ভাইফোঁটা উৎসব হয়, বোনফোঁটা উৎসব হয় না কেনো?- এই প্রশ্নটা করেছিলাম ভাইদের, ভাইরা বলেছেন-আয়োজনটা যেন আমরাই করি।
বলেছেন-মেয়েরা ওটা শুরু করার দায়িত্ব ছেলেদের ঘাড়ে চাপিয়ে চুপ করে বসে আছে!
উত্তরে বললাম-বোনরা যখন ভাইকে বরণ করে তখন তো ভাইদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকে না, তেমনি আপনারাও আপনাদের আগ্রহে বোনদের বরণ করবেন। ভাই আমাকে জানালেন-ওই প্রথাটাও তো পুরুষনির্মিত। কথাটি ঠিক নয়। ভাইদের অবগতির জন্য মনে করিয়ে দিতে চাই এই উৎসব সৃষ্টির গোড়ার কথা।
ভাইফোঁটা উৎসবের পোষাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া উৎসব। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে কালীপুজার দুই দিন পরে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
কথিত আছে, এই দিন ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে মৃত্যুর দেবতা যমকে তাঁর বোন যমুনা কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন। তখন থেকে এই উৎসবের শুরু। এজন্য এই উৎসবের আরো একটি নাম হল যমদ্বিতীয়া।
অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তাঁর বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন ভাইয়ের জয়ে আনন্দিত সুভদ্রা তাঁর কপালে ফোঁটা দিয়ে তাঁকে মিষ্টি খেতে দেন। সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয়।
দেখা যাচ্ছে, অনেক আচারের মতো এই আচারটিও মেয়েদের তৈরি।
ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলেন-
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥
এইভাবে বোনেরা ভাইয়ের দীর্ঘজীবন কামনা করেন। তারপর ভাইকে মিষ্টি খাওয়ান। ভাইও বোনকে কিছু উপহার বা টাকা দেন বোনকে।
প্রসঙ্গটি ভিন্ন কারণে উত্থাপন করেছি। গুহাযুগে এবং এখনো অনেক আদিবাসীদের মধ্যে গোষ্ঠ্যপ্রধান হলো নারী। সিংহ, হাতি, নেকড়ে ইত্যাদি দলবদ্ধভাবে বাস করা পশুদের মধ্যে নারীই দলের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। বেদে, রামায়ণে, মহাভারতে দেখা যায়-নারীরা অস্ত্র ও শাস্ত্র শিক্ষায় সমান পারদর্শী। দেবী দুর্গা, কালী ছিলেন যোদ্ধা-অসুর নিধনকারী। পুরাণ মতে- তিন প্রধান দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু শিবের সৃষ্টি মহামায়া থেকে। পূজা পার্বণে নারীর গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। দুর্গাপূজার আড়ম্বর আয়োজন থেকে নারীর ক্ষমতার গুরুত্বকে অনুধাবন করা যায় অনেকখানি।
কিন্তু একসময় নারীর ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে। ক্রমশঃ নারী পুরুষের অধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। নারী পরিণত হয় পুরুষের ভোগ্য বস্তুতে। ক্ষমতা পেয়েই যুদ্ধ নীতির স্বাভাবিক নিয়মে পুরুষ কেড়ে নেয় নারীর শিক্ষাগ্রহণসহ সকল অধিকার। নারী হয়ে যায় অন্তপুরবাসিনী। তারপর পৃথিবীতে গড়িয়েছে অনেক জল।
আমরা যত সভ্য হচ্ছি, নারীর আর্থ সামাজিক মর্যাদা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত নারীরা বর্তমানে তাদের সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে সবখানে। কিন্তু পুরুষপ্রধান সমাজে কিছু বেপরোয়া পুরুষের নির্লজ্জ আচরণ আমাদের সমাজকে কলুষিত করছে। পোশাকে আধুনিক হলেও এরা মনে এখনো অশিক্ষিত, অমার্জিত, অসুন্দর। ফলে বোনরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। এমতাবস্থায় বোনফোঁটার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি সুতীব্রভাবে। ভাইরা কি বোনদের রক্ষার্থে এই উৎসবের আয়োজন করতে পারেন না?
এই সব অশিক্ষিত, অমার্জিত, অসুন্দর (চামড়ার সৌন্দর্য যেমনই হোক) পুরুষের কুদৃষ্টি এড়াতে নিজের এবং সকল বোনের কপালে আজ আমি ফোঁটা দিলাম। তোমরাও বোনফোঁটা দাও।