নারী

সমতাই লক্ষ্য

অনন্ত বিজয়ের শেষ লেখা

বাংলাদেশের লেখক ব্লগারদের মধ্যে যে গুটি কয়জন ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন কী-বোর্ড, সমাজে বিজ্ঞান মনস্কতার প্রচারে কাজ শুরু করেছিলেন যে ক'জন তরুণ, যে ক'জন মনে প্রাণে বিজ্ঞানের চেতনাকে ধারণ করতেন, তাদের মধ্যে অনন্তের নাম অনন্তকাল ধরে উচ্চারিত হবে। যতদিন বাংলাদেশের ইতিহাসে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে মুক্তমনাদের নাম উচ্চারিত হবে, ততদিন অনন্ত বিজয়, অভিজিৎ রায়, নিলয় নীল, রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর বাবু আর নাজিম উদ্দিন সামাদ প্রমুখের নাম উচ্চারিত হবে। ১৯৫২-তে হয়েছিলো বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার। আর অনন্তেরা প্রাণ দিয়েছেন বাংলা ভাষায় মুক্তচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে।

আজ ১২ মে ২০১৮। তিন বছর আগের এই দিনে বাসা থেকে অফিসে যাবার জন্য বের হলে রাস্তায় খুন হন অনন্ত বিজয়। ধর্মান্ধ ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গি মুসলমানরা তাঁকে চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার তিন বছর পরেও মামলার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। সর্বশেষ ২৩ মে ২০১৭ তারিখে বাংলা ট্রিবিউন পোর্টালে অনন্ত বিজয় হত্যা মামলার একটি খবর পাওয়া যায়। জানা যায়, মামলাটির চার্জ গঠন সম্পন্ন হয়েছে। এরপরে মামলার শুনানি ঐ বছরের ২০ জুন থেকে শুরু হবার কথা ছিলো। শুনানি শুরু হয়েছিলো কি না, হলে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে অথবা এর পরবর্তী শুনানির তারিখই বা কত, সে সম্পর্কে বাংলা অন্তর্জালে কোনো খবর পাওয়া যায় না।

ইসলামী মৌলবাদের তোষামোদকারী সরকার অনন্ত বিজয় হত্যার বিচার নিয়ে কাল ক্ষেপন করলেও, দিন দিনে অনন্ত বিজয়রা বাংলা অন্তর্জালে চিন্তাশীল পাঠকের মনে জেগে উঠছেন নতুন করে। বিজ্ঞান মনস্ক লেখক, অনন্ত বিজয়ের লেখা, সম্পাদনা এবং যৌথ সম্পাদনার বইগুলো বাংলা অন্তর্জালের পাঠকদের মনে চিন্তার খোরাক যুগিয়ে যাচ্ছে অবিরত। অনন্তরা মুক্তমনা তরুণদের জন্য হয়ে উঠছেন বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক।

হত্যার তৃতীয় বার্ষিকীতে তাঁর শহর সিলেটে অনন্ত বিজয়কে স্মরণ করার নানান উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিচার দাবিতে 'অনন্ত স্মরণ' কর্মসূচির আয়োজন করেছে গণজাগরণ মঞ্চ, সিলেট।

সিলেট টুডে থেকে জানা যায়, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনন্ত বিজয়ের প্রতিকৃতিতে আলোক প্রজ্বলন করে অনন্ত হত্যার বিচারের দাবি জানানো হবে।

‘অনন্ত স্মরণ’ অনুষ্ঠানে সমমনা সবাইকে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চ, সিলেটের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু।

আজকের দিনে নারীর পাঠকদের জন্য অনন্তের লেখা শেষ ফেসবুক পোস্টটি প্রকাশ করছি। সত্যকে সত্য বলার কতটুকু দুঃসাহস অনন্তের ছিলো তা তাঁর শেষ পোস্টটি থেকে জানা যায়।

অনন্তের শেষ ফেসবুক পোস্টঃ একজন ক্ষমতাসীন সাংসদ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে চাবুক মারার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। চাবুক তো একসময় জমিদারদের হাতে হাতে থাকতো। প্রজাদের পান থেকে চুন খসলেই বলা নেই, কওয়া নেই চাবকিয়ে পিঠের চামড়া তুলে ফেলতো তারা। কিন্তু জমিদাররা পুকুর চুরি করলেও কারো মুখে রা কাটতো না!

