয়েরা। কিন্ত, ভেবে দেখবেন কি- এই প্যাটার্ন আপনাদের ‘পুরুষতন্ত্রের’ই তৈরি নয় কি? চারপাশে চোখ মেলেন। দিন কিন্ত বদলাচ্ছে। সমবয়সী দু’জন মিলেও বিয়ে করে সংসারের সব দায় দু’জন মিলে সামলাচ্ছে, কোথাও বর বেকার থাকলে বউ রোজগার করছে, অনেক প্রেমিকা চাকরি করে প্রেমিকের ক্যাফের বিল মিটাচ্ছে। আজ থেকে ৫০-১০০ বছর আগের ঘ্যানঘেনে প্যানপেনে বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত-সিনেমার ক্লিশে, নারী-বিদ্বেষী ইমেজে কতদিন আটকে থাকবেন? আর হ্যাঁ- বিয়ে করে সমবয়সী/পনেরো বছরের বড় বা পনেরো বছরের ছোট বরও যদি হয় (হয় না ১৫ বছরের ছোট বর? ১৪০০ বছর আগেই হয়েছে)...তার দায় মেয়েটি কেনো বহন করতে পারবে না যদি ছেলেটিও উল্টো ভাবে পারে? পারতে আমাদের হবেই।
#আসুন সবাই মিলে নারীবাদী ও মানবতাবাদী হই।