৩৮ বছর বয়ষ্ক একজন বিবাহিতা গবেষক। পিএইচডি করছেন। কাজের প্রয়োজনে নিউক্লীয়ার পাওয়ারের উপর পড়তে হচ্ছে। শাশুড়ির ঘরে ডাক পড়লো। বাচ্চা কেনো হচ্ছে না অথবা নিচ্ছো না এ্ নিয়ে চরম অশান্তি করলেন। ছাতা মাথার সব কাজ ফেলে এই মাসের মধ্যেই ইন্ডিয়া যেতে হবে চিকিৎসা কারনোর জন্য বাচ্চা কেনো হবে না? আরে সন্তান হয় না বললেই হলো নাকি? মেয়েটা যা ইচ্ছা তাই কতগুলা কথা শুনে নিজের ঘরে নাকের জল চোখের জল এক করে তারপর আবার নিউক্লিয়ার পাওয়ার নিয়ে পড়তে বসলো।
একটুও বানিয়ে বলা গল্প না। এইটা হচ্ছে আমাদের প্রফেশনাল মেয়েদের নিত্য দিনের জীবন। যেই মেয়ের সন্তান হয় না বা যেই মেয়ে বাচ্চা নিতে চায় না তার আবার পিএইচডির মূল্য কি? সেই মেয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ার পড়লেই কি আর হাতি ঘোড়া পরলেই কি। ওর বাচ্চা হয় না ঘটনা শেষ।
মাসুমার সাথে আমার পরিচয় কক্সবাজারে একটা ট্রেনিং এ ২২ কি ২৩ বছরের সাংঘাতিক শার্প একটা মেয়ে। বছর খানেক হলো বিয়ে হয়েছে। আমার ট্রেনিং এর সেশন সকাল ৯টায় দেয়া। আমি খুবই সময় ধরা মানুষ। মেটামুটি বেশির ভাগই ঠিক সময়ে আসে না কিন্তু এই মেয়েটা একদম ঠিক সময়ে চলে আসে। নারী পুরুষ মিলে ২৪ জন পার্টিসিপেন্ট এর মধ্যে সবচেয়ে চৌকস সে। কথায় কথায় সে আমাকে হাসতে হাসতে বললো, শুধু মাত্র এই ট্রেনিংটায় অংশগ্রহণ করার জন্য প্রতি দিন তাকে সকালে ফযরের আজানের সময় উঠতে হয়। এক কেজি প্যাকেটের দুইটা আটার প্যাকেট খুলে সবগুলো আটার রুটি বানায়।
-আনুমানিক কতগুলা হয় রুটি? বলল
-আপা গুনিতো না তবে ৩৬ টার মতো বোধয় হয়।
দেবর, শাশুড়ি, জামাই মিলে ৯ জন সদস্য বাড়ির। আলু বা অন্য কিছুর একটা ভাজিও করে দিয়ে সবাইকে নাস্তা দেয়। তারপর স্বামীকে অফিসের জন্য রেডি করে দিয়ে, তারপর রামু থেকে টেম্পুতে করে কক্সবাজার আসে এবং এটি সে প্রতিদিন করছে। অথচ আমার ট্রেনিং রেসিডেনসিয়াল এবং থাকা খাওয়া সব অফিস বেয়ার করছে। এবং আমাদের পুরুষ ভাইগণ মোটামুটি সবাই এই সুবিধাটুকু নিচ্ছে। এইখানেই শেষ না প্রতিদিন বাড়ি ফিরে সন্ধ্যা বেলা ঘড় ঝাড়ু দেয় এবং মোছে, কাপড় গুছায় এই করতে করতে রাতের খাবার দেয়ার সময় হয়ে যায়। তারপর সবার খাওয়া হলে সব গুছিয়ে বিছানায় যেতে যেতে রাত বারোটা! পরের দিন আবার ফযরের আজানের সময় ......... এবং সে খুবই সুখি তার অনেক বড় ঘরে অনেক ভালো একটা বিয়ে হয়েছে। আমি খুব চেষ্টা করলাম তার খুশিতে খুশি হওয়ার, কিন্তু খুশিটা কেমন যেন গলার কাছে এসে কই মাছের কাঁটার মতো আটকে থাকলো! আমি দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছিলাম এক বা দুই বছর পরে মেয়েটার যখন একটা বা দুইটা বাচ্চা হবে, মেয়েটার প্রফেশনাল ক্যারিয়ারের ইতি হতে যাচ্ছে।
এই সমাজে মেয়েদের সম্মান বা স্টেটাস কিসে র্নিধারিত হয় বলেন তো? না, সৌন্দর্যে না, বড়লোক বাপও না, পড়াশোনা চাকরি বাকরিতো না ই। সমাজে মেয়েদের স্টেটাস র্নিধারণ হয় দুইটা ইন্ডিকেটর দিয়ে, বিয়ে হয়েছে কিনা আর বাচ্চা হয়েছে কিনা। এন্ড অফ দ্যা স্টোরি। কিছু যায় আসে না মেয়েটা কোন ব্যাংকের কত বড় ম্যানেজার, বিয়ে হয় নাই? হায় হায় সমাজে বেল নাই। কিছু যায় আসে না কত বড় সচিব, বাচ্চা নাই? হায় হায় বাজা মেয়ে মানুষ! মেয়েদের জীবনের কাহিনীর শুরু বিয়ে দিয়ে কাহিনীর শেষে বাচ্চা হওয়ার মধ্যে দিয়ে!
