জাহাঙ্গীর আলম

বাহরাইন প্রবাসী। ম্যানেজার অফ বলোবার্ড ম্যান্স ওয়ার।

মৃত‍্যুঞ্জয়ী ইন্দ্রজিৎ "স্টিফান হকিং"

ঘুম থেকে জেগেই জানলাম, স্টিফান হকিং আর নেই। যে মানুষটি চলে যাওয়ার কথা ছিলো প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, তিনি বেঁচে ছিলেন ছিয়াত্তর বছর। ডাক্তাররা তার বেঁচে থাকা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। নিউরো মটোর ডিজিজ তাকে গ্রাস করেছিলো। তিনি প‍্যারালাইজড হয়ে ছিলেন। কথা বলতে পারতেন না। শরীর নাড়াতে পারতেন না। চেয়ারে বসে জীবন কাটিয়েছেন দশকের পর দশক। অথচ, সেসব কিছুই তাকে জগৎজয়ের স্বপ্ন থেকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। তার মগজ দিয়ে তিনি মহাবিশ্বের কথা ভেবেছেন। সৃষ্টির রহস‍্য নিয়ে ভেবেছেন। গণিতের সমীকরণে সেসব ভাবনাকে গেঁথে, সভ‍্যতার জন‍্য দিয়ে গেছেন প্রশ্ন, উত্তর ও ভাবনার খোরাক।

তার মতো প্রাণশক্তির কাউকে দেখি নি। রোগ তাকে কাবু করতে পারে নি। মৃত্যু ভয় তাকে গ্রাস করে নি। মৃত্যুর প্রহর গুনে তার সময় কাটেনি। তার মগজের নিউরণে ছিলো ব্ল‍্যাকহোল। তার কল্পলোক জুড়ে ছিলো নক্ষত্রপুঞ্জের আলোকধারা। যে দূর থেকে আলোক এসে পৌঁছায় না, সে দূরে চলে গেছে তার ভাবনা। সে দূরে চলে গেছে তার কল্পনা শক্তি। তার নায়ক, আইনস্টাইন বলেছিলেন—Imagination is more important than knowledge. 

হকিং খুব মজার মানুষও ছিলেন। রসবোধ ছিলো তার। বন্ধুদের সাথে মজা করতেন। —১৯৭৪ সালের কথা। হকিং তার বন্ধু কিপ থর্নের সাথে বাজি ধরলেন। থর্ন হলেন ক‍্যালটেকের বিখ‍্যাত প্রফেসর। বাজির বিষয় ছিলো Cygnas X-1। “সিগনাস এক্স-১” যদি ব্ল‍্যাকহোল হয়, তাহলে হকিং চার বছর ধরে “প্রাইভেট আই” নামক বিখ‍্যাত ব্রিটিশ ম‍্যাগাজিনের সংখ‍্যা পাবেন। আর “সিগনাস এক্স-১” যদি ব্ল‍্যাকহোল না হয়, তাহলে কিপ থর্ন পাবেন “প‍্যান্থহাউজ” নামক ম‍্যাগাজিনের এক বছরের সংখ‍্যা। প‍্যান্থহাউজ ছিলো ম‍্যান ম‍্যাগাজিন। সে বাজি অমিমাংসিত থেকে যায়। উল্লেখ‍্য, কিপ থর্ন গত বছর ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। 

সারা পৃথিবীর তরুণরা তাকে দেখে প্রাণশক্তি পেয়েছে। তাকে দেখে উজ্জিবীত হয়েছে। স্তিমিত হয়ে যাওয়া স্বপ্নগুলো প্রাণ পেয়েছে তাকে দেখে। হকিং দেখিয়েছেন- মানুষ মরে তার কল্পনায়। মানুষ মরে তার প্রাণশক্তিতে। মানুষের পরাজয় হয়, যখন সে ভাবনায় মৃত। তাকে দেখার সৌভাগ‍্য হয় নি, তবে তিনার বই পড়েছি, রেকডও শুনেছি। একবার, হাজারো তরুণ মেধাবী প্রাণের ভিড়ে তিনি বললেন—"Look up at the stars and not down at your feet. Try to make sense of what you see, and wonder about what makes the universe exist. Be curious." 

এমন কথা বলা, স্টিফেন হকিং চলে গেছেন। আবারো বলছি, তিনি চলে যেতে পারতেন বহু আগেই। চলে যাওয়ার কথাও ছিলো তাঁর। 

কিন্তু বেঁচে ছিলেন বহু বছর। জীবন তাকে দিয়েছে যন্ত্রণা। অসম্ভব যন্ত্রণা। দশকের পর দশক অবশ হয়ে ছিলেন। চেয়ারে বসে কাটিয়েছেন। শরীর নাড়াতে পারেন নি। এই মানুষটি ঘরে বসে থাকতে পারতেন। কাজ-কর্ম ছেড়ে, শুয়ে-বসে জীবন কাটাতে পারতেন। জপমালা হাতে নিয়ে মৃত‍্যু প্রহর গুনতে পারতেন। মৃত‍্যু ভয়ে নিজেকে শপে দিয়ে, ভীত-সন্ত্রস্ত হৃদয় নিয়ে থাকতে পারতেন। একজন যাজক সেজে, ধর্ম প্রচার করে বেঁচে থাকতে পারতেন। সাধুর বেশে হতে পারতেন ঠগবাজ! কিন্তু তিনি সেসব কিছুই করেন নি। নিজের শরীরের সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে তীব্র ভেংচি দিয়ে, এই মহাবিশ্ব নিয়ে ভেবেছেন। দু‘চোখ দিয়ে যা দেখা যায় না, তা দেখেছেন। মানুষের ভাবনা যেখানে পৌঁছে না, সেখানে তিনি পৌঁছেছেন। সৃষ্টির ধাঁধাকে নগ্ন করে দেখার প্রচেষ্টায় মগ্ন ছিলেন। প্রশ্ন করেছেন। প্রশ্নের উত্তর খুঁজে কাটিয়েছেন কতো প্রহর, কতো কাল! জীবন তাকে যন্ত্রণা দিলেও, জীবন থেকে তিনি নিতে কার্পণ‍্য করেন নি। আলস‍্য তাঁর কাছে এসে হাঁটুকম্পনে ধরাশায়ী হয়েছে।  

