ইমতিয়াজ মাহমুদ

এডভোকেট, মানবাধিকারকর্মী

শিক্ষার মুলা-লাঠি পদ্ধতি চলবে না

(১)

কিশোর তরুণদেরকে তো বুড়ারা ভয় পায়, জমের মতো ভয় পায়। কিন্তু বুড়াগুলি কিনা আবার মহা বদমাশ, ওরা সেই ভয়টাকে লুকিয়ে রাখে ভয়টা লুকিয়ে নানারকম কায়দা তৈরি করে যেন তরুণরা ওদের দেখানো পথে ছাড়া অন্য পথে না চলতে পারে। ওদের দেখানো পথটা মানে হচ্ছে ওরা যে পথে চলেছে সেই পথটা। সেটা ময়লা পথ, নোংরা পথ, অন্যায় পথ- দুর্গন্ধযুক্ত যে পথ। কিন্তু বুড়া ভামগুলি তরুণদেরকে সেই পথেই চলতে বাধ্য করবে আর তার জন্যে কায়দা ফেঁদেছে। সে এমন কায়দা যে বুড়াদের দেখানো বাতিল পঁচা পথে ছড়ানো শত বছরের পুরনো মলের দুর্গন্ধও ছেলেমেয়েদের মনে হবে আহা কি সুবাস।

এই যে কায়দাটা বুড়া বাতিল শয়তানের দল ফেঁদেছে, এটার নামই শিক্ষা। মানে কিনা আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা। এখন আমাদের স্কুলে, কলেজে মাদ্রাসায় ইউনিভার্সিটিতে যে কায়দায় শিক্ষা দেওয়া হয় সেটা। এটা বিকৃত। এটা অন্যায়। এটা বদ। ফলত এই শিক্ষা তরুণদেরকে পঙ্গু করে দেয়, নতজানু দাসে পরিণত করে। দিনের পর দিন মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর আমাদের ক্লাসরুমগুলিতে ছেলেমেয়েদের মেরুদণ্ডের উপর ধীরে ধীরে বিষাক্ত আরক ছড়িয়ে সেটাকে নরম করা হয় আর শেষ পর্যন্ত সেটাকে খুলে ফেলে দেওয়া হয়। কিভাবে? বলছি।

শিক্ষা কেনো? একটি মানুষের বাচ্চাকে কেনো শিক্ষা দিতে হয়? কারণ মানুষ প্রকৃতিকে জেনেছে অনেকটুকু। এই জ্ঞানটুকু আমরা তরুণদেরকে জানাতে চাই। তাইলে এই পর্যন্ত আমাদের অর্জিত যেটুকু জ্ঞান আছে শিশুটা সেটা জানবে আর সেইখান থেকে পরবর্তী ধাপটা শুরু করবে। আরেকটা কাজ হচ্ছে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক, যে সংযোগ সেটার কিছু নিয়ম কানুন মানুষ তৈরি করেছে, সেই নিয়মকানুন যেন শিশুরা জানে। কেননা আমরা একসাথে হয়ে সংঘ-সমিতি রাষ্ট্র ইত্যাদি বানিয়ে বাস করছি এইগুলি যেন টিকে থাকে। ঐ যে টিকিয়ে রাখার কায়দা- ঐটাই হচ্ছে বদমায়েশির মূল হাতিয়ার।

বদমায়েশি বলছি কারণ শিক্ষাটা ভুল পথে দেওয়া হয়, যেখানে শুরুতেই শিশুটিকে নিচু প্রকৃতির প্রাণী ধরে নেওয়া হয়। মানুষের বাচ্চাকে মানুষের প্রাপ্য সম্মানটা দেওয়া হয়না।

(২)

