নারীর ‘নারী’ হয়ে ওঠার পেছনে মূল ভূমিকা কার, প্রকৃতির না সমাজের? এ প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ নয়। সমাজে নারী পুরুষের তুলনামুল অবস্থান, তাদের পারষ্পরিক সম্পর্কের প্রকৃতি, এধরণের বিষয়গুলোর আমরা সামাজিক তথা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। নারী পুরুষের প্রকৃতিপ্রদত্ত পার্থক্যগুলোর বিবেচনায় এই বিষয়গুলো দেখার চেষ্টা করাটা বেশ অস্বস্তিকর – বিশেষত সভ্য সমাজে যেখানে সব মানুষের সাম্য ও মর্যাদা সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানদন্ড হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু প্রকৃতি ও সমাজ আলাদা কিছু নয়; মানবজাতি ও সমাজের ওপর প্রকৃতির প্রভাব গভীর, আদিম। আধুনিক বিজ্ঞান প্রকৃতি ও সমাজের সম্পর্ক নিবিড়ভাবে নিরীক্ষণের সুযোগ করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের কল্যানে আজ আমরা কিছুটা হলেও বুঝি সমাজে নারীর ‘নারী’ হয়ে ওঠার পেছনে প্রকৃতির ভূমিকা কতটুকু।
আমরা জানি, সমাজে নারী বরাবরই বঞ্চিত ও নিগৃহীত, দুর্বল হিসাবে বিবেচিত। তবে সত্যিটা শুনতে আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, নারী পুরুষের শারীরিক পার্থক্যই আসলে তাদের ‘সামর্থে’ একটা বিশাল ফারাক এনে দেয়, নারীকে করে দেয় দুর্বল এবং ফলস্রুতিতে বঞ্চনা ও নিগ্রহের লক্ষ্য। এখানে সামর্থ বলতে কিন্তু বুদ্ধি বা দৈহিক শক্তি বোঝানো হচ্ছেনা। বিশেষত প্রজনন ভূমিকার পার্থক্যের কারণে নারী পুরুষ যে তুলনামূলক সুবিধা-অসুবিধাগুলোর মুখোমুখি হয়, এবং তার ফলে তাদের সামগ্রিক সক্ষমতার যে বিশাল একটা পার্থক্য তৈরি হয়ে যায়, সামর্থ বলতে এখানে এই পার্থক্যের কথাই বোঝানো হচ্ছে।
গর্ভধারণ, ঋতুচক্র এবং এগুলোর সাথে জড়িত শারীরিক-মানসিক ধকলগুলো শুধু নারীদের ভাগ্যেই জোটে। তার ওপর নারী যখন একটা বাচ্চার জন্ম দেয় তখন তার যৌবনের সূর্য তখন সবে উঠেছে বা বড়জোর মধ্যগগনে। এই বয়সটা কিন্তু যেকোনো কিছু অর্জন করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এমনকি কবিও বলে গেছেন, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু যৌবনের প্রায় পুরোটা সময়ই নারীর জীবনজুড়ে থাকে সন্তান। অন্য যেকোনো কাজের জন্য তাকে সময় ‘বের করে’ নিতে হয়, তা সে মিছিলে যাওয়াই হোক বা চাকরী করাই হোক বা হোক যেকোনো বুদ্ধি বা দক্ষতার চর্চা। পুরুষের কিন্তু সন্তানপালনের দায়ের ভাগ খুব সীমিত; তারা মুক্ত পাখির মত পাখা মেলে দিতে পারে সম্ভাবনার খোলা প্রান্তরে। তাই পুরুষের সাথে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে নারী পারবে কেন? এখানে সাম্যবাদীরা প্রশ্ন তুলবেন, সন্তান কি নারীর একার? পুরুষের নয়? তাহলে কেন সন্তান পালনের