নাঈমাহ তানজিম

ভবিষ্যতে চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক নাঈমাহ তানজিম ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর শিক্ষার্থী। কিছুদিন স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন। লেখালেখি করেন বিবেকবোধের দায় থেকে।

দৈনন্দিন ইভটিজিং এবং আমাদের মাইন্ডসেট

রাস্তাঘাটে ইভটিজিং এর ঘটনায় ভিড় করে দাঁড়ায়ে মজা দেখলেও কেউ মেয়েটার হয়ে কথা বলে না কেনো জানেন? কারণ, আমরা মেয়েদেরকে জোরে কথা বলতে, প্রতিবাদ করতে দেখে অভ্যস্ত না। তাই যখন দেখি যে, একটা মেয়ে রেগে গিয়ে চিৎকার করছে, ব্যাপারটা আমাদের কাছে একদম নতুন লাগে। এইজন্যই এই ধরণের দৃশ্য মানুষ ভিড় করে, আগ্রহ নিয়ে দেখে, কিন্তু তার মাইন্ডসেট কিন্তু মেয়েটাকে সমর্থন করতে পারে না।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী, উনারা দুইজনেই মাইকে চিৎকার করে বক্তৃতা দেন। তাতে কী? আমাদের মায়েরা বাবাদের থেকে জোরে কথা বলেন না, মসজিদের মাইকে মহিলা কন্ঠ শুনি না, স্কুল-কলেজে ম্যাডামরা পড়ান ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য, বড়জোর জীববিজ্ঞান। ১০ বছরের পিচ্চি ছেলেও নোংরা ভাষায় গালি দেয় কিন্তু মেয়েদের মুখে গালি শুনলে ভুরু কুঁচকায়। মেয়েরা শুধু গায় রবীন্দ্রসংগীত, কথা বলে মিষ্টি গলায় আর চোখের পানি ফেলে। এইতো দেখে অভ্যস্ত?

কিন্তু অন্যায়টা যে মেয়েদের সাথে বেশি বৈ কম হয় না। যেকোনো কিছুর জন্য মেয়েদের বেশি সংগ্রাম করতে হয়। এই শহরে মেয়েদের জন্য পাবলিক টয়লেট পর্যন্ত নাই। তারা চুপ থাকবে কেনো? চুপ থাকবে কতক্ষণ?

আপনি নারী বা পুরুষ যাইই হন না কেনো, আপনার সাথে অন্যায় হলে যেমন আপনি প্রতিবাদ করবেন, একটা মেয়ের দিকে অস্বাভাবিক ভাবে তাকালে, তার উদ্দেশ্যে নোংরা কথা বললে, তার গায়ে ইচ্ছা করে ধাক্কা দিলে, সে চুপচাপ সইবে কেনো?

এইজন্যই মাঝে মাঝে দেখা যায়, খুব নিরীহমতন একটা মেয়ে মাঝরাস্তায় একটা লোককে চিৎকার করে বকা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের অভ্যস্ত চোখ এবং মাইন্ডসেট এই দৃশ্য দেখেও মানতে পারে না। চুপচাপ দাঁড়ায়ে মজা দেখলে বা ভিডিও করলেও আমরা নিজেরা সাহস করে এগিয়ে যেতে পারি না। মুখটা খুলতে হলে, পাশের পুরুষটার জন্যই খুলি, সেই লোকটাকেই বাঁচানোর চেষ্টা করি, উল্টা মেয়েটাকেই ধমকে দেই।

কী অদ্ভুত অপদার্থ আমরা! আমাদের এই শহরে একটা একা মেয়ের নিরাপত্তা নেই, এই সত্যটা মেনে নিতে পারি না, নিজেদের এই ব্যর্থতা ঢাকতে কত অদ্ভুত যুক্তি বানাই। কখনো মেয়ের কাপড়ের দোষ, কখনো একা বের হওয়ার দোষ, আবার কখনো বলে দেই 'কিছুই হয় নাই, আপনি ভুল বুঝেছেন, মিথ্যা বলছেন।'

কিন্তু আপনি আমি অস্বীকার করলেইতো আর সত্যি ঘটনা পাল্টায়ে যাবে না। আমাদের মেনে নিতে হবে যে, এই জায়গায় আমরা আসলেই ব্যর্থ, আসলেই একটা একা মেয়ের নিরাপত্তা নেই।

দয়া করে আগায়ে আসতে পারেন আর না পারেন, দাঁড়ায়ে তামাশা দেইখেন না, নিজের কাজে চলে যান।

একটা মজার ঘটনা বলে শেষ করি। আমার জীবনে আমি মাত্র একবার রাস্তায় উত্যক্ত হওয়ার সময় পাবলিক সাপোর্ট পেয়েছিলাম। আমি মিরপুর ১০ এর বাজারে দাঁড়ায়ে মরিচ আর লেবু কিনছিলাম, পাশ থেকে একজন আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছিলো। আমি উল্টা কথা বলতেই সে আরো তেড়ে আসলো। তারপর যা হয়, ভিড় জমে গেলো, কয়েকজন আমাকে বললো চলে যেতে। আমি যখন বললাম আমি কেনো যাবো? আমি কি গালাগালি করছি নাকি রাস্তায় দাঁড়ায়ে? তখন সবাই সেই উত্যক্তকারীকে একটু বকে দিলো। মজাটা খুঁজে পেলেন না? সেই উত্যক্তকারী ছিলো একজন মহিলা। তার নাকি মাথা খারাপ, সে বাজারে বসে এভাবে মেয়েদের গালাগালি করে।

আমার ধারণা, যেহেতু প্রচলিত মাইন্ডসেট মেয়েদেরকে বকেই অভ্যস্ত, তাই জনগণ সেদিন দু’জনকেই বুঝায়ে এবং বকে নিজেদের দায়িত্ব পালন করেছিলো। এখানে কে যে দোষী আর কে যে উত্যক্ত হলো তাতে আসলে কিছুই যায়-আসে না।

2035 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।