শিক্ষা দেওয়ার দুইটা কায়দা আছে। একটা হচ্ছে গাধাকে শিখানো, আরেকটা হচ্ছে মানুষ নামক একটি উন্নত প্রাণীকে শিখানো। গাধাকে কিভাবে শিখায়? গাধাকে আপনি শিখাবেন বোঝা নিয়ে যে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে যাবে আর আসবে। এর জন্যে কি করবেন? মুলা আর লাঠি। আপনার শিখানো পথে যদি সে চলে তাইলে সে দেখবে ওর সামনে একটা মুলা আছে, কোনো না কোনো সময় সে সেই মুলাটা পাবে। আর যে মুহূর্তে আপনার দেখানো পথ থেকে সে সরে যাবে, ওকে লাঠি দিয়ে একটা মাইর দেওয়া হবে। এইভাবে করে করে একটা পথ ওর মুখস্ত হবে, সেই পথটাকেই সে ভাববে সবচেয়ে উত্তম পন্থা। এই পথে সে চলবে কেনো? এই পথটি ভালো কি মন্দ সেই বিবেচনায় নয়। লোভ ও ভয় থেকে সে এই পথ থেকে সরবে না

শিক্ষার আরেকটি পন্থা আছে। আপনি যদি মানুষের বাচ্চাকে গাধা মনে না করে একটু উন্নত প্রাণী বিবেচনা করেন, তাইলে কি করবেন? আপনি তাকে তথ্য দিবেন। এইখানে আমার ঘর, ঐটা হচ্ছে প্রচলিত পথ, ঐখানে যেতে হবে, ডানে গেলে কচুখেত, বাঁয়ে গেলে কাঁটাবন, তোমার কাঁধে আছে বোঝা ইত্যাদি। শিশুটি গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছাতে শিখবে, সবচেয়ে উপযুক্ত পথও খুঁজে নিবে। কিন্তু এই পথ খুঁজে নেওয়ার কাজটা সে ইনটেলিজেন্টলি করবে। আপনার দেখানো পথে যাবে আবার একবার ভিন্ন পথে যাবে। কচুখেতে যাবে, কাঁটাবনে যাবে। ভুল করবে, ভুল থেকে শিখবে। একসময় যে ঠিক পথটা ঠিকই বেছে নিবে।

পার্থক্য কি? শেষমেশ তো দুইজনই একই পথে চলবে। না। এই একই পথে চিরজীবন চলবে তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। মানুষের বাচ্চা ডানে বামে যাবে, ডানে বামে দিয়ে সে আপনার দেওয়া তথ্য যাচাই করবে। বলা যায় না, আপনার তথ্যে যদি ভুল থেকে থাকে সেটাও ধরে ফেলতে পারে। এরমধ্যে নতুন কোনো তথ্য যুক্ত করতে পারে। এবং একশ জন এইরকম ভুলভাল করতে করতে একদিন দেখবেন ওদেরই একজন একটা নয়া পথ বানিয়ে ফেলবে। এইটা তো হচ্ছে একটা পার্থক্য। আরেকটা পার্থক্য আছে।

এই যে মুলা-লাঠি পদ্ধতি- এটা বড় অপমানজনক। এই পথটি মানুষকে মানুষের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় না। এই পথে মানুষকে বিবেচনা করা হয় অতি নিকৃষ্ট প্রাণী হিসাবে। এই পদ্ধতির ভিত্তিটা হচ্ছে যে মানুষ তার নিজের বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করুক তার দরকার নাই। যারা সমাজ নিয়ন্ত্রণ করে, অর্থনীতির মালিক যারা, ওরা চিন্তা করবে। বাকিরা চিন্তা করবে না। তরুণরা তো নয়ই। এইজন্যে এই পদ্ধতিতে দেখবেন শিশুদের শিক্ষার মৌলিক ভিত্তিটা থাকে ওদেরকে 'উপরওয়ালার' বানি মেনে চলতে শেখানো। মানে ট্রেইনিং দেওয়া যে 'এইটা ভালো কেননা এইটা উপরওয়ালা করতে বলেছেন' আর 'এইটা খারাপ কারণ উপরওয়ালা নিষেধ করেছেন।' আর শেখানো হয় যে উপরওয়ালা হচ্ছেন কর্তা- তিনি যেটা বলবেন সেটাই ঠিক।

(৩)

অথচ হওয়ার কথা উল্টাটা। তুমি অন্য মানুষকে মারবে না। কেনো? উপরওয়ালা নিষেধ করেছেন বলে? না। সেটা ঠিক না। আপনি শিশুকে শেখাবেন যে মানুষকে মারবে না কারণ সে মানুষ, আমরা মানুষরা পরস্পরকে রক্ষা করব, মারবো না। মানুষই মানুষের অন্তিম আশ্রয়। এটা আমদের অস্তিত্বের জন্যে জরুরি। আর প্রেম। প্রেম শিখাবেন, তাইলেই হয়ে যায়।

