বিয়ে কথাটির মধ্যে সানাইয়ের শব্দ, সেজে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যাবার, আর ছেলের নতুন বৌ ঘরে তোলার একটা আনন্দঘন পরিবেশকে বোঝায়। নারী –পুরুষকে একসাথে বসবাস আর সন্তান জন্মদান করে ভবিষ্যত প্রজন্ম সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবার গঠনের অনুমতি দেয় বিয়ে। কিন্ত বিয়ে নারীর অধিকার আনে কতখানি? বাল্যবিবাহ বিরোধ আইন ২০১৭ এর পরেই বা কি হবে নারীর বিবাহোত্তর অধিকার? এ আইনে ‘বিশেষ ক্ষেত্র’ আর সর্বোত্তম স্বার্থে শব্দ দুটো যোগ করে বলা হয়েছে অপরিনত বয়েসে বিয়ে দেয়া যাবে। তবে সে বয়স কত তা উল্লেখ নাই। অর্থাৎ বিয়ের বয়স শূন্য! আইনের এই দূর্বলতাকে অপব্যবহার করা হবেই। নারীর নির্যাতন, ধর্ষন প্রবনতা বাড়বে, ধর্ষককে বিয়ে করার ব্যাপারে অভিভাবকের ওপর চাপ বাড়বে, বাল্যবিবাহ নিয়ে যে প্রচার প্রচারনা তার সাথে এ আইন বিরোধী ভূমিকা পালন করবে।
দেশের আইন আর নিজের ধর্ম যে অধিকার দিয়েছে তা পরিপূর্নভাবে জেনে সেটি উপযুক্তভাবে সে পাচ্ছে কিনা জানতে হবে নারীদের, হতে হবে অধিকার সচেতন। আবেগ দিয়ে নয় যুক্তি দিয়ে সব কিছু চিন্তা করতে হবে। কোনো ভাবে সে বঞ্চিত হচ্ছে কি না তা তাকেই জানতে হবে। এখনো অনেক মেয়েই বিয়ের আগে জানেন না বিয়ে আসলে কি। এর সাথে তার কি অধিকার আর কর্তব্য জড়িত। অধিকাংশ মেয়েরাই বিয়ের আগে সেজেগুজে, গয়না পরে, স্টেজে ছবি তোলা, আর সমস্ত বিয়ে বাড়ির মধ্যমনি হয়ে ওই রোমাঞ্চিত সময়টুকুই নিয়ে মোহগ্রস্ত থাকেন। কিছুদিন সংসার করার পর দায়িত্ব ঘাড়ে আসতে থাকে আর বাস্তবতার সামনে সে হাঁপিয়ে ওঠে। তার মধ্যে বিয়ে যদি একা একা হয় সে আরও একাকিত্ব অনুভব করে আর এক বিশাল সমুদ্রসম বিষাদের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। কখনোবা সামাজিতকতার তড়িঘড়িতে বিয়ের অধিকার সংক্রান্ত মূল বিষয়গুলো নিয়ে অভিভাবকেরাও সচেতন থাকেন না। যার ফলে নারীর অধিকার দেশের আইন বা ধর্ম দিলেও তা নিজের ক্ষেত্রে কাজে আসে না। নারীকে তাই অধিকার সচেতন হতে হবে।
বিয়ের বৈধতা ও ফলাফল:
নারী শিশুর বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্কের কারনে বা ধর্ষিত হয়ে সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়া এবং অভিভাবকহীন অবস্থায় নিরাপত্তার জন্যই মূলত অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের বিয়ে হতে পারে। যা ‘বিশেষ ক্ষেত্র’ আর সর্বোত্তম স্বার্থে শব্দ দু’টো যোগ করে সংসদে পাশ হয়েছে।
২০১৪ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর, প্রথম আলোর সূত্রমতে, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪ নামে আইনের খসড়া তৈরি করেছে। যাতে উল্লেখ করা হয় –‘যুক্তিসঙ্গত কারনে মা-বাবা বা আদালতের সম্মতিতে ১৬ বছর বয়সে কোনো নারী বিয়ে করলে সেই ক্ষেত্রে তিনি অপরিনত বয়স্ক বলে গন্য হবেন না।’ ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ তে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুশাসন দিয়েছেন যে -বিয়ের বয়স ১৮ তবে পিতামাতা বা আদালতের সম্মতিতে ১৬ বছর সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে। সামাজিক সমস্যা কম হবে। অর্থাৎ বিশেষ ক্ষেত্রে কেউ অন্তসত্তা হয়ে গেলে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে ১৬ বছর বয়সকে বিবেচনায় আনা হয়েছে। সে প্রতিবেদনে শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির বলেন -প্রতিবন্ধী নারীসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হবে। ‘মহিলা সমিতি, নারী আন্দেলন, শিশু বিশেষজ্ঞদের নানান সমালোচনা আর পরামর্শকে উপেক্ষা করে অবশেষে জাতীয় সংসদে বাল্যবিবাহ ২০১৭ পাশ হয় যেখানে বলা হয়েছে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ ই থাকছে আর ছেলেদের ২১ তবে ‘বিশেষ ক্ষেত্র’ আর সর্বোত্তম স্বার্থে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে মেয়েদের বিয়ে হতে পারে। (১৫ মার্চ,২০১৭, ডেইলি স্টার)
নারী-পুরুষের মধ্যকার জন্মগত জৈবিক আকর্ষণ থেকে প্রেম –ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। নারী যেহেতু একটু বেশীই আবেগপ্রবণ। প্রেমের জোয়ারে বা ভালোবাসার মোহে কত কি ত্যাগ করে বসেন। আজকের সময়ে দেখা যাচ্ছে বিয়ের পূর্বেই সম্পর্কের গভীরতা অনেকখানি বেড়ে যায়। বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের বিধি নিষেধও কেউ আর আজকাল তেমন গুরুত্ব দিতেই চায় না। কিছুদিন পর নারী-পুরুষের আবেগীয় জায়গাটিও যে কোনো সময় নড়ে যেতে পারে। মানে ভালোবাসা কিছুদিন পর আর ভালো লাগলো না কিন্ত ততদিনে যে সন্তান তাদের মাধ্যমে পৃথিবীতে জায়গা করে নিলো তাকে সভ্যভাবে জীবন যাপনের জন্য ধর্ম এবং দেশের আইন বিয়েকে “স্যোশাল কন্ট্রাক্” বলে। অর্থাৎ ছেলে মেয়ের সম্পর্ক দুটো সেলফি তোলা, কফিশপে কাছাকাছি অন্তরঙ্গ মুহূর্তের মতন ছেলেখেলা নয়। মূলত নারী-পুরুষের আবেগীয় এ অনুভূতিকে একটা যুক্তিসংগত জায়গায় দাঁড় করানো। একটি আইনি সুবিধা দিয়ে স্পষ্ট বলা হচ্ছে মানুষ হয়ে সে পশুর মতন যেখানে সেখানে বেনামে সন্তান জন্ম দিতে পারবে না। ভুল পথে পা বাড়ানো ছেলেমেয়েদের এমনি সামাজিক শৃংখলার মধ্যে আনতে সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছেন হয়তো। কিন্ত এ সহজ সরল ভাবে মানিয়ে নেয়ার বিষয়টি কিছু লোক সদ্বব্যবহার করবেন না।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের খুব কমন চিত্র কমবয়সী, অল্প শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ, ইভটিজ, ধর্ষন, এসিড নিক্ষেপ, বাড়িতে এসে সন্ত্রাসীসহ হুমকি এবং অবশেষে অসহায় মেয়ের আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়া। প্রতিদিনের পত্র পত্রিকায় এ ধরনের কোনো খবর চোখে পড়বেই। কিংবা অভিভাবক জোর করে মেয়েকে বিয়ে দিতে গেছে মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছে এমনটিও কি কম হচ্ছে আজকাল? তাহলে কত নির্মম বিষয় ওই অসহায় মেয়ের পাশে তার বাবা মা কেও সে কখনো পায় না। দেশের আইনও থাকল না। কত মেয়ে যারা মেধাবী, পড়াশোনা করতে চায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় তাদেরও ভূগতে হচ্ছে, সংগ্রাম করতে হচ্ছে। বিশ্ব যখন এগিয়ে গেছে আমরা তখন পিছনে হাঁটছি।
