কারো কারো মামীমা হলেও আমি কিন্তু শামীমা না – শামীম। আমার নাম শামীম। জন্মের সময় সেই ছয় দশক আগে যখন কোন কৃত্রিম জন্ম নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। যখন মায়ের নাড়ি ধরে যে বড় হচ্ছে- সে পুরুষ শিশু না না্রী তা জানার উপায় ছিলো না। যখন অনাগত সে শিশু এই ধরাতে এসে বেঁচে থাকবে তারও কোন নিশ্চয়তা ছিলো না। মার কাছে শুনেছি তখন নাকি ওরা এই ভেবেই ঐ নাম যা উভয় লিংগের জন্য প্রযোজ্য হবে রেখেছিলেন। আর বলেছিলেন, মেয়ে হলেও তাকে একটি ছেলের মতো সকল সুযোগ দেবেন। আমি সেই পরীক্ষার ফল। সে সময় পাকিস্তানী আমল। নাসিম, শাহীন, তাঞ্জিম ধরনের নামগুলো ছিলো। সে সময় নারী শিক্ষায় অনুপ্রেরণা দেবার জন্য শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার খাতায় নাম সংখ্যা লেখার আগে ‘এফ’ মানে ফিমেইল লিখেছি।
তো জন্মসূত্রে পাওয়া চেহারা ও নাম নিয়ে আমার যাত্রা শুরু। কিছু কিছু নামের পেছনের উপাধী দিয়েই কেবল সনাক্ত করা যেত ওরা ছেলে না মেয়ে। নেসা, খান, রহমান। কিন্তু আমার মায়ের নাম আনোয়ারা খানম হলেও আমার নাম শামীম খানম বা বেগম ছিলো না। বাবার পদবী অনুযায়ী আমার নাম হয়েছিলো শামীম তরফদার। আবৃত্তি করি, সাঁতরাই, সাইকেল চালাই, গল্প বানাই, ডিবেট করি, গার্ল গাইডিংও। সে সময় বিখ্যাত চলচ্চিত্র রাজেন তরফদার ও আমাদের পরিবার ছাড়া কারো তরফদার শুনিনি। নামে বোঝাই যায় না আমি নারী না পুরুষ। আর এ কারণেই পুরুষ-ক্ষমতায় বিশ্বাসী সাহিত্য জগতে আমি অনেকটা চুরি করে প্রবেশ করি। তরফদারের ধারটা সম্পাদকগন লিংগ দিয়ে যাচাই করেন নি - বস্তুগুনে করেছেন। দৈনিক আজাদের মুকুলের মহফিলের বাগবান ভাইও জানতেন না। বিবাদ ভঞ্জন হলো পরে। তখন আমি সে খানে গার্লগাইডিং ক্যাম্প করে মারী থেকে ফিরে এসে ছবিসহ ‘মারীর ডায়েরী’ ধারাবাহিক লিখছি। তখন মেয়েরা ফুলেল ছাপা পরতো। এক রঙ হলো সার্টের জন্য। ছেলেদের।
নিজের গর্ব হতো- আমি জেন্ডার জাগ্রত না করেই এগুচ্ছি। মজা হতো লেখার বিল আনতে গেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়ার কালে পূর্বদেশ, ললনা, ইত্তেফাক এসব কাগজে গেলে এ্যাকাউন্ট বিভাগ হেসে বলতো, আমরা ভেবেছি আপনি পুরুষ!
যুদ্ধের পর আজাদকে বিয়ে করলাম। তখন গুলশানে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে বাসার গেট খুলে গেলে ও দাঁড়ালে কত মানুষ স্লামালাইকুম শামীম আজাদ ভাই বলে করমর্দন করেছে! এদিকে তখন আর্টস ফ্যাকাল্টিতে লিফট ছিলো না। বহু কষ্টে চারতলায় সিঁড়ি বেয়ে উঠেছি, একটি ছেলে বলে উঠেছে, এ্যাইরে মামা ডাক শোনা যায়! আমি বাসায় এসে কেঁদে ফেললাম। আর আমি পড়বো না। কিন্তু পড়ছি। সাবসিডিয়ারী ইংলিশ ও সোসিওলজি কোনো মতে পাশ করেছি কুড়ির মতো ঈশিতাকে পেটে নিয়ে। ওকে কোলে নিয়ে বালিশে খাতা রেখে লিখি। আম্মার কাছে ওকে রেখে ডিয়াইটিতে অনুষ্ঠান করতে গেলে প্রচুর আলোর নিচে গরমে ওর দুধ খাবার সময় বুক ভেসে যাবে বলে ব্রার ভেতরে নরম কাপড় ঠেসে যাই। তেমনি একদিন আজাদ অফিস থেকে এসে বললো, তোমার লেখা উঠেছে।
জানো কি করে?
বন্ধুরাই খবরটা দিলো। তবে বল্লো বোঝার উপায় নেই এ আমার বউ। কারণ আমার পদবী নেই।
আজাদের বন্ধুদের চাপে আমি শামীম আজাদ হলাম। এবার নাম নিয়ে না হলেও নবাগতের জায়গা পাবার লড়াই শুরু হলো। শামীম আজাদ পুরুষই কিন্তু নবাগততো! শুরু হলো আমার লেখা ছাপা না হওয়া। রসিক কবি সাজ্জাদ কাদির আড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয়ের লন কাঁপিয়ে হা হা করে বলে উঠলেন, শামীম আজাদ হয়ে হয়েছে কয়েদ। যারা জানতেন তারা জানতেন। সাপ্তাহিক রোববারের সম্পাদক আমার কবিতা লেখার গুরু রফিক ভাই একদিন বাংলা একাডেমিতে তার ঘরে আড্ডায় বললেন (১৯৮২), সবাই জিগায় এইটা কেঠা? আমি বলি আমার ভাই। তখন বাংলাদেশের মূলধারা সাহিত্যে রফিক আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, হালিম আজাদ এবং আলাউদ্দিন আজাদসহ শক্তিমান প্রচুর পুরুষ সাহিত্যিক ছিলেন। কেউ কেউ আবার আমাকে সামনে দেখলে আমি এদের কারো স্ত্রী ও ভেবে বসতো।
আমার কন্যার নাম ঈশিতা আজাদ। সে নাম পাল্টায়নি। ভাগ্যিস পাল্টায় নি। যা অবস্থা, তাহলে হুইটনি হিউস্টনের মতো তাকেও হয়তো সেই নাম কিনে নিতে হতো! সৃষ্টিশীল নারীর নাম পাল্টাবার কোনো দরকার আছে কি? এখনকার মেয়েরা তা করে না। করবে না।