নারীবাদের সাথে নাস্তিক্যবাদ ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়া অনেক শিশুই গোলমাল পাকায়ে ফেলেন। সেই সব শিশুদের উদ্দেশ্যেই অত্যন্ত সহজ ভাষায় আজকের এই জ্ঞানদানমূলক পোস্ট।
জ্বি না, শিশুরা, নারীবাদের সাথে নাস্তিক্যবাদের সম্পর্ক নাই। নারীবাদের বিরোধ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাথে, ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাথে না।
নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্ম একে অপরের বিপ্রতীপ কোণে বাস করে। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম যেইভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে বইলা ঘোষনা দেয়, ঠিক একইভাবে নাস্তিক্যবাদ ঈশ্বরের অস্তিত্ব পুরাপুরি খারিজ কইরা দেয়। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদ এখনও, অর্থাৎ আজকের দিন পর্যন্ত কসমোলজি বা এভোলুশন থিওরি দিয়া ঈশ্বর নাই এই মর্মে প্রমাণ দেখাইতে পারে নাই। যেমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঈশ্বর আছেন এমন ইন্দ্রিয় নির্ভর প্রমাণ দেখাইতে পারলেও যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ দেখাইতে সক্ষম না। যেই কারণে নাস্তিক্যবাদও ধর্মের মতোই আরেকটা ধর্ম, যারা উভয়েই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়া যার যার জায়গায় নিঃসন্দেহ। আমি নিজের ব্যক্তিগত জীবনে নাস্তিক্যঘেঁষা অজ্ঞেয়বাদী। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে ধর্মীয় ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারেন। কিন্তু তার না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
অজ্ঞেয়বাদ বা সংশয়বাদ হইলো সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর আছে কী নাই এই নিয়া কোনো প্রকার জ্ঞানের দাবী না করা মতবাদ।
এখন দেখা যাক-
সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর আর ধর্মের ঈশ্বরের পার্থক্য কোথায়?
পৃথিবীতে মানুষের বসবাস প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছরের কাছাকাছি। বিবর্তনের শুরু থিকাই মানুষের নিজেরে রক্ষার স্বার্থে অজানারে ভয় কইরা আসতে হইছে। এই অজানার ভয় পরবর্তীতে ‘ঈশ্বর’ কনসেপ্টের জন্ম দিছে। অর্থাৎ মানুষ যারেই ভয় পাইছেন, তারেই ঈশ্বর বা শক্তি নামে চালাইছেন। সেই কারণে প্রাচীন মানুষ আগুনরে পূজা করছেন, বৃষ্টিরে পূজা করছেন, সূর্যরে পূজা করছেন।
পরবর্তীতে অর্থাৎ আজকে থিকা প্রায় ৪ হাজার বছর আগে যখন পৃথিবীতে রাজতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদ শুরু হইছে, তখন মানুষের এই ক্ষমতার রাজনীতি বজায় রাখতে কোনো একটা ঐশ্বরিক বাণীর প্রয়োজন পড়ছে। কী কারণে সাধারণ মানুষ অন্য একদল সাধারণ মানুষের হাতে সুরসুর কইরা এমনি এমনি ক্ষমতা তুইলা দিবেন এবং অন্যরে দিয়া নিজেরে নিয়ন্ত্রিত বা শোষিত হইতে দিবেন, বলেন? কিন্তু