আমার নাম নলিনী। আদালতে যে রকম করে হলফনামা শুরু করে, সে রকম করে এই বয়ান। যাহা বলিবো সত্য বলিবো, সত্য বই মিথ্যা বলিবো না। আপনারা যারা এই মুহূর্তে আমাকে শুনছেন, আমাকে মন দিয়ে শুনুন। শোনাটাই শুধু আপনাদের কাজ, ধর্ম। পিন পতন নীরব থেকেই শুনুন।
ধর্ম শব্দটা শুনে অনেকে খানিকটা নড়েচড়ে বসতে পারেন। আমি জানি এই শব্দটা শুনলে অনেকে অনুভূতি জাগ্রত করবেন খরগোশ কানের মতো। খানিক বিচলিত হবেন।
আমার নাম নলিনী না হয়ে জবাকুসুম হতে পারতো, মার্গারিটা হতে পারতো, আসিয়া বিবি হতে পারতো। কথা সেই একই। এটা তো জানেন আমার জন্মের উপর আমার হাত ছিলো না। নিজের ইচ্ছায় আমি পৃথিবীতে এসে হাত পা ছুঁড়ে ওয়া ওয়া করে কাঁদি নি। বড় অসহায় আমরা মানব সন্তান। কবুতরের শাবক বেশি হলে ৭ দিন মায়ের নির্ভর থাকে। মানব শিশু দীর্ঘ দীর্ঘ দিন তার পরিবারের উপর নির্ভর করে।
আপনাদের সবার মতোই আমার নামটা বাবা মায়ের দেয়া। আমার ধর্মটাও। ছোটবেলা থেকে আমাকে যা গেলানো হয়েছে, তাই আমি ধারণ করে এসেছি অলক্ষ্যে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়তন আমাকে বেড়া দিয়েছে, পই পই করে সারাক্ষণ মন্ত্র শিখিয়েছে: এই হলো আমি। এই আমার পাপ এই আমার পুণ্য।
আমি যে কাঠামোতে জন্মেছিলাম, আমার চারপাশে যে হাতগুলো আমাকে কোলে পিঠে বড় করেছে, সেই সব দৃশ্যমান অদৃশ্যমান হাতগুলো শোভন কার্তিক ছিলো না। বড় অসহায় হয়ে বলছি আমার সীমাবদ্ধতা আমার নারী যন্ত্রে।
বিশ্বাস করুন, আমার সমকক্ষ মানুষ যখন আমার সালতানাত মাপে ফিতা দিয়ে, আমাকে বাটখারায় চাপায় মাংসের মূল্যে, আমি মুষড়ে পড়ি। হতাশায় এক দীঘল দিঘিতে ডুবতে থাকি। আপনাদের সমান একটা মাথা নিয়েও আমি হেরে যাই আপনার চোখ কুঁতকুঁত মাংস মাপার দণ্ডে।
বিশ্বাস করুন: মানব সংহিতায় এ বড় অন্যায়। ঘোর অন্ধকারের সূচনা।
শুরুতেই বলেছিলাম আমার নাম নলিনী না হয়ে আসিয়া বিবি হতে পারতো। আমাকে বাঁচানোর জন্যও আপনাকে আপোষ করতে হয়। সংসারের এক তুচ্ছ নারীর জন্যও প্রতিষ্ঠান কী মহা হুংকার হয়ে ওঠে সে তো আপনারা সবাই জানেন।
হায় মানবকূল অনুগ্রহ করে কি আপনারা আমার মাথার দিকে তাকাবেন না? অবশ্য না তাকানোই যে রেওয়াজ। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই যে ভারতবর্ষে প্রথম মেয়ে রাজা হয়েছিলেন সুলতানা রিজিয়া। এহেন বিদ্যা ছিলো না যে তিনি জানতেন না, অথচ কী আশ্চর্য সমস্ত পারিষদ মাপছিলো রিজিয়ার শরীর। তিনি হেরে গেলেন মসনদের লড়াইয়ে।
আমার নাম নলিনী না হয়ে যদি খনা হতো, সেই একই ছুরি। আমার স্বামীই আমার জিব কেটে দিতেন। লিলিথ হলে তো কথাই ছিলো না, আপনারাই বলতেন রাক্ষুসী।
যে নিগ্রহে আমি বড় হয়েছি, অসুস্থ সমাজ আমাকে তার ছায়ায় ছায়ায় বড় করেছে, বুঝতে পেরেছিলাম অধিকাংশ পুরুষের হাত আমাকে হাত বাড়িয়ে সমান তালে পা ফেলবার হাত নয়। সেই হাত কিলবিলের, অসহ্য নিগ্রহের।
প্যাড পরে আমি বোয়িং চালাতে পারি, নাসা থেকে মহাশূন্যে উড়াল দিতে পারি, নিউজিল্যান্ডের বাগান থেকে আপেল পেড়ে এনে আস্ত হাঁ করে কচকচ খেতে পারি অথচ আমি প্রার্থনা করতে পারি না, উপাসনালয়ে আমার প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায় অনুভূতির তীব্র চাবুকে।
আমার মা-ই আমাকে কানে কানে শিখিয়েছেন; নারীর প্রকারভেদ। পদ্মিনী, চিত্রিণী, শঙ্খিনী, হস্তিনী। ৩৫০ কোটি নারীকে যখন এ শ্রেণিবিন্যাস করা হয় আমার হাসি পায়। রায়গুণাকর ভারত চন্দ্র আপনার সাথে আমার দেখা হলে ভালো হতো, বিশ্বাস করুন।
আপনি শীতের রাতে গরম দুধের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে নারী নিয়ে অশ্রাব্য ওয়াজ করবেন মাইকে অবদমিত পুরুষকুলের সামনে। আবার রাত পোহালেই আমাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ঢেকুর তুলবেন স্বার্থ জিকিরে।
কাল রাত থেকেই আমি এক ধাবমান ট্রেনের শব্দ শুনছি। ঝিকঝিক ঝিকঝিক। কোন পথে ছুটছে জানি না। কোথায় তার গন্তব্য তাও জানি না। আমি সত্যি জানি না। এই ধাবমান গতিশীল ট্রেনটা পতাকা দিয়ে থামিয়ে আমি তাতে উঠতে চাই।
মাথার দিব্যি রইলো, আমি ট্রেনটায় উঠছি। কি বললেন? থামিয়ে দেবেন যাত্রা? দেখি থামান তো?