মোজাফফর হোসেন

লেখক ও গবেষক

কন্যা সন্তানের মাতা-পিতারা আওয়াজ তুলুনঃ প্রসঙ্গ উত্তরাধিকার আইন

ইসলামী হোক আর রাষ্ট্রীয় হোক, এই সম্পত্তি আইন এখনো বহাল আছে কোন যুক্তিতে? মুসলিম এবং দেশের চলমান আইন অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির একজন মেয়ে থাকলে এবং কোনো ছেলে না থাকলে মেয়ে মৃত ব্যক্তির মোট সম্পত্তির অর্ধেক পাবে। যদি একাধিক মেয়ে থাকে এবং ছেলে না থাকে মেয়েরা মোট সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে এবং এ অংশ সব মেয়েদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে। [স্ত্রী জীবিত থাকলে স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তির সন্তান থাকা অবস্থায় ১/৮ অংশ (এক-অষ্টমাংশ) পাবেন এবং সন্তান না থাকলে ১/৪ অংশ (এক-চতুর্থাংশ) পাবেন।] বাকি সম্পত্তি মৃত ব্যক্তির ভাই বা ভাইয়ের ছেলেরা পাবেন।

 

 

অর্থাৎ, ধরুন, আপনি সারাবছর গরুর মতো খেটে সম্পত্তি করলেন। ভাইয়ের সাথে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই। ভাইয়ের ছেলেদের সাথে যোজন যোজন দূরে বসবাস আপনার। আপনি যা করেছেন সবই আপনার একক পরিশ্রমের ফসল, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নয়। কিন্তু আপনার ছেলে না হয়ে আপনি এক বা একাধিক কন্যা সন্তানের জনক হলেন। এই অপরাধে (?) আপনার সম্পত্তির একটা বিরাট অংশ বের হয়ে যাবে। অর্থাৎ আপনার সারাজীবনের সঞ্চয় আপনার পরিবারের বাইরে চলে গেল।

ইসলামে আইনটি যখন করা হয় তখন সমাজে কমিউনিটিভিত্তিক জীবনব্যবস্থা চালু ছিল। সেখানে পরিবারের চেয়ে সমাজ কিংবা কমিউনিটির স্বার্থ বেশি দেখা হত। কিন্তু এখন আর সেটা নেই। এখন সব পরিবারকেন্দ্রিক। প্রতিটি পরিবার অন্য পরিবার থেকে স্বতন্ত্র। সম্পত্তি অর্জন কিংবা দেখভালের জন্য পরিবারের বাইরের সদস্যদের কোনো ভূমিকা এখন থাকে না। এ রকম সমাজব্যবস্থায় পুত্রের অবর্তমানে মৃতের নিজের কন্যাসন্তানকে বাবার পুরো সম্পত্তি প্রদান না করে তুলনামূলকভাবে দূরবর্তী আত্মীয় চাচা-ফুফুদের কাছে সেই সম্পত্তি হস্তান্তর কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য আইন হতে পারে না।

এর সম্ভাব্য প্রতিকার হিসেবে আমরা ভাবছি, বা করে থাকি, পুত্রসন্তানের অনুপস্থিতির কারণে পিতা তার জীবদ্দশায় কন্যাসন্তানের অনুকূলে সম্পত্তি উইল করে যান। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো উইল করতে হলে সহ-শরিকদের মতামত গ্রহণ করতে হয়। যা বাস্তবে বেশ কঠিন ব্যাপার। আবার জীবদ্দশায় কন্যাসন্তান সম্পত্তি দান করে দিলে মুশকিল হলো বাবা-মায়ের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। এটা অনিরাপদ। কারণ সম্পত্তিতে আইনগতভাবে আর বাবার মালিকানা থাকে না। সম্পত্তিহীনভাবে বাকি সময়টা মেয়ের গলগ্রহ হয়ে পড়ে থাকার ঝুঁকি কেউ নিতে চান না। কিংবা আজ দেবো কাল দেবো করে হঠাৎ করে মারা গেলে বা অপমৃত্যু ঘটলে মেয়েরা নিজের বাবার সম্পত্তির একটা বিরাট অংশ থেকে বঞ্চিত হন।