কতিপয় ভূল করে অন্তসত্তা হয়ে পড়া মেয়ের জন্য আইন করে অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিয়েকে আইনি সমর্থন দেয়ায় আইনি ফাঁক না রেখে মেয়েরা বিপথ ও বিপদগ্রস্থ হলে তার পাশে থেকে সাহায্য করা দরকার ছিলো, প্রয়োজন বিয়ে, যৌনতা, আইনী অধিকার নিয়ে জানানো, মেয়েদের আরো স্বাবলম্বী করানোর, সচেতন কারনোর প্রয়োজন ছিলো। আগের সকল বাল্যবিবাহ নিরোধমূলক কর্মসূচিতে পানি ঢেলে সেখানে রাষ্ট্রের সাংঘর্ষিকতাপূর্ন আইন নারীর সামনে চলার পথ বাধাগ্রস্থ করলো। তবে আইন যেহেতু পাশ হয়েই গেছে অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিয়ে যেন সত্যিই আদালতের সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে হয়, এবং তা যেন কঠোর হয় সেটিই এখন গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। ‘বিশেষ ক্ষেত্র’ আর সর্বোত্তম স্বার্থে শব্দ দু’টো যোগ করে বলা হয়েছে সেক্ষেত্রে আদালত সম্মতি প্রদান করবে। এক্ষেত্রে, বিধানের ৩ নং ধারায় বলা হয়েছে আদালত প্রয়োজন বোধে বিষয়টির সত্যতা নিরুপনের জন্য উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার বা অন্য কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে তদন্ত সম্পন্ন করতে পারবে। কোন অবিভাবক যেন ইমারজেন্সী কেস ছাড়া এমন কোনো বিয়ে দিতে না পারেন।
আইনও ধর্ম নারী-পুরুষের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর অধিকারবোধ ও কর্তব্য, জন্ম হওয়া সন্তানের বৈধতা, সন্তান এবং স্বামী বা স্ত্রীর সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার এবং স্ত্রীর ভরনপোষন ও দেনমোহর পাবার অধিকারসহ আরও নানারকমের সুবিধা দেয় বিয়ের মাধ্যমে।
মুসলিম আইনে সুন্নী অনুসারীদের জন্য বিয়ে ৩ রকমের:
১.সহিহ্/আইনসিদ্ধ
২.ফাসিদ/অনিয়মিত
৩.বাতিল/অসিদ্ধ।
আর শীয়া অনুসারীদের বিয়ে ২ রকম:
১.স্থায়ী/সহিহ্
২. অস্থায়ী/মুতা ।
একজন রেজিস্টার্ড কাজীর সামনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এক বৈঠকে দুইজন স্বক্ষীর সামনে নিষিদ্ধ সম্পর্ক পরিহার করে সুস্থ মস্তিষ্কের সাবালক পুরুষ নারীকে নির্দিষ্ট অংকের মোহরানার বিনিময়ে প্রস্তাব দেবেন যা নারী কবুল বা সম্মতি হবেন তাই বৈধ বিয়ে। বিয়ের সকল সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন বৈধ বিয়ের পাত্র-পাত্রীগন।