আমি যদি সাধারণ মানুষরে গিয়া বলি, ঈশ্বর আমারে আপনাদের রাজা হিসাবে পাঠাইছেন, বা আমারে মনোনীত কইরা পাঠাইছেন, তখন আপনি আপনার স্বাভাবিক ঈশ্বরবিশ্বাস থিকা আমারে রাজা হিসাবে মাইনা নিতে বাধ্য থাকবেন। এবং আপনি সারাবছর খাটাখাটনি কইরা যা চাষ কইরা ফসল ফলাবেন, তা নিজের জন্য না রাইখা রাজারে ট্যাক্স আকারে দিয়া দিতেও আপনার সমস্যা হবে না। কারণ এইটা ঈশ্বরের নির্দেশ বইলা আপনি মানতেছেন।
একটু সরলীকরণ হইলেও পৃথিবীর সকল প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সূত্রপাত এইভাবে। পৃথিবীর সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের শুরু ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। এই সকল ধর্মের এক সময় প্রয়োজন ছিলো, মানুষরে নৈতিকতা শিখাইতে এবং গোষ্ঠিবদ্ধ রাখতে এবং সমাজ সংস্কার করতে ধর্ম প্রবর্তকদের অবদান ছিলো সত্যি, কিন্তু এই প্রতিটা ধর্মের কিছু কিছু ফাঁক ছিলো। কোনো ধর্মই পুরাপুরিভাবে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। হয়তো সেই সাম্যবাদের কথা সেই সময়ের মানুষের মাথাতেও ছিলো না। এই কারণেই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষতান্ত্রিক এবং ধর্মগ্রন্থের ঈশ্বরও পুরুষতান্ত্রিক।
পৃথিবীতে এই মূহুর্তে প্রায় ৪ হাজারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আছে। কিন্তু ‘প্রধান’ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হিসাবে যদি সনাতন ধর্মরে সবচাইতে প্রাচীন এবং ইসলামরে সবচাইতে আধুনিক ধর্ম হিসাবে মাইনা নেই, তাইলে দেখা যাবে, ইসলাম ধর্ম তুলনামূলকভাবে সনাতন ধর্মের চাইতে আধুনিক, কম পুরুষতান্ত্রিক, কম কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং স্মার্ট।
কিন্তু তাই বইলা কি ইসলামে সমস্যা নাই? ইসলামে কি বলা হয় নাই মেয়েদের পুরুষের পাঁজরের হাড্ডি দিয়া বানানো (কুরান, আল আরাফ- ১৮৯; সহি বুখারি- ৫৫- ৫৪৮)? ইসলামে কি বলা হয় নাই স্বামী চাইলে স্ত্রীরে মারধোর করতে পারবেন (কুরান, আন নিসা- ৩৪; কুরান, আন আনফাল- ১২)? হ্যাঁ, ইসলামে মেয়েদের এবং স্ত্রীদের সম্মান করতে বলা হইছে সত্যি, তাদের বিভিন্ন অধিকার দেওয়া হইছে সত্যি, কিন্তু একজন স্বামীর ক্যানো একজন স্ত্রীরে পিটাইতে হবে? না, তার বিপরীতে আমি আমার স্বামীরে পিটানোর অধিকার চাইতেছি না, আমার কাছে কোনো মারামারিই গ্রহণযোগ্য না, তা সেইটা পুরুষই পিটাক মেয়েদের, আর মেয়েরাই পিটাক পুরুষরে। এবং এই সমস্ত আয়াতের কারণেই আমি বিশ্বাস করি অন্যান্য সকল ধর্মের মতো ইসলামের ঈশ্বরও পুরুষতান্ত্রিক এবং সেই কারণে পরিত্যাজ্য।