দায়টা নারীর একার? এর কারণটা কি তবে রাজনৈতিক নয়? সিমন দ্য বোভ্যোয়া বা হুমায়ূন আজাদের মত নারীবাদী বোদ্ধারা একে পুরোপুরি পুরুষের রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের ফল হিসাবে দেখবেন। তাদের কথার জোরালো যুক্তি আছে, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মানবসভ্যতার প্রেক্ষাপটে কি করে পুরুষ একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করল, এর শুধু রাজনৈতিক, অর্থিনৈতিক বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা হয়না। এর পেছনের কারণ আরো মৌলিক। কারণটা বিবর্তনীয়, জিনগত।
এই প্রবন্ধে আমি নারী পুরুষের জিনগত বিবর্তনের পার্থক্য এবং এর ফলাফল নিয়ে আলোচনা করব।1 প্রথমেই আমরা চিন্তা করি, সন্তান যদি নারী পুরুষ দুজনেরই যৌথ সম্পদ হয়, তাহলে কেনো নারীর ওপর সে সন্তান পালনের দায়ভার বেশি? সন্তানের জিনে তো নারী ও পুরুষের অংশীদারিত্ব কাঁটায় কাঁটায় সমান – সন্তানের জিনের অর্ধেক আসে মা’র কাছ থেকে আর অর্ধেক বাবার কাছ থেকে। আমরা যদি স্বার্থপর জিনের তত্ব মেনে নেই, তাহলেও তো হিসেব মিলছেনা। অর্থাৎ জিন যদি শুধুমাত্র তার যতগুলো সম্ভব প্রতিলিপি তৈরি করার উদ্যেশ্যে স্বার্থপরভাবে জীবদেহকে কাজে লাগায়, তবুও তো সন্তান পালনে নারী পুরুষের সমান দায়িত্ব পালন করা উচিৎ, কারণ সন্তানের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের সমানসংখ্যক জিনের প্রতিলিপি তৈরি হচ্ছে। এই প্রশ্ন তথা নারী পুরুষের সম্পর্ক ও দ্বন্দের মূল উৎস খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে বিবর্তনের একেবারে গোড়ার দিকে।
জিনের মূল উদ্যেশ্য হচ্ছে নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা। তাই আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে জিনের উদ্যেশসিদ্ধির জন্যই বাবামা বাচ্চাপালনে একে অন্যকে সমানভাবে সহযোগীতা করবে, হাজার হলেও বাচ্চাকে তো জিন অনুযায়ী দু’ভাগ করে নেওয়া যায়না। কিন্তু ধরুন যদি কোনো এক পক্ষের কাছে দায়িত্ব পালনে ফাঁকি দিয়েও নিজের জিনের প্রতিলিপি তৈরি করা অর্থাৎ বংশবিস্তার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু স্বার্থপর জিনের তত্ব অনুযায়ীই সে সেই সুযোগটা গ্রহণ করবে। নারী-পুরুষের সম্পর্কে ঠিক এটাই ঘটেছে।
চলুন দেখি, বিবর্তনের গোড়ার দিকে কিকরে নারী পুরুষের বিভাজন তৈরি হল। নারী পুরুষ বা আরো সাধারন অর্থে জীবজগতে স্ত্রী ও পুং লিঙ্গবিভাজন আমরা কিকরে করি? বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রে এই বিভাজনটা খুব মোটাদাগের। স্ত্রীজাতি সন্তান গর্ভে ধারণ করে, আর পুরুষ করেনা। তবে অনেক নিম্নশ্রেণির প্রাণীর ক্ষেত্রে এবং বিশেষকরে উদ্ভিদজগতে এই বিভাজনটা মোটেই স্পষ্ট নয়। স্ত্রী-পুরুষের মূল পার্থক্য আসলে তাদের জননকোষে। স্ত্রীজাতীয় জীবের জননকোষ সাধারণত হয় অনেক বড় ও সংখ্যায় কম, অন্যদিকে পুরুষজাতীয় জীবের জননকোষ সাধারণত হয় ছোট ও সংখ্যায় বেশি।