ভাগ্য ভালো বলতে হয় আমাদের, এখন সেই আর জমিদারি যুগ নেই, তবে বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গ অ্যাপেনডিক্সের মতো কতিপয় উচ্ছিষ্ট জমিদার রয়ে গেছে এখনও! জনাব সাংসদ, আপনি কোন অপেনডিক্স বংশের জমিদার বলবেন কি?

সাংসদের চাবুক মারার কথা শুনে আমারও অধ্যাপক আজাদের মতো জানতে ইচ্ছে করে, আপনি কী পাস সেটা এখন আর জানার দরকার নেই, আপনি কী ফেল সেটাই না-হয় বলুন! মেধা-গুণ-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো দিক দিয়ে যে অধ্যাপকের হাঁটুর কাছে বসার যোগ্যতা এদের নেই তারাই আবার ওই অধ্যাপককে চাবুক মারার কথা বলে! কলিকালের শিক্ষা একেই বলে!

সাংসদ ক্ষমতার জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার হয়েছেন, তাতেই লঙ্কা বিজয় করে ফেলেছেন ভাবখানা ধারণ করে আছেন! একটা অনির্বাচিত সংসদের মেম্বার হয়েছেন, যেখানে লজ্জায় আপনাদের বিনম্র হওয়ার কথা, তা-না, উল্টো আপনাদের অনির্বাচিতদের ক্ষমতার দম্ভ দেখলে মনে হয়, বেহায়া আর কাকে বলে!

সাংসদ, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় আপনি কখনো গিয়েছেন কি-না সেটা জানার দরকার নেই আমাদের, আপনি বরং প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষককের নাম বলুন, বেঁচে থাকলে ওই শিক্ষককে আমরা জিজ্ঞেস করতাম, শৈশবে এরকম একটা বেয়াদপকে শিক্ষা দিয়ে নিজের অর্থপ্রাপ্তি ঘটানোর চেয়ে আপনার বরং কৃষিকাজই উত্তম ছিল। শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করার কী দরকার ছিল!

জনাব সাংসদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষককের বিরুদ্ধে "সিলেট-বিদ্বেষ"-এর অভিযোগ এনেছেন। তা জনাব, সিলেটের প্রতি এতো "আলগা-প্রেম" দেখানোর দরকারটাই বা কী! সিলেট কি বাংলাদেশের ভিতরে অন্য কোনো দেশের ছিটমহল, নাকি অন্য দেশের ভিতরে বাংলাদেশের কোনো ছিটমহল! আপনি কি কখনো প্রমাণ করতে পারবেন, আপনার তথাকথিত অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষক "বাংলাদেশ-বিদ্বেষী"! অধ্যাপকের প্রতি আপনাদের এতো গাত্রদাহের কারণটা কি? শুনেছি এই সাংসদের পিতা ছিলেন একাত্তরের পাকিস্তানের গণহত্যার সহযোগী শান্তি কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যলয়ের অধ্যাপক স্বাধীনতাবিরোধীদের বিপক্ষে একটি বজ্রকঠিন সাহসী কণ্ঠ। তিনি ক্লাসে, লেখালেখিতে, ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, ৭১-এর চেতনার কথা বলেন, স্বাধীনতার কথা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলেন। শিক্ষার্থীরা যেন অন্তর থেকে বাংলাদেশকে ভালোবাসে এজন্য দীর্ঘদিন ধরে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বলেই বোধহয়, আমাদের সাংসদের অধ্যাপকের নাম শুনলেই গাত্রদাহ শুরু হয়। সমীকরণটা বেশ সোজা।

সাংসদ অভিযোগ করেছেন, ওই শিক্ষকের কারণে নাকি সিলেটবাসীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না!! হাস্যকর কথাবার্তা! সিলেটবাসী মেধার জোরে পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, এতে কার কি সমস্যা আছে? আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে কোটাভিত্তিক ব্যবস্থা যারা চান সিলেটিদের জন্য, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, ঢাকাবাসী যদি দাবি করে শুধু ঢাকাইয়ারা ঢাবিতে পড়বে, অন্য কেউ না, চট্টগ্রামবাসী যদি দাবি করে শুধু চট্টগ্রামের লোকেরা কেবল পড়বে তাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালে যদি এমন দাবি উঠে তবে তো বাংলাদেশ আর অখণ্ড দেশ বলার দরকার নেই... বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিত্তি করে একেকটা অঞ্চলকে স্বাধীন দেশ বানিয়ে দিলে চলবে! সিলেটিরা কি ঢাবিতে, চবিতে, রাবিতে লেখাপড়া করছে না? শাবিপ্রবিতে কি সিলেটিরা পড়ছে না?