এরচেয়ে বেশি একজন মানুষ কী দিতে পারতেন, আমার জানা নেই। জ্ঞানের সাম্রাজ‍্যে যিনি একটি অঞ্চলকে সমৃদ্ধ করেছেন, সেটার নাম কসমোলজি। তারুণ‍্যের মেধা দিয়ে সারা জীবনের বন্দিত্বকে জয় করেছেন। শারীরিক জঙ্গমতাকে জয় করেছেন। এই দুনিয়াতে মানুষ যখন মানুষকে মারছে পাখির মতো, তখন তিনি দেখেছেন নক্ষত্রপুঞ্জের প্রগাঢ় সৌন্দর্য। শুনিয়েছেন, মহাশূণ‍্যের মহাগল্প। মানুষ যখন মানুষের মগজে বিষ্ঠা ঢুকিয়ে দিচ্ছে, তখন তিনি বলেছেন, নক্ষত্রের খই ফোটা গগণের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হতে। বলেছেন, প্রশ্ন করতে। মানুষ যখন মানুষকে অন্ধকারের দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, হকিং তখন হৃদয়ের সমস্ত বিশালতা দিয়ে আলোকের সন্ধান করেছেন। অসংখ‍্য তারুণ‍্যকে সত‍্য সুন্দরের পথে মুসাফির হওয়ার আহ্বান করেছেন। —এরচেয়ে বেশি একজন মানুষ কী দিতে পারতেন, জানি না। 

অথচ এমন একজন মানুষকে নিয়েও, আমাদের কতো কতো তরুণ/তরুণী হীনকর মন্তব‍্য করেছে। কুৎসিত চিন্তায় মেতেছে। হকিং মারা যাওয়ার পর, দেশের বহু তরুণ-তরুণী তাঁর ধর্ম নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে। তাঁর বিশ্বাস নিয়ে ব‍্যস্ত হয়েছে। তাঁর মৃত‍্যুকে স্বাগত জানিয়ে প্রশান্তির বুলি ছুড়েছে। তাঁর নিশ্চলতাকে দেখেছে স্রষ্টার পাপ হিসেবে। তারা এই মৃত‍্যুকে, হকিং-এর পরাজয় হিসেবে দেখেছে। অথচ, এই নির্বোধগুলো বুঝে না, মৃত‍্যু কারো পরাজয় নয়। মৃত‍্যু হলো অনিবার্য। 

এইসব আঁধার ভরা চিত্তের ভিড়েও যে আলোকাধার আছে, আমি শুধু সেগুলোই দেখি। আমি দেখছি, দেশের অসংখ‍্য মেধাবীরা তাদের হৃদয়ের সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে একজন বিজ্ঞানীকে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। অচিরেই দেশের বহু জায়গায় এই মানুষটির স্মরণে ছেলে-মেয়েরা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করবে। তাঁর কর্মকে বুঝার চেষ্টা করবে। বিশ্ববিদ‍্যালয়গুলোতে তাঁকে নিয়ে স্মরণ সভা হবে। ছেলে-মেয়েরা চাঁদা তুলে, এমন বিজ্ঞানীর ভাস্কর্য তৈরি করবে বিদ‍্যালয় আঙ্গিনায়। তাঁর প্রাণশক্তিকে ধারণ করে, নিজেদের নিঃস্পৃহ হৃদয়ে আঘাত হানবে। জাগ্রত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, শুরু করবে নতুন প্রত‍্যয়ে। আমি তাই অন্ধকারের ওপাড়ের আলোটুকুই দেখি। নির্বোধ হৃদয়ের নোংরামি দেখে আহত হতে যাই না আর।

পঞ্চাশ বছর ধরে দুরারোগ‍্য রোগে ভুগেও যিনি জগত সৃষ্টির প্রহেলিকা উদ্ঘাটন করার ধ‍্যানে মগ্ন ছিলেন, তিনি হলেন সত‍্যিকারের মৃত্যুঞ্জয়ী। তিনি হলেন সত‍্যিকারের ইন্দ্রজিৎ। তার মৃত্যু নেই। এমন নক্ষত্ররা প্রাণের মিছিল থেকে স্খলিত হয়ে, অন‍্য গগণের নক্ষত্র হয়ে জ্বলতে থাকতে থাকে।

বিনম্র শ্রদ্ধা "স্টিফান হকিং" 

1609 times read

নারী'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত নারী'র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখকের কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় নারী কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। নারীতে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।