সৃষ্টির শুরুতে যৌন প্রজনন ছিলনা। যৌন প্রজননের গোড়াতেও খুব সম্ভবত স্ত্রী-পুরুষের পার্থক্য ছিলনা। তখন প্রজনন প্রকৃয়ায় দু’পক্ষই সমানসংখ্যক জিনের পাশাপাশি সমপরিমাণ খাদ্যও সরবরাহ করত ভ্রুণের বৃদ্ধির জন্য। ভেবে দেখুন, ডিম ফুটে যে বাচ্চা বের হয়, ভ্রুণ থেকে বাচ্চা তৈরি হওয়ার জন্য তো ডিমের ভেতরেই যথেষ্ঠ খাবার বা রসদ থাকে। যৌন প্রজননের গোড়ার দিকে সে খাবারে স্ত্রী ও পুং জননকোষের অবদান ছিল সমান যেহেতু স্ত্রী বা পুং জননকোষ বলতে তখন আলাদা কিছু ছিলইনা। জিনের পরিবর্তনের(mutation) ফলে কোনোকোনো জননকোষ আকারে বড় হতে লাগল। বিবর্তনে এসব বড় জননকোষ সুবিধা পেতে লাগল কারণ এসব জননকোষের মাধ্যমে নিষিক্ত ভ্রূণে খাবারের পরিমাণ থাকত বেশি। ফলে এসব ভ্রূণ থেকে জন্মানো বাচ্চার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা হত বেশি। তাই গোড়ার দিকে জননকোষের আকৃতি যত বড় হতে লাগল, সেসব জিনের প্রতিলিপির সংখ্যাও বাড়তে লাগল; এসব জননকোষ বড় থেকে আরো বড় হতে থাকল। একই সাথে আরেকটা ব্যপার ঘটল। আকারে বড় হওয়ার কারণে এসব কোষের চলনক্ষমতা কমতে থাকল, ধীরে ধীরে এসব কোষ যে দেহে উৎপন্ন হত সে দেহের ভেতরেই রয়ে যেতে লাগল।
এর ফলে অন্য আরেক ধরণের জননকোষ সুবিধা পেতে লাগল; এমন জননকোষ যেগুলো আকৃতিতে ছোট এবং ফলে দ্রুতগতিসম্পন্ন। এই ক্ষুদ্র ও গতিময় জননকোষগুলো বড় জননকোষগুলোকে খুঁজে নিতে লাগলো। আর মধ্যমাকৃতির জননকোষগুলোর এই দুটোর কোনো সুবিধাই ছিলোনা, ফলে বিবর্তনের স্রোতে এগুলো হারিয়ে যেতে থাকল। কালক্রমে বড় জননকোষধারী জীবগুলো হয়ে উঠলো স্ত্রী এবং বহুসংখ্যক, ক্ষুদ্র জননকোষধারী জীবগুলো হয়ে উঠলো পুরুষ।
জননকোষ একধরণের সম্পদ, স্ত্রীজাতি সন্তানপ্রতি এই সম্পদ বেশী পরিমাণে সরবরাহ করতে শুরু করল, আর পুরুষজাতি তুলনামূলক কম সম্পদ সরবরাহ করেও সমানসংখ্যক জিনের প্রতিলিপি তৈরি করা নিশ্চিত করতে পারল। উপরন্ত স্তন্যপায়ী গোত্রভুক্ত প্রাণীর স্ত্রীশরীরের ভেতরেই সন্তানের বর্ধণ হওয়ার ফলে স্ত্রীজঠর জটিলভাবে বিবর্তিত হতে লাগল বর্ধণশীল সন্তানের বৃদ্ধি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে; এমনকি জন্মের পরেও মায়ের দুধই হয়ে উঠল শিশুর প্রধাণ খাদ্য, যেকারনে এ গোত্রের নাম রাখা হল স্তন্যপায়ী। এই গোত্রের অন্তরভূক্ত স্ত্রীশরীর বাঁধা পড়ে গেল সন্তানউৎপাদনচক্রে। এই গোত্রের তথা পুরো প্রাণীজগতের সবচেয়ে অভিজাত প্রজাতি হল মানুষ, তার বুদ্ধিমত্তার কল্যানে। বুদ্ধিমত্তার মূল্য মানুষ দিয়েছে নানাভাবে। তবে নারীকে দিতে হয়েছে এর সর্বোচ্চ মূল্য, তাঁর প্রজননভূমিকার কারণেই।