জনাব সাংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটার মানেই হচ্ছে বিশ্বপরিসরের বিদ্যালয়! তা আপনাদের মতো কতিপয় "ছিলটি মৌলবাদী"র বক্তব্য শুনলে মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনারা নিজের এলাকার প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেনের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন না। হয়তো ক্ষমতাসীন সাংসদ হওয়ায় আপনি নিজে কোনো প্রাইভেট স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনের পরিচালনা-কমিটির সদস্য, তাই বিশ্ববিদ্যালয় আর পারিবারিক সম্পত্তি কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে তফাৎ আপনি খুঁজে পান না। "ছিলটি-মৌলবাদী"দের কাছে সিলেট বাংলাদেশের কিছু নয়, সিলেট আলাদা একটা রাষ্ট্র! তাই বলি কী, সিলেটকে আগে বাংলাদেশ থেকে আপনারা বিচ্ছিন্ন করে ফেলুন, আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করুন, তারপর না-হয় যতখুশি "সিলেটি-প্রেম" দেখাবেন, আর তথাকথিত "সিলেট-বিদ্বেষী"দের খুঁজে বেড়াবেন। বাংলাদেশে থেকে, বাংলাদেশের খেয়ে, বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সাংসদ হয়ে বেশরমের মতো "আঞ্চলিকতা" করে বেড়াবেন তা তো হতে পারে না! আপনারা না-হয় আগে বাংলাদেশি আইডেনটিটি ত্যাগ করুন!

২০০৭ সালের দিকে আমি যখন "যুক্তি"র প্রথম সংখ্যাটা সম্পাদনা করি, সেখানে লেখক সুমন তুরহান-এর লেখা প্রকাশ করেছিলাম, যার নাম ছিল "সিলেটি মৌলবাদ"। এই লেখার শেষের দিকের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি :

"সিলেট, মহাসমুদ্রের একটি ক্ষুদ্রতম চর, আর আমরা সেই চরের অধিপতিরা, আর কিছু করতে না পারলেও জন্ম দিয়েছি একটি স্বতন্ত্র মৌলবাদের। সিলেটি মৌলবাদ, অত্যন্ত নীরবে, বহুদিন ধরেই ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ মহামারি আকারে, এখনই এই প্রগতিবিরোধী আঞ্চলিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ করে রেখে কোনো ইতিবাচক অর্জন আনা সম্ভব নয়। কোনো মুক্তমনের মানুষই আঞ্চলিক মৌলবাদে দীক্ষিত হতে পারে না; পারেন না সংকীর্ণতার দেয়ালে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে। পৃথিবীটা অনেক বড়ো, তবে আমাদের সুশীল ভণ্ডরা এখনো বেশ আদিম, তাঁদের সময় এসেছে কুয়োর বাইরে বেরিয়ে এসে বিশাল বিশ্বটাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার। আমরা প্রত্যেকে মানুষ, এবং আমরা প্রত্যেকেই বাঙলাদেশের বাঙালি--এই সহজ সত্যটি উপলব্ধি করতে সিলেটবাসীর আর কতোকাল লাগবে?"

অনন্ত বিজয়-এর শেষ ফেসবুক পোস্ট

 

নারী.নিউজ মনে করে, একটি সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সমাজে বিজ্ঞানের শিক্ষা ও দর্শন, বিজ্ঞান মনস্কতার প্রচারে অনন্ত বিজয়সহ সকল ব্লগার মুক্তমনা হত্যার বিচার সম্পন্ন হওয়া জরুরি, এবং জরুরি এই দাবিটিতে সোচ্চার হয়ে ওঠা।

2960 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।