আমি লক্ষ্য করে দেখেছি, যাদের এক বা একাধিক কন্যা সন্তান আছে কিন্তু ছেলে সন্তান হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই বা আর সন্তান নিতে চান না, তারা নিজের সম্পত্তি কিভাবে তাদের কন্যারা সম্পূর্ণ অংশই পেতে পারে তার জন্য ফাঁকফোকর বা বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, বিকল্প ব্যবস্থার অনুসন্ধান করা মানেই তো ইসলামী আইনের বিপক্ষে যাওয়া, তাই যদি করতে চান, তাহলে আইনটা পরিবর্তনের জন্য আওয়াজ তোলা হচ্ছে না কেন? দেশে ছেলে সন্তানহীন দম্পতির সংখ্যা অসংখ্য, কেবল তারাই এই আইনের বিরোধিতা করলেই তো আইনটি বদলে যেতে পারে।

পুত্রের অবর্তমানে কন্যাকে মৃত পিতার অবশিষ্ট সম্পত্তি প্রদান করে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে বাংলাদেশ আইন কমিশন বেশ আগেই সরকারের কাছে সুপারিশ করেছে। কমিশনের দাবি, ইসলামী নীতির মধ্যে থেকেই এভাবে আইন প্রবর্তন করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে তারা ইন্দোনেশিয়ার সর্বোচ্চ আদালতের একটি রায়কে উল্লেখ করেছে। ইন্দোনেশিয়ার আদালত ছেলে সন্তানের অনুপস্থিতিতে মেয়ে সন্তানকে মৃত পিতার উত্তরাধিকার সম্পত্তির অবশিষ্টাংশ প্রদানের পক্ষে রায় প্রদান করেছেন। রায়ে যুক্তি দিয়ে বলা হয়েছে, সূরা নিসার ১৭৬ নাম্বার আয়াত অনুসারে নিঃসন্তান ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি জীবিত ভাই-বোনের কাছে চলে যায়। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, মৃতের সন্তান-সন্ততি না থাকলে তবেই সম্পত্তি মৃতের ভাই-বোনদের কাছে চলে যাবে।

সুতরাং মৃতের সন্তান থাকলে তার ভাই-বোনেরা সেই সম্পত্তিতে অংশ পাবে না, সেটিই এ আয়াত থেকে সাব্যস্ত হয়। নিঃসন্তান ব্যক্তি বলতে বর্তমানে এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হয়, যার ছেলে সন্তান নেই; অথচ কোরআন শরিফে সন্তান বলতে পুরুষবাচক কোনো শব্দ উল্লেখ করা হয়নি। সে হিসেবে একজন মেয়ে সন্তান থাকলেও মৃতের সম্পত্তি তার ভাই-বোনদের কাছে যাবে না বলেই এ আয়াত থেকে সাব্যস্ত করা সম্ভব। সুতরাং, মৃতের ছেলে সন্তানের অবর্তমানে যে সম্পত্তি বর্তমানে মৃতের ভাই-বোন বা দূরের কোনো আত্মীয়ের কাছে চলে যাচ্ছে, তা কন্যাসন্তানের অনুকূলে প্রদান করে বিশেষ আইন করার পক্ষপাতী বাংলাদেশ আইন কমিশন।

পুত্রসন্তানের অবর্তমানে কন্যাসন্তানের কাছে পুরো সম্পত্তি না গিয়ে মৃতের তুলনামূলক দূরবর্তী আত্মীয়ের কাছে সম্পত্তি চলে যাওয়ার এ ধারণা কি কোরআন শরিফে নির্দিষ্টভাবে বর্ণিত আছে? এ ব্যাপারে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ মো. ইমদাদুল্লাহ বলেন (দৈনিক যায় যায় দিনকে), কোরআন শরিফে কেবল নারীদের নির্দিষ্ট অংশ দেয়া হয়েছে। সূরা নিসায় পুত্রসন্তানের অবর্তমানে কন্যাসন্তানদের জন্য উত্তরাধিকার সম্পত্তির সর্বোচ্চ দুই-তৃতীয়াংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পুত্রসন্তান না থাকলে কন্যাসন্তানকে নির্ধারিত অংশ দেয়ার পর বাকি সম্পত্তি কোথায় যাবে, সে ব্যাপারে কোরআন শরিফে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। মূলত হাদিসের মধ্য দিয়ে এ বিধান সাব্যস্ত হয়েছে।