মানুষের মস্তিষ্ক অন্য যেকোনো প্রাণীর তুলনায় বড় আর সেকারণেই মানুষ বুদ্ধিমান। এমনিতেই দুপায়ে হাঁটার সুবিধার্থে নারীর নিতম্ব ও যোনীপথ সরু হয়ে এসেছিল। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। বড় মাথাওয়ালা বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে তাই মারা পড়তে লাগল নারীরা। তুলনামূলকভাবে ছোট মাথাযুক্ত অর্থাৎ অপরিণত বাচ্চার জন্ম দিচ্ছিল যেসব নারী, তারা এবং তাদের সন্তান বেঁচে রইল বেশিহারে। ফলে অপরিণত বাচ্চাপ্রসবের জন্য দায়ী জিনের প্রসার ঘটতে লাগল। কালক্রমে সব মানবশিশুই জন্ম নিতে লাগল অপরণতভাবে; তাই একটা মানবশিশুকে বড় করে তোলা এত কষ্টকর। এই বিবর্তনে যে নারীর সন্তানজন্মদানের কষ্ট খুব একটা কমল তা নয়, তবে এর সাথে যুক্ত হল বছরের পর বছর ধরে সন্তান বড় করে তোলার দায়িত্ব।
নারীর গর্ভকাল দীর্ঘ ও জটিল, এজন্যে তাকে পোহাতে হয় কঠোর শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তি। এই উচ্চমাত্রার সম্পদ ও সময় বিনিয়োগের কারণে নারী সারাজীবনে খুব কম সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিতে পারে। উপরন্তু একজন নারী উর্বর থাকে ১২ বা ১৩ বছর থেকে শুরু করে বড়জোর ৫০ বছর পর্যন্ত। তাছাড়া ১৬ বা ১৭ হওয়ার আগে পর্যন্ত নারী শরীর সন্তানজন্মের মত জটিল ও কষ্টকর প্রকৃয়ার ধকল সইবার জন্য ঠিক প্রস্তুত হয়না। আবার ৩৫ বা ৪০ এর পর থেকেই নারীর উর্বরতাও দ্রুত কমতে থাকে। এই কারণে নারীর সর্বোচ্চসংক্ষক সন্তান উৎপাদনক্ষমতা কমে যায় আরো। একজন পুরুষের সন্তান উৎপাদন সক্ষমতাকাল হয় দীর্ঘ; কৈশোর থেকে শুরু করে প্রায় জীবনের শেষ পর্যন্ত সেটা বজায় থাকে। সেটা সম্ভবও হয় পুরুষের তুলনামূলক কম জটিল জননতন্ত্র থাকার কারণে। তাই জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, প্রতি সন্তান উৎপাদনে পুরুষের সময় ও সম্পদের বিনিয়োগ অত্যন্ত কম, একজন পুরুষ তাই এক জীবনে অগণিত সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম স্ত্রীজাতির সম্পদের ওপর ভর করে। আর এখান থেকেই পুরুষের কাছে নারীর পরাজয়ের শুরু।
বারোশো শতকের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা চেঙ্গিস খানের বিশ্ববিজয়কালীন সর্বগ্রাসী নারীলিপ্সার ফলে নাকি আজ মংগোলিয়ার ১০% এবং বিশ্বের ০.৫% পুরুষের দেহে তার ওয়াই ক্রোমোজম থাকার সম্ভাবনা আছে; তাহলে সারা বিশ্বে তার উত্তরসূরির সংখ্যা কত একবার ভেবে দেখুন!2 চেঙ্গিস খান যদি নারী হতেন, তাহলে কি এর ধারে কাছেও যেতে পারতেন? কয়টা সন্তানের জন্ম দিতে পারতেন তিনি, আর এত সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে যুদ্ধই বা করতেন কখন?
