ফড়িং ক্যামেলিয়া

সাংবাদিক

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আতঙ্কে পরিণত করবেন না

সাইকোলজিতে aversion therapy বলে একটা থেরাপি আছে। যার বাংলা করলে দাড়ায় বিতৃষ্ণা থেরাপি। ধরুন কেউ ঘুষ নেয়, তো প্রতিবার ঘুষ নেবার সময় যদি তাকে একটা ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হয়, তবে এক সময় সেটা তার মনের মধ্যে ঢুকে যাবে। পরবর্তীতে সে যখন ঘুষ চাইবে তখন তার মধ্যে শক খাবার আতঙ্ক এসে ভর করবে এবং এক সময় ঘুষের প্রতি তার প্রবল বিতৃষ্ণা চলে আসবে।খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি আমাদের প্রজন্মটাকে আসলে এই বিতৃষ্ণা থেরাপীর মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। এই বিতৃষ্ণা থেরাপীর জন্য যে বিষয়টা কে ব্যবহার করা হচ্ছে তার নাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছাড়া বাঙালি হওয়া কোনো ভাবেই সম্ভব না, এবং অনস্বীকার্য ভাবেই দেশ কে ভালোবাসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করতেই হবে। 

কিন্তু যেভাবে এর অপব্যবহার হচ্ছে তাতে এক সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুনলেই মানুষ আঁতকে উঠবে, ভাববে, এই চেতনা রক্ষায় আবার জানি কি কি করতে হয়।

গত কয়েকদিনে এই দেশে একটা অসাধারন বিষয় ঘটে গেছে। যে প্রজন্ম কে প্রায় ঠাট্টা করে কিবোর্ড বিপ্লবী ডাকা হয়, ''আই হেইট পলেটিক্স'' প্রজন্ম দেশে কি হচ্ছে সে সব বাদ দিয়ে কার স্ক্রিনশট বের হলো, সেটায় বেশী মনযোগী ছিলো, তারা তাদের অধিকারের দাবিতে পথে নেমে এসেছে। তারা বঙ্গবন্ধু কে বুকে নিয়েই রাস্তায় নেমেছিলো। স্বাভাবিক ভাবেই এই অসাধারন বিষয়টাকে স্বাগত জানাবার কথা ছিলো। কিন্তু বিষয়টা তা হয় নি। আমাদের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বললেন, “ফেইসবুকে যারা স্ট্যাটাস দিয়েছে এরা তো ছাত্র না, এরা মতলব বাজ, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরের এজেন্ট” 

উনার কথার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য। গতকাল উনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেখানে তিনি কোটা সংস্কারের ধার দিয়েও গেলেন না বরং পুরা কোটাই বাতিল করে দিলেন। তার বক্তব্যে স্পস্ট ক্ষোভ ছিলো, অভিমান ছিলো।

আমি জানি না, উনি কেনো ধরে নিয়েছেন এই আন্দোলনকারীরা আসলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সাথে দ্বিমত পোষণ করা প্রজন্ম। এরা মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা প্রজন্ম! এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে আসা প্রজন্ম! 

অথচ বিষয়টা মোটেও তা ছিলো না। এই প্রজন্মই ২০১৩ তে রাজাকারের বিচারের দাবিতে পথে নেমেছিলো। এই প্রজন্মের কারণে আজকে স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে পতাকা নেই। এই প্রজন্ম রাজাকারদের গালি দেয়া প্রজন্ম। এই প্রজন্ম পাকিস্তান নামক দেশটাকে ক্ষমা না করা প্রজন্ম। এরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী না হয়, তবে কারা বিশ্বাসী? কারা দেশ প্রেমিক?

ছোট্ট একটা ইতিহাস বলে শেষ করছি-

সময়টা ১৯৭৩, আলজিয়ার্স জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বন্ধবন্ধুর সাথে আলাপ হয়েছিলো ফিদেল ক্যাস্ট্রোর। শেখ মুজিব এবং বাংলাদেশের জন্য ক্যাস্ট্রোর গভীর ভালোবাসা ছিলো। ক্যাস্ট্রোর সাথে সাক্ষাতের সময় শেখ মুজিব দুঃখ করে বলেছিলেন, আমার দেশটা এখন ধ্বংসস্তূপ। সব কিছু নতুন করে গড়তে হচ্ছে। আপনি তো জানেন, পাকিস্তানিরা আমাদের দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলেছে। এখন দেশ গড়ার দক্ষ লোক পাচ্ছি না। তাই বাধ্য হয়ে কখনো কখনো দেশবিরোধীদের কিছু জায়গায় বসাতে হচ্ছে। 
ক্যাস্ট্রো তখন সতর্ক করে বলেছিলেন, 

“এ কাজ কক্ষনো করবেন না, দক্ষতার চেয়ে দেশপ্রেম বড়। দক্ষতা সময়ের সাথে চলে আসে কিন্তু দেশপ্রেম আসে না। আমাদের দেখুন, আমি, চে, কামিলো এরা যখন দেশের ভার নিয়েছি তখন আমাদের বয়স ত্রিশের কোঠায় আর দেশ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না কিন্তু দেশ প্রেম দিয়ে আমাদের অনভিজ্ঞতা আমরা পুষিয়ে নিয়েছি” 

ক্যাস্ট্রোর সতর্কবাণী যে মিথ্যে ছিলো না তার সাক্ষী ৭৫ এর ভয়াবহতা।

প্রেক্ষাপট পালটেছে কিন্তু চিত্র একই, বঙ্গবন্ধু কন্যা, আপনি প্লিজ দেশ প্রেমিক চিনুন। আপনি কি ভাবেন কিংবা আপনার চারপাশে কারা বসে আছে আমি জানি না, শুধু জানি যারা বসে আছে ওরা দেশের ভালো চায় না। ওরা দেশপ্রেমীক প্রজন্ম কে দূর করে দিচ্ছে। এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কে আতংক বানিয়ে দিচ্ছে।

1473 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।