আলোচনার সুবিধার্থে আমি ধইরা নিলাম আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। আপনি বিশ্বাস করেন বিগব্যাং ফিগব্যাং সব হাস্যকর বৈজ্ঞানিক তথ্য, এবং আপনারে এবং আপনার আশেপাশের সবকিছুরে ঈশ্বর সৃষ্টি করছেন। আপনি বিশ্বাস করেন আপনি পরীক্ষার আগের রাতে ঈশ্বররে ডাকলে উনি আপনার কথা শুনতে পান এবং আপনারে পরীক্ষায় পাশ করায়ে দেন। আপনার এই ঈশ্বরবিশ্বাসে সমস্যা নাই। এই ঈশ্বররে আমি ‘প্লাসিবো ইফেক্ট’ বা আপনার নিজের অবচেতন মন না বইলা সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর বলতে চাই। এই ঈশ্বররে আপনি যেই নামেই ডাকেন না ক্যানো তিনি আপনার প্রার্থনায় সাড়া দিবেন। আপনি হিন্দু হইলেও সাড়া দিবেন, আপনি বৌদ্ধ হইলেও সাড়া দিবেন। আপনি নামাজ পইড়া ডাকলেও সাড়া দিবেন, আপনি আগুন অথবা পাথর অথবা প্রকৃতি পূজা কইরা ডাকলেও সাড়া দিবেন। আমার কথা বিশ্বাস না হইলে নিজেরে একটা প্রশ্ন করেন।
মাত্রই বললাম পৃথিবীতে প্রায় ৪০০০ ধর্মের অস্তিত্ব আছে। এবং সবাই ভাবেন তার ধর্মই সঠিক, বাকিদেরটা ভুল। নিজেরে জিগান, উনারা ক্যানো এমন ভাবেন? উনারা কি বাকি ৩৯৯৯টা ধর্মের বই পইড়া আবিষ্কার করছেন বাকিগুলি সব মিথ্যা কথা লিখছে? আমি উত্তর দেই, ক্যানো উনারা নিজের ধর্মরে এবং নিজের ধর্মের ঈশ্বররে সঠিক বইলা ভাবেন। আপনি সহ অন্যান্য সকল ধর্মের সকল ধার্মিক নিজের ধর্মরে সঠিক বইলা ভাবেন কারণ আপনিসহ পৃথিবীর সকল ধর্মের ধার্মিকরা আপনাদের যার যার ধর্মের নিয়ম ফলো কইরা অর্থাৎ নামাজ পইড়া বা সরস্বতীরে পূজা কইরা যখন পরীক্ষার আগের রাতে ঈশ্বররে ডাকছেন, তখন তিনি আপনাদের দুইজনের ডাকেই একই ভাবে সাড়া দিছেন। এবং এই কারণেই একজন হিন্দু ভাবেন তার ধর্ম সঠিক এবং একজন মুসলিম ভাবেন তার ধর্মই সঠিক। যদি ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম হইতো তাইলে হিন্দুদের পূজায় কাজ হওয়ার কথা ছিলো না এবং এত এত পূজা কইরা কাজ না হওয়ার কারণে পৃথিবীর তাবত হিন্দুরা পরীক্ষা ফেইলের পরদিনই গণহারে মসজিদে গিয়া ইসলাম গ্রহণ করতেন।
এখন ভাবেন, সকল ধার্মিকদের প্রার্থনায় যার যার ঈশ্বর সাড়া দেন ক্যানো? একটা উত্তর হইতে পারে, পৃথিবীতে প্রচুর ঈশ্বর আছেন এবং উনারা নিজ নিজ অনুসারীদের প্রার্থনা মঞ্জুর কইরা থাকেন। দ্বিতীয় উত্তর হইতে পারে, পৃথিবীতে শুধু একজন ঈশ্বরই আছেন, কিন্তু তিনি প্রচলিত কোনো ধর্মের ঈশ্বরই না। তিনি একজন সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর। তিনি সবাইরেই সমানভাবে ভালোবাসেন এবং তার সৃষ্টি করা মানুষের মধ্যে যেই উনারে যেই নামে বা যেই পদ্ধতিতে ডাইকা থাকেন, উনি তাতে সাড়া দেন। তৃতীয় উত্তর হইতে পারে, কেউই আসলে আপনার প্রার্থনায় সাড়া দেন নাই, আপনি নিজের অবচেতন মনরে অটো-সাজেশান দিছেন এবং নিজের যোগ্যতাতেই পরীক্ষা পাশ করছেন।
এখন দেখা যাক প্রথম উত্তরের সমস্যা কী। প্রথমতঃ পৃথিবী খুব ছোট জায়গা। এই ছোট জায়গায় মাত্র ৭ বিলিয়ন মানুষ তৈরি করতে এতগুলি ঈশ্বরের দরকার ক্যানো? আর উনারা ধর্ম দিয়া মানুষ আলাদাই বা করেন কীভাবে? এবং যারা জন্মের সময় এক ধর্ম নিয়া জন্মাইছেন ও পরবর্তীতে ধর্ম পাল্টাইছেন, তাদের নিয়া ঈশ্বররা কী করবেন? ঐ মানুষের কি দুইজন কইরা ঈশ্বর থাকবেন? আমার মতো মানুষ যারা ধর্ম বিশ্বাস করেন না, তাদের ঈশ্বরই বা কে? এইক্ষেত্রে ঈশ্বররে যেহেতু ঈশ্বরের মতো না মনে হইয়া আমার হুকুম পালনকারী সেক্রেটারির মতো লাগে, তাই একাধিক ঈশ্বরের হাস্যকর কনসেপ্ট বাদ দেওয়া যাইতে পারে। তাইলে সঠিক উত্তর হইতে পারে দুই বা তিন নাম্বার কনসেপ্ট।