বৈধ বিয়ের কোনো শর্ত কম থাকলে তা অনিয়মিত বিয়ে। যতক্ষন না সে ত্রুটি সংশোধন করা হয় ততক্ষন তা অনিয়মিত থাকে। আদৌ সংশোধন না হলে তা অবৈধ। তাছাড়া, কোনো পুরুষ তার স্ত্রীর জীবদ্দশায় স্ত্রীর বোনকে বিয়ে করলে, চার স্ত্রীর বর্তমান থাকায় পুনরায় বিয়ে করলে, বিয়ের সময় নারীর ইদ্দতকালীন সময় পার হয়নি, কোনো বিধর্মী নারী কে বিয়ে করলে কিংবা কোনো স্বাক্ষী ছাড়া বিয়ে করলে সে বিয়ে অনিয়মিত বিয়ে। এধরনের বিয়েতে সহবাসের আগে বিয়ে বলেই গন্য হয় না। বিধবা বা তালাকপ্রাপ্ত নারীরা তিন মাসের ইদ্দত পালনে বাধ্য থাকেন, এ বিয়ের ক্ষেত্রে নারী মোহরানা দাবী করতে পারেন কিন্ত স্বামী স্ত্রী পরস্পরের সম্পত্তির অধিকারী হবেন না। তবে বিয়ের সন্তান বৈধ এবং সন্তান পিতামাতার সম্পত্তির অধিকারী হবে।
এখানে একটা বিষয় মনে করানো ভালে যে অবশ্যই ২য় বিয়ের বেলায় অবশ্যই ১ম স্ত্রীর অনুমতি লাগবে। আর যৌক্তিক কারণ ছাড়া একাধিক বিয়ের অনুমতি নাই। কোনো নারীর বেলায় এরূপ হলে তিনি অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তাই বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের মধুরতম সময় নিয়ে ডুবে থাকার পরের অধ্যায়টি আগে ভাগে জেনে থাকলে অনেক খারাপ সময় গুলো এড়িয়ে চলা সম্ভব।
মুসলিম আইনে যে কতজন নারীর সাথে বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে (মা, দুধ মা, স্ত্রীর মা, খালা, ফুপু, চাচী, মামী, বা তাদের মা, নিজের, স্ত্রীর বা ভাই বোনের, বা সৎ ভাই বোনের মেয়ে, পুত্রবধু, পিতার স্ত্রী এবং এ জাতীয়) তা লংঘন করে বিয়ে করলে সে বিয়ে অবৈধ বলে গন্য হবে। অবৈধ বিয়ে বিয়ে বলেই গন্য হবে না, সন্তান জন্ম নিলে তা জারজ হবে, স্বামী-স্ত্রীর কারোরই কারো ওপর কোনো দায়িত্ব সুষ্টি হয়না, সন্তানেরা সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার পায় না, তবে মায়ের সম্পত্তিতে সন্তানের অধিকার হয়। সুতরাং যারা এসকল সুবিধা বঞ্চিত হয়েও এমন সম্পর্কে জড়ানোর সম্ভাবনা আছে তারা ফলাফল জানলে হয়তো সতর্ক হতে পারবেন।
১৮ বছরের নিচে বিয়ে তাহলে অনিয়মিত বিয়ে হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এতে স্বামী স্ত্রী পরস্পরের সম্পত্তির অধিকারী হবেন না। তবে বিয়ের সন্তান বৈধ এবং সন্তান পিতামাতার সম্পত্তির অধিকারী হবে। আর ১৮ বছর পূর্ন হবার আগেই তালাকের প্রশ্ন উঠলে দেনমোহর সুবিধা হতে বঞ্চিত হবেন। এহেন পরিস্থিতিতে নারী নিজে বা তার অভিভাবক তার কন্যাশিশূকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলবেন না নিশ্চয়। সামাজিক মান সম্মানের কথা ভেবে কন্যাকে ঘাড়ের বোঝা বিবেচনা করে বিয়ে দিয়ে মুক্তি কি আসলেই হয়? তার চেয়ে মেয়ে যেন ভবিষ্যতে তার সন্তানসহ পরিবারের বোঝা না হয় তাই বিয়ের আগেই তার বিয়ে বিষয়ক অধিকার সম্পর্কে অভিভাবকদের মধ্যে পরিষ্কার আলোচনা দরকার।
তাছাড়া, আদালত সম্মতি নিতে সত্যতা নিরুপনের প্রমান স্বরূপ উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার প্রত্যয়নপত্রের কপি এবং ওই বিয়ের কনে সত্যিই গর্ভধারন করেছেন কিনা সে মর্মে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্র বিষয়ে অভিভাবক সতর্ক হবেন।