সাদিয়া নাসরিন

লেখক ও এক্টিভিস্ট

মাই লাইফ ইজ সেলফ ড্রিভেন

গাড়ি চালাতে খুব ভালোবাসি আমি। যখনই গাড়ীর স্টিয়ারিং এ বসি, যতোই মন খারাপ থাকুক না কেনো, আমার মন ভালো হয়ে যায়। আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে, গাড়ির মতো, আমার জীবনের স্টিয়ারিং ও আমারই হাতে। আমি কখন রাইট টার্ন নিবো, কখন ইউ টার্ন করবো ...কখন হাইওয়ের গতি রাখবো, কখন সাবওয়ের...এই সিদ্ধান্ত একান্তই আমার। গাড়ির মতো জীবনের ও লাল-হলুদ-সবুজ বাতি আছে, সেগুলো মেনে চলতে হয় বৈকি! মাঝে মাঝে রাফ ড্রাইভ করি, আবার কখনো রং-পার্কিং করে পেনাল্টি দেই। জীবন ও নিয়ন্ত্রণ হারায় কখোনো কখনো, জীবনের ও পেনাল্টি দিতে হয়।

সেলফ ড্রাইভিং এর ঝক্কি আছে। জীবন ও নিজে ড্রাইভ করতে গেলে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। সেইফ পার্কিং, চাকা পাংচার, ফুয়েল লাইন এ দাঁড়ানো, পরিষ্কার করা... আমি সাচ্ছ্যন্দে সেসব ঝক্কি সামলাই। গাড়ি আর জীবনের ধুলো একসাথে পরিষ্কার করি, মেইন্টেইন করি। ওয়ার্কশপ এ মেকানিকদের সাথে রাতভর গাড়ির সার্ভিসিং এ থাকতে যেমন আমার অস্বস্তি হয়না, চাকা পাংচার হলে রাস্তায় বসে চাকা পাল্টাতেও আমার বিন্দু মাত্র দ্বিধা সঙ্কোচ হয় না। গাড়ির স্টিয়ারিং এ আমার হাতের কোমলতা নষ্ট হয়ে যায়, আঙ্গুলে কড়া পড়ে, সীটবেল্ট এ ঘষা লেগে ঘাড়ে দাগ বসে যায়। জীবন ও নিজে চালাতে গেলে কমনীয়তা হারায়, লাবন্য কমে, রুক্ষতাকে আলিঙ্গন করতে হয়। তবু সেই রুক্ষতার সৌন্দর্য, সেই বিউটি বোন এর দাগ বড়ো সুন্দর লাগে আমার।

একবার আমার গাড়ি ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলো। আমার পক্ষে একা সম্ভব ছিলো না গাড়ি টেনে তোলা, একা কোনো পুরুষের পক্ষে ও না। আমি অফিসে খবর দিবো, এমন সময় বেশ কিছু নারী-পুরুষ এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে। হ্যাঁ নারী ও ছিলেন দু’জন। কিন্তু তিনজন পুরুষ মিলে গাড়ি তুলে দিলেন, নারীদের হাত লাগাতে দেন নি। কারো বিপদে সহযোগীতা করতে আসেন যারা তাঁদের আমি মানুষ বলেই জানি। জীবন ও একবার খাদে পড়েছিলো। সেখান থেকে আমাকে হাত বাড়িয়ে টেনে তুলেছিলেন আর একজন মানুষ। সে হাত এখনো সে ধরেই আছে, এক দিনের জন্য ও ছাড়ে নি। যতোই রাফ ড্রাইভ করি না কেনো, সে আমার সহযাত্রী হয়েই আমার জীবনের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখে।

গাড়ির পাশের সীটে বসে সে মাঝে মাঝে পরামর্শ দেয়, জীবনে ও দেয়। তার সাথে আমার সম্পর্কটা অটো গিয়ারের মতো ব্যালেন্সড। আমি যেহেতু নিজের জীবন নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পছন্দ করি, তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করার অধিকারকে ও সম্মান করি। সে যেমন আমার মানিব্যাগ নিয়ন্ত্রন করে না, আমি ও তার মানিব্যাগ এ উঁকি ঝুঁকি দিই না। সংসারের খরচ আমরা যার যার সামর্থ অনুযায়ী ভাগ করে করি, দু’জন মিলেই বাচ্চা সামলাই, ঘরের কাজ ভাগ করে করি দুজনের সময় অনুযায়ী। সমতার যে সৌন্দর্য আছে, তা উপভোগ করি দু’জন এক উচ্চতায় বসেই। ঝড় উঠলে দু’জনেই সামলাই, আপোস-সমঝোতা দু’জন মিলেই করি, ঠিক গাড়ির ব্যালেন্সিং এর মতো। তাই সম্পর্কের এলাইনমেন্ট ও স্ট্রেইট থাকে, ডানে বা বামে কাটে না।

গাড়ির রাস্তা সবসময় মসৃণ থাকে না। রাস্তায় চোরাকাঁটায় বিঁধে চাকায় স্লো পাংচার হয়। আধ-কাটা, খানা-খন্দ, আর ভাঙ্গা রাস্তায় নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারলে সাস্পেন্সর ডাউন হয়ে যাবার ভয় থাকে। জীবনের রাস্তা ও ঠিক তেমনি। বিশেষ করে সমতার লড়াই হয় যে জীবনে সে পথ বড়ো বন্ধুর। কোথাও সমতল, কোথাও খানা খন্দ, চোরকাটা।

গাড়ি চালাতে দেখলে যেমন রাস্তায় বাজে লোকেরা সিটি মারে, জীবন চালাতে দেখলে ও অনেকে বাজে কথা বলে। দজ্জাল, মদ্দা, ডমিনেটিং, সংসারী না...স্বামি-সন্তান-সংসার রেখে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ায় শুধু টাকার জন্য.....কিন্তু থেমে যাই নি তো!! শত্রুর মুখে ছাই ঢেলে ঘাড়ের রগ সোজা করে বুক টান করে শহর চষে বেড়িয়েছি আমার এই চারটা চাকা আর দুটো হাঁটুর জোরেই। আমি জানি আমার লড়াই সমতার জন্য, সাম্যের জন্য। মদ্দা না হলে, ননীর পুতুল হয়ে এ লড়াই করা যায় না। জীবনে স্বনির্ভর হয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাইলে দজ্জাল হতে হয়।

স্বাধীনতার মানে কি আমি জানি। তাই সংসারে থাকি বা না থাকি, একা থাকি বা দোকা, আমার স্বাতন্ত্র, আমার স্বাধীনতা, আমার সক্ষমতা আমি কখনো হাতছাড়া করি না। যে শক্তি আমার আছে তা ব্যবহার না করে তুচ্ছ কারণে একজন পুরুষের শক্তির উপর নির্ভর করে তার চাপ বাড়ানোর পক্ষপাতি নই আমি। তাই ঘরের ড্রিল, ছোট খাট কার্পেইন্টিং এর মতো আপাত তুচ্ছ কাজ পুরুষদের জন্য রেখে না দিয়ে আমি অনায়াসেই করে ফেলি। চব্বিশ ঘন্টা মনে রাখি, আমি মানসিকভাবে সবল, অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর এবং শারীরিকভাবে সক্ষম একজন স্বাধীন মানুষ। আলো হোক, কালো হোক, এ জীবন আমারই। এর চালক আমি।

ইয়েস, দ্যাট ইস মাই লাইফ, হুইচ ইস সেলফ ড্রিভেন!

2854 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।