২১ শে জানুয়ারী, ২০১৭ তে প্রথম আলো পড়ে জানতে পারলাম যে, ৯ম জুডিশিয়াল এ নিয়োগ প্রাপ্ত ৭৯ জন সহকারী জজের মধ্যে ৩৭ জন নারী। অভিনন্দন সবাইকে।
প্রথমেই বলতে চাই, এই রিপোর্টে বিশেষ ব্যাক্তিরা নারীরাদের অগ্রযাত্রা এবং জয়যাত্রার যে গান গেয়েছেন, তা নতুন কিছু না, একদমই গৎবাঁধা জিনিস! আবার নিয়োগ প্রাপ্ত নারীরা তাদের বিচার বিভাগে আশার পেছনে যে কারণ বলেছেন তাও সেই ছোট বেলার “মাই এইম ইন লাইফ” রচনার মত গদ!( দুঃখিত)
বাস্তবতা হলো নারীরা এই বিচার বিভাগে বিশেষ করে উচ্চ আদালতে এবং আইনজীবীদের অঙ্গনে এখনও অনেক পিছিয়ে! আমার এনালাইসিস বলে আগামী ২৫ বছরেও নারীরা এই অঙ্গনে পুরুষের সমকক্ষ দূরে থাক মোটামুটি কমপিটিশনে যেতে পারবেন না। বিসিএস বা জুডিশিয়ারী পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা অর্জন করা নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন কাজ এবং যোগ্যতার বিষয়, কিন্তু বাস্তব সত্য হলো আমাদের দেশে আইন পেশায় এসে টিকে থাকাটা তারচেয়ে কোনো ভাবেই সহজ বিষয় নয়, কারণ একজন আইনজীবীর প্রতিষ্ঠিত হতে অনেক বছর লেগে যায়।
যে কোনো বিষয়ের সাকসেস ধরা হয় অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে, তাই এই অঙ্গনে যে সকল মেয়েরা টিকে আছেন তাঁদের প্রত্যেককে নিজ পরিবারের কাছে প্রমাণ করতে হয়েছে যে, তাঁরা এখান থেকে অর্থ উপার্জন করে নিজেকে চালাতে সম্ভব। এই আইন পেশায় মেয়েদের অবস্থান এখনও অনেক পিছিয়ে। আমি নিজে কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে অনেক মেয়েকেই দেখেছি যে তাঁরা হারিয়ে গেছেন। খুবই কম সংখ্যক মেয়েকে দেখেছি আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার প্রথম পছন্দ।
সব বাদ দেই, কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই বেঁছে নেই, কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়েন, তাদের সবাইকে বিনা বাক্যে নাম্বার ওয়ান ছাত্রছাত্রী হিসেবে ধরে নেন। প্রতি ব্যাচে ১১০ জনের মত ছাত্র-ছাত্রী থাকনে, আর মাঝে যদি অর্ধেক ছাত্রী ধরি তবে, তাদের মাঝে কতজন আছেন এই আইন পেশায় আইনজীবী হিসেবে? যারা আছেন তাদের মাঝে খুব গুটি কয়েকজন আছেন যারা লেখাপড়া শেষ করার পর প্রথমেই এই পেশায় এসেছেন। আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে যারা পাশ করেছেন, তাদের মাঝে অনেকেই এখন মাত্র আসছেন এই পেশায়। অনেকটা যার নাই কোনো গতি, সে করে ওকালতি টাইপের! স্বাধীনতার পর থেকে আপীল বিভাগে নিয়োগ প্রাপ্ত নারী বিচারপতির সংখ্যা মাত্র একজন! আজ পর্যন্ত একজন নারী আইনজীবী কোনো আদালতের প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারী পদে দাঁড়ানো তো দূরে থাক নমিনেশন চাইবেন সে কল্পনা ও করতে পারেন নি! সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের মোট ৮৮ জন বিচারপতি গনের মাঝে মাত্র ৬ জন নারী বিচারপতি!
চাকুরী ক্ষেত্রে বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লিখাই থাকে যে “শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য”! এই হল অবস্থা। ভাগ্যিস প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আর ব্যাংক গুলো হয়েছে, তাই আইনে পড়া কিছু মেয়ের কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা হয়েছে, কারণে এখানে লিখা থাকে না যে “শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য”!
এবার আসি আমাদের কোর্ট অঙ্গনে। আমাদের বার এসোসিয়েশন ভবনের পুরাতন বিল্ডিং এবং নতুন বিল্ডিং মিলে মহিলা আইনজীবীগনদের জন্য দুটি কমন রুম, যেখানে বসার জায়গা সর্বসাকুল্যে ৭০-৮০ জন, লকার আছে ৩০-৪০ টি এবং বাথরুম বা ওয়াশ রুম মাত্র তিনটি! যে সকল নারী আইনজীবীগনকে নির্বাচিত করা হয় বা যারা আমাদের মহিলা সিনিয়ার আছেন ওনারা আজ পর্যন্ত কেনো বারের কাছে দাবী করেননি যে, দিন দিন মহিলাদের সংখ্যা বাড়বে তাই কমপক্ষে ৫০ জনের বসার মতো এবং ৩-৪ টা ওয়াশ রুমের ব্যাবস্থা করা হোক! নতুন ও পুরাতন কোর্ট বিল্ডিংয়ের কোথাও কোনো মহিলা ওয়াশরুম নেই, আমাদের মাঝে অনেক মহিলা আইনজীবী প্রেগন্যন্ট, এই অবস্থায় ওনাদের জন্য কোর্ট বিল্ডিংএ আলাদা একটি ওয়াশ রুম থাকা দরকার। আমাদের পুরুষ সহকর্মীগণ বিষয়টি বুঝবেন না, এটাই স্বাভাবিক, আমরা নারী আইনজীবীগন কেনো কোনো দিন এই বিষয়গুলো নোটিশ করিনি এবং দাবী করিনি।
আমার বিশ্বাস, আমরা এই বিষয়গুলো উপস্থাপন করলে অবশ্যই আমাদের প্রধান বিচারপতি, বারের নেতাগন এবং সিনিয়র আইনজীবীগন বিষয়টি আমলে নিবেন। আবার কমনরুমের দরজার বাইরে লিখা ‘বারের মেম্বার ছাড়া প্রবেশ নিষেধ”, তাহলে যে মেয়েটি এখনো মেম্বার হয়নি সে কোথায় বসে খাবে বা কোন ওয়াশ রুমে যাবে? জাটকা নিধনে ইলিশ মাছের একটা এ্যাড দেখেছিলাম “আইজকার জাটকা, কালকার ইলিশ”, ঠিক তেমনি আজকে যে মেয়েটি শিক্ষানবিশ আইনজীবী বা বারের মেম্বার নয়, কালকে সে আইনজীবী হয়ে আমার সাথে বসবে, তাহলে কেনো তার জন্য আমরা এই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করি! এই মেয়েগুলো কোথায় যাবে? আশা করি আমাদের সিনিয়ার মহিলা আইনজীবীগন এবং অন্যান্য নারী আইনজীবী নেতৃবৃন্দ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন এবং সুযোগ সুবিধার বিষয়গুলো বারের নেতাগনের সাথে আলোচনা করবেন, আমার বিশ্বাস আমাদের নেতারা আমাদের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সমাধান করবেন।