বিষয়টা কি এমন নারী মানে একটি যোনী এবং একটি গর্ভের কাহিনী? নারী প্রজাতিটির কি তবে মস্তিষ্ক নাই না মস্তিস্ক খাটানোর মুরোদ নাই? অবশ্যই সমাজ ঝাপিয়ে পড়ে বলবে তার মানে কি বলতে চাও মেয়েরা কি বিয়ে করবে না না বাচ্চা নিবে না? তুমি প্রকৃত বিরুদ্ধ কথা বলো কেনো? তুমি মাতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলছো? না আমি আসলেই প্রকৃতির বিরুদ্ধে কথা বলতে চাই না। আমি এমন অনেক মেয়ে কে চিনি মা হওয়ার জন্যই বিয়ে করে। এবং মাতৃত্বকে আকন্ঠ উপভোগ করে। কিন্তু এইটা জরুরি না সবাই মা হওয়ার জন্য উম্মুখ হয়ে থাকবে, মাতৃত্বকে সবাই একইভাবে উপভোগ করবে।
আমার এক সিনিয়র কলিগ ছিলেন, খুবই সুখি দ্ম্পতি কিন্তু বাচ্চা নেয় নি। আমি বোকার মতো তাকে প্রশ্ন করে বসলাম আপু বেবী নেন নি কেনো? উনি অসাধারন একটা উত্তর দিয়েছিলেন। উনি বললেন দেখ বাচ্চা নেয়া মানে একটা মানুষের সারা জীবনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়া। আমি আসলে একটা মানুষের সারা জীবনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য তৈরি না। আমাদের মা, খালা, শাশুড়ি বা এই সমাজ আসলে এই বিষয়টা বুঝি কিনা যে একটা সন্তান নেয়া মানে একটা মানুষের সারা জীবনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়া? কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের নারী যদি সিদ্ধান্ত নেন সে বিয়ে করবেন না বা বাচ্চা নেবেন না সেইটা সম্পূর্ণ্ তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার এবং এইটা নেচারালও। এইটার মধ্যে আননেচারালের কিছু নাই। কারণ সেই ব্যাক্তি নারীটির পারির্পাশিক অবস্থা তার মানুষিকতায় যে ছাপ ফেলেছে সেই খান থেকেই সে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সে মা হবে না। এইটা মা হতে না চাওয়া একজন মার সিদ্ধান্ত।
এইটাও প্রাকৃতিক। কারণ প্রকৃতি একজন নারীর মন এবং শরীর দুইটাকেই প্রস্তুত করে মা হওয়ার জন্য। অনেক মেয়েকে দেখবেন শারীরিক কোনো সমস্যা নাই তারপরও মা হতে পারে না। কারণ মানসিক প্রস্তুতিটা অসম্ভব জরুরি মা হওয়ার জন্য। যিনি একটা সন্তান কে জন্ম দেন নি তিনি কিন্তু কখনোই বুঝবেন না পোষ্ট মেটারনিটি স্ট্রেস কি জিনিষ! কাজেই কোনো মেয়ে যদি পুরো প্রক্রিয়াটিকে ভয় পান তার সম্পূর্ণ্ অধিকার আছে সেই ভয় পাওয়ার। বিয়ে করা বা বাচ্চা নেয়া সম্পূর্ণ্ একজন ব্যাক্তি নারীর সিদ্ধান্তের ব্যাপার। যোনী মালিকানা যার যোনী সম্ভগের সিদ্ধান্তও তার। গর্ভ্ যার গর্ভ্ ধারণের সিদ্ধান্তও শুধুমাত্র তার। এইখানে অন্য একজন মার কথা বলাও অনধিকার চর্চা, অসভ্যতা ।