সংক্ষেপে শেষ করতে হচ্ছে। এই যে দুইটা পথ- মুলা-লাঠি পদ্ধতি আর প্রেম পদ্ধতি, এই দুইটাকে আপনি অন্যভাবেও বলতে পারেন। প্রতিক্রিয়াশীল প্রদ্ধতি আর প্রগতিশীল পদ্ধতি। এইটা একটু বিস্তারিত বলতে পারলে ভালো লাগতো। থাক। প্রগতিশীল আর প্রতিক্রিয়াশীল নিয়ে অনেক বলেছি। আপনার রাষ্ট্রে আপনি মুলা-লাঠি পদ্ধতি চালাবেন নাকি প্রেম পদ্ধতি চালাবেন সেটি আপনার ইচ্ছা। আমি মুলা লাঠি পদ্ধতির বিপক্ষে। কারণটা তো বলেছি। আমি প্রেম পদ্ধতির পক্ষে।

মুলা লাঠি পদ্ধতি হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল পদ্ধতি। এইখানে মানুষকে দাস বিবেচনা করা হয়। শুধু দাস না, লোভী কামুক ও তস্কর প্রকৃতির দাস। এমন দাস, যে কিনা সুযোগ পেলেই প্রভুর মুলাটা চুরি করে খাবে, প্রভুকে ইয়ে মেরে দিবে, প্রভুর হাতে লাঠিটা নিয়ে দৌড় দিবে। সেজন্যে ওরা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, ভয় দেখায়, লোভ দেখায়- আর বলে ভিন্ন কথা বলবি না, যেটা বলি সেটাই মেনে চলবি।

(৪)

এইবার ভয়ের কথাটা বলি, এটা বলেই শেষ।

এই যে দুই পদ্ধতির কথা বললাম, এর বাইরেও আরেকটা পদ্ধতি আছে। আছে না বলে বলা উচিৎ ছিলো 'ছিলো', কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও এই পদ্ধতিটি এখনো আছে। এটা হচ্ছে চোখে কানে সীসা ঢেলে দেওয়া পদ্ধতি। এইটা মুলা-লাঠি পদ্ধতির বাপের বাপ। মন্দের মন্দ, অন্ধের চেয়েও অন্ধ। এরা যে কেবল দাস তৈরি করে তাই না, এই পদ্ধতিতে তৈরি দাসগুলি কুকুরের চেয়েও বেশী প্রভুভক্ত হয় আর ওদের হিংস্রতার মাত্রাও সেই পর্যায়ের। ভয়ের কথাটা হচ্ছে, আমাদের এখানে রাষ্ট্র নাকি মুলা-লাঠি পদ্ধতিতেও সন্তষ্ট নয়- সীসা প্রদ্ধতি চায়।

(৫)

এইটা নিয়ে আরেকটু কথা বলা দরকার ছিলো। পরে আরেকদিন। এখন আরেকটা কথা বলে নিই। তরুণ বন্ধুরা একটা কথা মনে রাখবে। আমাদের চারপাশে এই যে দেখছো রাষ্ট্র, আইন, কায়দা কানুন, সরকার ইত্যাদি। এইগুলি কিছুই থাকবে না। সব তুলে দেবো আমরা। সব। আইন থাকবে না, রাষ্ট্র থাকবে না, সরকার থাকবে না। সেটা হচ্ছে কমিউনিজম। কমিউনিজম হবে সারা দুনিয়ায়। একটি দেশে আলাদা করে কমিউনিজম সম্ভব না। তাইলে যতদিন কমিউনিজ না হচ্ছে ততদিন কি হবে? যতদিন কমিউনিজম কায়েম না হচ্ছে ততদিন একটা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যাবস্থা আছে, সেটা সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রে সরকার আইন এইসব থাকবে।

এই পার্থক্যটা জেনে নাও পড়েটরে। এইটা জরুরি। বুড়ো হয়ে গেলে তোমাদের মাথায় এইটা হাতুড়ি পিটিয়ে ঢুকানো যাবে না। মুলা-লাঠি বা সীসা পদ্ধতি ততদিনে তোমাকে খেয়ে ফেলবে।

 

1433 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।