সন্তানের মূল্য নারীর কাছে তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণে সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং মায়া দুটোই বাবার চেয়ে মায়ের বেশি। একজন পুরুষের জন্য এক নারী সঙ্গী থেকে আরেক সঙ্গীর দিকে হাত বাড়ানো বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবু তার কিছুনা কিছু সন্তান পৃথিবীতে বেঁচে থাকার যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু একজন নারীর জন্য সে সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। একজন পুরুষের নারীসঙ্গীটি কি পারবে সন্তান উৎপাদনের বিপদসংকুল, কষ্টকর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে একটা সন্তানকে সহজে অবহেলা করতে? সীমিত জীবনে (এবং যৌবনে) এত কষ্ট করে সন্তানের জন্ম দিয়ে সে সন্তানকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়াটা নারীর জন্য জুয়া খেলার সামিল। তাই অন্তত ছোটো অবস্থায় একটা বাচ্চাকে বাবা যত সহজে ত্যাগ করতে পারে, একজন মায়ের জন্য সেটা হাজারগুণ কঠিন। সমাজে সন্তান ফেলে বাবার চলে যাওয়াটা উল্লেখযোগ্য কিছু নয়, কিন্তু মায়ের চলে যাওয়াটা এখনো একটা খবর।
প্রতিলিপি তৈরি করাই যদি জিনের একমাত্র উদ্যেশ্য হয়ে থাকে তাহলে নারী পুরুষ যে কারো জিনগত সুবিধাজনক কৌশল (কৌশল বলতে মানুষ সজ্ঞানে যে কৌশল গ্রহণ করে সেটা বোঝানো হচ্ছেনা, বরং জিনের সর্বোচ্চ বিস্তারের জন্য যে কৌশল প্রকৃতিতে বিবর্তিত হয়ে আসে, সেটা বোঝানো হচ্ছে) হচ্ছে প্রতিটি সন্তানের পেছনে যতটা সম্ভব কম সম্পদের বিনিয়োগ করা, যাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ শারীরিক সম্পদ ও সময়ের ভেতরে সর্বোচ্চ সংক্ষ্যক প্রতিলিপি তৈরি করা যায়। বিবর্তনের পরিহাসে পুরুষ সেটার পূর্ণ সুযোগ নিতে পারলো আর নারী তা পারলনা। বছরের পর বছর ধরে সন্তানপালনের পেছনে সময় ব্যয় করা তাই পুরুষের জন্য আকর্ষণীয় বিবর্তনীয় কৌশল নয়। আর বিবর্তনীয় করণেই নারীর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তার সন্তান।
বিবর্তন পুরুষকে দিয়েছে নারীর এই ‘দুর্বলতা’ ব্যবহারের সুযোগ। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো। বিষয়টা এমন নয় যে, পুরুষজাতি খুব চিন্তাভাবনা করে, সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে নারীর এই দুর্বলতা ব্যবহার করে তাদের দাবিয়ে রাখে। জিনগত পার্থক্যের কারণে সৃষ্ট নারীপুরুষের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক যে পার্থক্য ও পারষ্পরিক সম্পর্কের যে বিবর্তন, তা প্রাকৃতিক বিবর্তনের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে এবং বলতে গেলে প্রায় স্বয়ংকৃয়ভাবে হয়েছে। হ্যা, নারীজাতির সাথে এটা অবশ্যই অন্যায় হয়েছে, কিন্তু এই অন্যায়ের মূল হোতা কিন্তু মানুষ নয়, প্রকৃতি নিজেই।
নারী সমাজে শোষিত হয়েছে, হচ্ছে, ভয়ানকভাবে, আর এর গোড়ার কারণ হল নারীর ডিম পুরুষের শুক্রাণুর চেয়ে বড়। নারীর ডিম্বানু মানবদেহের সবচেয়ে বড় কোষ আর পুরুষের শুক্রাণু দেহের সবচেয়ে ছোটো কোষ আর আশ্চর্যভাবে ছোটোর কাছে বড়র হয়েছে পরাজয়।
সন্তান জন্মদান এবং লালনপালনের প্রকৃতিপ্রদত্ব এ দায়িত্ব এককভাবে একজন নারীর পক্ষে পালন করা অত্যন্ত দূরহ। আদিম যুগের কথা চিন্তা করুন। একটা বাচ্চা জন্ম দিয়ে লালন পালন করে একটা নারী কি কখনই পারত একই সাথে শিকার করে, জঙ্গল থেকে ফলমূল কুড়িয়ে নিজের আর সন্তানের ভরণপোষণ করতে? আজকের যুগেও তো একজন একা মায়ের পক্ষে কাজ করে বাচ্চা মানুষ করা ভীষণ কঠিন। তাই সন্তান জন্মদান ও লালনপালনে সহায়তার মূল্য হিসাবে নারী মেনে নিয়েছে একের পর এক সামাজিক শর্ত (পুরুষের পক্ষে), হয়েছে অবদমিত। তাছাড়া সন্তানের পেছনে নারীর জীবন যৌবনের অনেকটাই চলে যাওয়ার ফলে অন্যান্য কর্মকান্ডে পুরুষের তুলনায় নারীর যে পিছিয়ে পড়া, সেটা সমাজ ও পুরুষের কাছে নারীকে আর বেশি অবদমিত করেছে।