ধরুন হাদিসে থাকলই। আমরা হাদিসের সব আইন কি এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে মানি? এই যে কুরআনে বলা হয়েছে, একজন পুরুষের সাক্ষ্য দুজন নারীর সমান। [২নং সূরা আল-বাকারার ২৮২ নং আয়াত] এটা কি এখন বাংলাদেশের কোর্টে বা বিচারব্যবস্থায় মানা হয়? না-হলে, এই যুগ-অনুপযোগী সম্পত্তি আইন মানা হবে কোন যুক্তিতে? তাছাড়া ইজমার অপশন কুরআনেই আছে। সুরা ইউনুসের ৭১নং আয়াতে উল্লেখ আছে: তথা তোমরা তোমাদের সিদ্ধান্তকে চুড়ান্ত কর। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন-

আমার উম্মাতের কাছে যা ভাল আল্লাহর কাছেও তা ভাল। ইমাম আবূ হানীফা(রঃ)বলেন, “শরীয়াতের কোন হুকুমের ব্যাপারে একই যুগের সকল মুজতাহিদদের একমত হওয়াকে ইজমা বলে।” অর্থাৎ ইসলামী পণ্ডিতরা ইসলামের ভেতর থেকেই এর সুরাহা করতে পারেন।

জানি, যাদের ছেলে সন্তান আছে, তারা এটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করবেন না। কিন্তু যাদের কেবল কন্যা সন্তান আছে, তারা এখনই আওয়াজ তোলেন। আপনি আপনার মেয়েকে বেশি ভালোবাসেন নাকি ভাইয়ের ছেলেকে? দেশের আইন বললেই আপনি মানবেন কেন এই অন্যায় আইন? এটা কেবল নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপার না, আপনি পুরুষ, পিতা হিসেবে আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ও এর সাথে জড়িয়ে। আপনি পুরুষ বলেই কি নিজের মেয়ের হক অন্য একটা পুরুষের হাতে তুলে দেবেন?

আমার পরিবার থেকে একটা উদাহরণ দিই। আমার বড় ভাইয়ের তিন কন্যা সন্তান। [পুত্র সন্তানের আশায় শেষেরটা হয়েছে বলে আমার ধারণা] মেজভাইয়ের দুই ছেলে। মেজভাইয়ের সাথে বড়ভাই তো বটেই আমাদের পরিবারের কারো সাথে সুসম্পর্ক নেই। বড়ভাই সারাদিন খেটে খেটে নিজের সম্পত্তি তৈরি করছে আর মেজভাই বসে বসে পা দোলাচ্ছে সেই সম্পত্তির ভাগ নেবে বলে। লোকজনকে সে মুচকি হেসে বলে, আমার ওত কাজ করার দরকার কি? আমার বড়ভাই হুজুর বলে হয়ত ইসলামী এই আইনের পরিবর্তন চাইবেন না, কিন্তু আমি নিশ্চিত, তিনি এই আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করবেন বা অলরেডি বিকল্প ভেবে নিয়েছেন। না হলে এত খাটবেন কেন? এখন রাষ্ট্র যদি আইনটা করে দেয়, তাহলে ব্যক্তির আর মনে করার কারণ থাকে না যে সে ইসলামী আইনের বিরোধিতা করছে।

সাধারণত স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া হলে স্বামী বলে ফেলেন, ‘ভালো না লাগলে তুমি আমার সংসারে থেকো না’। বা স্ত্রী রাগের বসে বলেন ‘থাকো তোমার সংসার নিয়ে’। কিন্তু স্ত্রী যাবেন কোথায়? বাবার বাড়ি তো এখন তার ভাইদের বাড়ি। আবার স্বামীর বাড়িও তার না। নারীর এই নিরাপত্তাহীনতার কারণ হলো তার সম্পত্তিতে সমান অধিকার না থাকা। আমি মনে করি, উপরের বিষয় ছাড়াও, সবক্ষেত্রে পিতা-মাতার সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। আমার বোন যেমন পৈতৃকসূত্রে আমার সমান সম্পত্তি পাবেন, আমার স্ত্রীও তেমন তার পৈতৃকসূত্রে তার ভাইদের সমান সম্পত্তি পাবেন। আমি তো সমস্যা কিছু দেখছি না।

[উল্লেখ্য, হিন্দু সম্পত্তি আইনের প্রায় সবটার সংস্কার প্রয়োজন। ওখানে আরো সমস্যা। ওটা অন্য একটা পোস্টে বলা যাবে। কিংবা আপনারাও অংশ নিতে পারেন। আপাতত এদেশ ব্যাপক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে এবং আমি নিজে মুসলিম বলে আত্মসমালোচনা করলাম। এ নিয়ে ইস্যু তৈরি করতে চাইলে আপনার ওয়ালে করেন, এখানে না।]

 

3722 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।