এখন যদি দুই নাম্বার উত্তররে সাময়িকভাবে সঠিক বইলা ধইরা নেই তাইলে দেখা যাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে, কিন্তু তিনি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের ঈশ্বর না। সেইক্ষেত্রে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলি মিথ্যা হইয়া যায়। অর্থাৎ ঈশ্বর থাকলেও থাকতে পারেন, কিন্তু ধর্মগ্রন্থগুলি আসলে ঈশ্বরের প্রেরিত কোনো বই না। বরং ঐ ধর্মের প্রবর্তকের নিজের লেখা বই। ধর্মের প্রবতর্করা মিথ্যাবাদী নিশ্চয়ই না, তারা নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ অনুভব করছেন এবং নিজ বুদ্ধি, জ্ঞানে ও প্রজ্ঞায় যা সত্য বইলা ভাবছেন, তাই লিখা গেছেন। কিন্তু তাদের ভাবনার বাইরেও আরো অনেক কিছু থাকতে পারে, তা তারা খেয়াল করেন নাই।
এখন দেখা যাক, নারীবাদ কী।
নারীবাদ হইতেছে নারী পুরুষের সমতার অধিকার। কেউ কারো চাইতে বড় না, কেউ কারো চাইতে ছোট না এই মর্মে এই দুই লিঙ্গের মানুষের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমান অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নাম নারীবাদ।
যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলির কোনোটাই নারীরে পুরুষের সমান মর্যাদা দেয় নাই এবং নারীরে বিভিন্নভাবে অবদমন কইরা রাখতে চাইছে, তাই নারীবাদ প্রচলিত ধর্মগ্রন্থগুলির বিরোধিতা করে। তার অর্থ এই না যে নারীবাদ নাস্তিক্যবাদের চর্চা করে। আস্তিক অর্থাৎ ঈশ্বরে বিশ্বাস কইরাও যে কেউ নারীবাদী হইতে পারেন। এমনকি নিজ নিজ ঘরে নামাজ পইড়াও ও পূজা কইরাও নারীবাদী হইতে পারবেন।
কিন্তু হিজাব পইরা বা কপালে সিঁদুর লাগায়ে নিজেরে নারীবাদী বলা সম্ভব না। গায়ের জোরে হয়তো বলা সম্ভব, কিন্তু লোকে আপনারে সেই ক্ষেত্রে ইদার হিপোক্রিট ধার্মিক অথবা হিপোক্রিট নারীবাদী বলবেন। আপনি যদি তার উত্তরে বলেন, আপনার ঈশ্বরে হিজাব বা সিঁদুর পরতে কইছেন, আপনি বিনাবাক্যব্যয়ে তা পরছেন কিন্তু এইসাথে আপনি নারী পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করেন, তাইলে জিনিসটা কাঁঠালের আমসত্ত্ব মার্কা ব্যাপার হবে।
ডিয়ার শিশুরা, আজকের ক্লাসের এইখানেই সমাপ্তি। আশা করি নারীবাদের সাথে নাস্তিক্যবাদ ও অজ্ঞেয়বাদ ও ধর্মের সম্পর্ক বুঝাইতে পারছি। আগামী ক্লাসে আসার আগে আপনাদের জন্য হোমওয়ার্ক থাকলো, ‘নামাজ পড়লে নারীবাদী হইতে পারবো, কিন্তু হিজাব পরলে নারীবাদী হইতে পারবো না ক্যানো?’ এই প্রশ্নের উপর ২০০ শব্দের রচনা। ওকে?
আজকের মত বিদায়। আবার দেখা হবে। সবাই ভালো থাকবেন।
বিনীত
নাদিয়া ‘নারীবাদ অ-আ-ক-খ মাস্টার’ ইসলাম।