তাই বলে নারীর এই সামাজিক অবদমন কি অবশ্যম্ভাবী? কখনই নয়। প্রথমত, যা প্রাকৃতিক তাই নৈতিক, একথা অযৌক্তিক। দ্বিতীয়ত, নিজে বিবর্তনের ফসল হওয়া সত্বেও মানুষ তার যুক্তিবুদ্ধির জোরে, সংস্কৃতির প্রভাবে বহু বিবর্তনীয় প্রবণতাকে উপেক্ষা করেছে। যেমন ধরুন সন্তান জন্ম দেওয়া জিনের আদি অকৃত্তিম উদ্যেশ হলেও লক্ষ লক্ষ ক্যাথলিক পাদ্রী, বৌদ্ধ ভিক্ষু, হিন্দু সন্যাসী সে উদ্যেশ্যকে কাঁচকলা দেখিয়ে সন্তানহীন জীবন বেছে নিচ্ছেন ‘বিধাতা’কে সন্তুষ্ট করার নিমিত্তে। দেশের জন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে যুগের পর যুগ লক্ষকোটি মানুষ নিজের তথা ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবন বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে অকাতরে। সেরকম নারীকে শুধু মানুষ হিসাবে দেখে, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব সমানভাবে পালন করে, এমন পুরুষ সমাজে ছিল এবং আছে।
তাই জিনের প্রভাবটাই শেষ কথা নয়। এমনকি আধুনিক বহু নারী জিনের মূল উদ্যেশ্য অর্থাৎ সন্তান জন্ম দেওয়ার প্রবল টান থেকে বেরিয়ে আসছেন, তারা সন্তান চাইছেননা। একের বেশি সন্তান চাননা এরকম নারীর সংখ্যা বিশ্বে এখন অনেক। চাইবেনই বা কেন? আধুনিক যুগে যখন অনেক নারীই উপভোগ করছেন মুক্তির স্বাদ, সন্তান-সংসারের চক্রাবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে আবিষ্কার করছেন নিজেদের শক্তি, সামর্থ, তখন কেনো তারা মেনে নিতে চাইবেন সন্তান জন্ম দেওয়া ও বড় করার মত এত কঠিন দায়িত্ব একা হাতে সামালনোর ভার নিতে, বিশেষত যেখানে তাকে কর্মজগতের গন্ডিটা ছোটো করে আনতে হবে অথবা দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করতে হবে? ইতোমধ্যে জাপান এবং ইওরোপের বহু উন্নত দেশে অত্যন্ত নিম্ন জন্মহার সেসব দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য একটা ব্যপক প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠছে। এসব দেশে বয়ষ্ক লোকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে; অন্যদিকে সেসব বয়ষ্ক লোকের ভরণপোষণে জন্য কার্যক্ষম তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা কমছে। ফলে সেসব দেশের অর্থনীতিতে নামছে দীর্ঘমেয়াদী মন্দা।
আধুনিক যুগে নারীর প্রতি সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার শুধু নারীর মানবাধিকারের জন্যই নয়, একটা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী শুধুমাত্র যে তার কর্মক্ষমতা দিয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে তা নয়, সুস্থ সবল সন্তানের জন্ম দিয়ে মানবজাতিকে রাখতে পারে গতিময়। একটা সন্তান শুধু একটা মায়ের সম্পদ নয়, সে সমাজেরও সম্পদ। আজ তাই সমাজ টিকিয়ে রাখতে হলেও নারীর প্রতি করতে হবে ন্যায়বিচার, ঘরে ও বাইরে।
শুধুমাত্র জৈবিক পার্থক্যের কারণে নারীরা সৃষ্টির শুরু থেকে অধিকারবঞ্চিত হয়ে আসছে। তা বলে সেটা যদি চলতেই থাকে তাহলে আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবী করব কি করে?
1 রিচার্ড ডকিন্সে Selfish Gene বইয়ে নারী পুরষের পার্থক্য নিয়ে যে আলোচনা করেছেন, এই লেখায় সেই আলোচনা থেকে অনেক তথ্য ও যুক্তি নেওয়া হয়েছে।