বিক্রম কামরুল

সখে লেখালেখি করেন। নিজেকে নারীবাদী মনে করেন।

নারীর মস্তিস্কে যখন পুরুষতন্ত্রের দানব

নারীর মস্তিষ্কে যখন পুরুষতন্ত্রের দানব পুঁজিবাদ বা মৌলবাদ বা পুরুষতন্ত্রের পাঁকে পরে মানুষ প্রতিনিয়ত খাবি খাচ্ছে। পুরুষ একটি দানবের নাম। নারী পুরুষ উভয়ই এ দানবটি নিজ মস্তিষ্কে বহন করতে পারে। তবে পুরুষ জন্মসূত্রে এটি পেয়ে থাকে; বংশপরম্পরায় এ পশুবৃত্তিটি তার দেহ কোষে বহন করে চলেছে। তার চারপাশ থেকে মগজে গেঁথে নিচ্ছে সে নারীর চেয়ে পেশীবহুল, সমাজে তার সমর্থক নারীর চেয়ে বেশি, সম্পদ বেশি; তার একটি বিশেষ দন্ড রয়েছে সেটি দিয়ে নারীকে খুবলে খাওয়া যায়। এ দন্ডটি দিয়ে কোনো নারীর উপর একবার চড়াও হতে পারলে আর নারীটি মানুষ থাকবে না, হয়ে যাবে একতাল মাংস, সমাজে তার মূল্য হবে ৫০০টাকা কেজি। এরকম কোনো ভাবনা থেকেই বুঝি শ্রাবণী শায়লা ঐ আন্দোলনকারী মেয়েটির উপর ঝাপিয়ে পড়েছিলো!

অনেক নারীর মাঝে আমরা এ দানবটির উপস্থিতি দেখে থাকি। অনেক পরিবারে মা'কে প্রথাগত বাবার মতো আচরণ করতে দেখি। বাবাকে দেখি অবলা মা'য়ের মতো চুপসে যেতে। ভারতে পাকিস্তানে বাংলাদেশে নারীকে রাষ্ট্রক্ষমতায় দেখেও নারীর কোনো উন্নয়ন দেখি নি ঐ একই কারণে।

সরকার নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারীর আচরণ মাতৃসুলভ মনে করে শিশুশিক্ষায় নারীদের নিয়োগ দিচ্ছে (সাধুবাদ জানাই)। কিছু বিদ্যালয় অবলোকন করার পর বেশ হতাশ হলাম। নারীর আচরণ মাতৃসুলভ নয় ঠিক তা নয়, দায়িত্ব পাবার পর দায়িত্বটাকে ক্ষমতা ভেবে তাঁর দায়িত্বের চূড়ান্ত করে ছাড়ছে নানাবিধ আচরণে। কেনো এমন করছে? ঐ শিক্ষিকা আর শ্রাবণী শায়লার মাঝে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাইনি। শ্রাবণী শায়লাকে মনে হয়েছে ঐ শিক্ষয়িত্রীর পূর্বসূরি। সমস্যাটা বা গলদটা কোথায়? তারা সকলে শিক্ষিত হয়েও আচরণে মনে হচ্ছে বোধহীন বর্বর। তবে কী শিক্ষাটা যথার্থ হয় নি? দেবী চৌধুরানী বা ফুলনদেবী কি অনেক পুস্তক পড়ে গোটা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো বা ৭১ এ লাখো নারী-পুরুষ বিশাল পুঁজির বিরুদ্ধে জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে নেমেছিলো? মনে হয় তা নয়। সময় তাদের লক্ষ্যটা নির্ণয় করে দিয়েছিলো। ক্ষতি হয়েছিলো পূর্বে চীনের পশ্চিমে আমেরিকার। তবে তারা খুব সুসংহত। বঙ্গবন্ধুকে শেষ পর্যন্ত মরতে হয়েছে তাদের বাজার ফিরিয়ে দিয়ে।

তবে কী শ্রাবণী শায়লাদের কোনো লক্ষ্য বা দর্শন নেই? না নেই আমি নিশ্চিত। পুঁজিবাদীর কাজ এগুলো। পুঁজিবাদীরা আপনার লক্ষ্য ঠিক করে রেখেছে, কী হবেন আপনি বর্বর শিক্ষক বা শিক্ষিকা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, মন্ত্রী-আমলা, মিলিটারী নাকী বোধ সম্পন্ন মানুষ? শেষেরটি অবশ্যই নয়, তাতে তাদের কোনো লাভ নেই। লাভ আছে শ্রাবণী শায়লা বানানোর মধ্যে, খবর্দারীতে পারদর্শী বর্বর শিক্ষিকা বানানোর মধ্যে। শ্রাবণী শায়লা বা খবরদারীতে পারদর্শী শিক্ষিকা তাদের পুঁজির সুরক্ষা দিবে মানে ক্ষমতা বা বানিজ্যের ধারা অব্যাহত রাখবে অনন্তকাল।

জগতের সকল প্রাণীর মতো মানুষ নয়, তার একটি সমৃদ্ধ মস্তিষ্ক রয়েছে; তবে তাকে বোধসম্পন্ন মানুষ হয়ে উঠতে হয় জ্ঞান অর্জনের মধ্যদিয়ে। এই বোধটা যতক্ষণ নিজের ভেতর জাগ্রত করতে না পারবে ততক্ষণ সে কেবল একটি ইতরবিশেষ বৈ কিছুই না, সে নারী হোক বা পুরুষ।

পুঁজিবাদীরা খুব সুসংহত, তাদের জালের বিস্তার বিস্তর। আপনার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবে আপনার টের পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। জন্মের পর আপনি পরে যাবেন এক গোলকধাঁধায়, আই ফোন, বিসিএস, পিএইচডি। একটি বিসিএস দিয়ে আপনাকে আপনার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। মা হয়ে যাবে বুড়ি, ভাই কামলা, বাবা মূর্খগেয়ো। আমারা শ্রাবণী শায়লার বেড়ে উঠা শিক্ষাজীবনে একটু ডুব দিলে অনেক কিছু তুলে আনতে পারি।

ওর বিদ্যালয়ের নাম কি ছিলো, বলা বাহুল্য কিন্ডারগার্ডেন। ওরকম বিদ্যালয়ের কক্ষগুলো হয় গাও গ্রামের হাঁস-মুরগীর খোয়ারের মতো। কিন্ডারগার্ডেনের ছেলেমেয়েদের ভোরে ঘুম থেকে উঠে, নাকে মুখে কিছু গুঁজে একটি খাঁচায় চেপে স্কুলে যেতে হয় মিলিটারি কায়দায় বুট, টাই, ব্যাজ, উর্দি পড়ে। সেখানে না আছে কোনো আঙ্গিনা না আছে কোনো বৃক্ষ। আছে জবরদস্ত শিক্ষকমন্ডলী, তারা স্বপ্ন দেখায় Golden GPA-5 যার মধ্যে লুকিয়ে আছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র, পাইলট, মেজর হওয়ার মন্ত্র। শ্রাবণী শায়লার হৈমন্তী হওয়ার আর কোনো অবকাশ থাকে না। পুঁজিবাদীর বা পুরুষতন্ত্রের আরেক বড় ছলনার নাম মৌলবাদ, মৌলবাদের প্রধান অস্ত্র স্বর্গ-নরক শব্দাবলী। এ অস্ত্রটি দিয়ে নারীকে ঘুম পাড়ানো বেশ সহজ। জন্মের পরই নারীকে শোনানো হয় বাইবেলীয় গল্প, ঈভ অ্যাডাম। অ্যাডামের পাজরের হাড় থেকে সৃষ্টি ঈভের, লক্ষ্য অ্যাডামের মনোরঞ্জন। অ্যাডামের পায়ের তলায় ঈভের স্বর্গ, সেটা অর্জন করে নিতে হবে যথেষ্ট মূল্য দিয়ে। নারী আর যায় কোথায়? অ্যাডাম আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে ঈভকে।

রাধা তার প্রাণপ্রিয় সখি। কতটুকু প্রাণপ্রিয়? রাজ্য বা সম্পদের চেয়ে বেশি? হতেই পারে না। তাইতো মথুরায় গিয়ে কংসকে বদ করে রাজ্য দখল করে ভুলে যায় রাধাকে। রাধা এখনও পথ চেয়ে বসে আছে পুরুষতন্ত্রের পাঁকে পড়ে।

1782 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।